Connect with us

বাংলাদেশ

আশরাফুল আলম খোকনকে নিয়ে ডিজিএফআই’র গোপন নথি ফাঁস

Published

on

আশরাফুল আলম খোকন

নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ | প্রকল্পে অনিয়ম | অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা | তদবির বাণিজ্য | বিদেশি শিল্পী এনে অনৈতিক কাজ | দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদক

এক সময় বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেস সচিব ছিলেন আশরাফুল আলম খোকন। লুটপাটের এমন কোন অভিযোগ নেই যা এই খোকনের বিরুদ্ধে নেই। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন। সম্প্রতি তার অনিয়মের বিশাল এক ফিরিস্তি তৈরি করে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই)। সেই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না পেলেও কিছু অংশ ফাঁস হয়ে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই নথি থেকে জানা যায়, তার নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় তেতাল্লিশ কোটি টাকা। এছাড়া তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি, যুক্তরাষ্ট্রে কমার্সিয়াল ফ্লোর, ইটভাটা, রেস্টুরেন্ট প্রভৃতি। যার মধ্যে কাপাসিয়ার একডালা এলাকায় একটি বাড়ি রয়েছে যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকা। এছাড়া, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ৮ নং সেক্টরে ৫ কাঠা জমি রয়েছে। যার বাজার মূল্য দেখানো হয়েছে আড়াই কোটি টাকা। গাজীপুরের কালিগঞ্জের মুক্তারপুরে রয়েছে A&B নামের একটি ইটের ভাটা। এই ইট ভাটার বাজার মূল্য ৪ কোটি টাকার বেশি।
ইতিমধ্যে তার নামে চারটি ব্যক্তিগত গাড়ির তথ্য রয়েছে। গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৭-৪১৭৭ (ল্যান্ড ক্রুজার), ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-২৫৭২ (টয়োটা-রাশ), ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-০০৭৭ (মিতসুবিশি পাজেরো জিপ) ও ঢাকা মেট্রো-গ-৩৫-৭৬২৭ (কার স্যালুন)।
২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেস সচিব পদে যোগ দেন খোকন। এরপর থেকেই শুরু হয় তার দুর্নীতির মহোৎসব। ডিজিএফআই’র সেই নথিতে তার নামে পিএম বিটে কর্মরত জামায়াত-বিএনপি মতাদর্শের সাংবাদিকদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করার অভিযোগ রয়েছে। যেমন: মাহবুব স্মারক (তারেক জিয়ার দুষ্কর্মের প্রধান সহায়ক গিয়াস আল মামুনের পিএস ছিল এবং সে নিয়মিত হাওয়া ভবনে যাতায়াত করত বলে জানা যায়), এনটিভির আহমেদ পিপুল (বিএনপি), চ্যানেল ২৪ এর জুনায়েদ শাহরিয়ার (ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন) এবং একই চ্যানেলের ইমাম হাসান শুভ্র (বিএনপি), বাংলাভিশনের সৈয়দ আব্দুল মুহিত (গাইবান্ধায় তার পরিবার জামায়াতপন্থী এবং ২০১৪ সালে অবরোধকালীন গাড়ী পোড়ানোর মামলায় তার ভাই ও বাবা আসামী) যমুনা টিভির নাজমুল হোসেন (জামায়াত পরিবারের সন্তান), বাংলাদেশ প্রতিদিনের রফিকুল ইসলাম রনি (সিরাজগঞ্জের জামায়াত পরিবারের সন্তান), ফোকাস বাংলার সাইফুল ইসলাম কল্লোল (তার চাচা নুরুল ইসলাম ফ্রিডম পার্টির নেতা) এদেরকে তিনি বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছেন।
এর মধ্যে জামায়াত পরিবারের সদস্য রফিকুল ইসলাম রনিকে কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক পদ পাইয়ে দেন বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে, ঐ এলাকার সাংসদ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ নাসিম জনাব রফিকুল ইসলাম রনি জামায়াত পরিবারের সদস্য বলে তাকে ছাত্রলীগের পদ প্রদান না করার অনুরোধ সত্ত্বেও খোকন তাকে উক্ত পদ পাইয়ে দেন বলে জানা যায়।
সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর প্রদান প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে খোকনের নামে। ২০১৭-২০১৮ সালে আইসিটি বিভাগের অধীনে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর প্রদান প্রকল্পে তিনি বড় ধরণের অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন বলে জানা যায়। খোকন ও তার বন্ধু তারেক শমী (সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপি’র মেয়ের জামাই) ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ না করে নগদ ডলারে পরিশোধ করেছেন বলে জানা যায়। এ খাত থেকে তারা দুইজন প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা অবৈধভাবে গ্রহণ করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এর পরিচালনাকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়েব টেকনোলজিস লিমিটেড এর নিকট থেকে খোকনসহ কয়েকজন মিলে ১২ কোটি টাকা নিয়েছেন। তিনি বেনামে নিজে অথবা পরিচিত ব্যক্তি যাদের নিকট হতে পরবর্তীতে আর্থিক সুবিধা নেওয়া যাবে তাদেরকে বিভিন্ন এলাকায় নগদের ডিলার/এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছেন। যেমন: কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ও মানিকগঞ্জের রনিকে ‘নগদ’-এর ডিলারশীপ প্রদান।
ম্যাক্স গ্রুপ হতে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ খোকনের আরেকটি দুর্নীতি। তার আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ম্যাক্স গ্রুপ বলে জানা যায়। তিনি ম্যাক্স গ্রুপের প্রধান কার্যালয় রাওয়া কমপ্লেক্স, মহাখালীতে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন বলে জানা যায়।
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন খোকন। তারানা হালিম ডাক ও টেলি-যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন তার পিএস জয়দেব নন্দীর সাথে খোকনের সখ্য গড়ে ওঠে এবং জয়দেবের মাধ্যমে তিনি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
তদবির বাণিজ্য ছিল খোকনের আরেকটি দুর্নীতির খাত। খোকনের মোবাইল কল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, তার অধিকাংশ কল বিভিন্ন সরকারী নিয়োগ, প্রমোশন, বদলী ও বিভিন্ন তদবীর সংক্রান্ত এবং এক্ষেত্রে পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি (মো: ইসরাইল হাওলাদার, ০৪.০৮.২০১৯ তারিখের কথোপকথন), পুলিশ সুপার, উপসচিব (ডিসি হতে ইচ্ছুক- ০৪.০৮.২০১৯ তারিখের কথোপকথন)), ইউএনও (সৈয়দ ফয়েজুল ইসলাম টাংগাইলের নাগরপুর হতে ঢাকার ধামরাইতে বদলী), ব্যাংকের এসপিও, খাদ্য কর্মকর্তা প্রভৃতি পদের ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বা মেসেজ লেনদেন হচ্ছে।
কর্মস্থলে সহকর্মীদের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরির অভিযোগ রয়েছে খোকনের নামে। তিনি একজন স্বার্থপর ও কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তি বলে জানা যায়। কাজ না করেও কৃতিত্ব নেওয়া, অন্যকে জায়গা না দেওয়া, সহকর্মীদের নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাদেরকে টেনশনে রাখা, তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত রাখা ইত্যাদি কারণে সহকর্মীরা তার উপর খুবই রুষ্ট, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না বলে জানা যায়।
বিদেশি শিল্পী এনে অনৈতিক কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে খোকনের বিরুদ্ধে। আশরাফুল আলম খোকনের আশ্রয়ে জনাব কৌশিক হাসান তাপস গান বাংলা টিভি চ্যানেলের নাম করে ইউক্রেন হতে নারী নিয়ে এসে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রেরণ করে থাকেন বলে জানা যায়। এদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনুষ্ঠান করার কথা বলে এ দেশে নিয়ে আসা হয় এবং ইমিগ্রেশন পুলিশ দুই বার এ ধরণের ইউক্রেনীয় নাগরিকদের হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আটকে দিলে খোকন ফোন করে তাদেরকে ইমিগ্রেশন করিয়ে দেন বলে জানা যায়।
মন্ত্রণালয়গুলোর টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন খোকন। তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশেষত তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়গুলোর বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ঠিকাদারী কাজ বড় ধরণের কমিশন গ্রহণ করতেন। এ জন্য তিনি পছন্দের ব্যক্তিদের কাজ পাইয়ে দিতেন।
এছাড়াও তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম ভাঙ্গানো, গান বাংলা টিভি চ্যানেলে দখলে সহায়তা, স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালানের সিন্ডিকেটের সাথে সম্পৃক্ততা, তাজউদ্দিনের পরিবারকে কোনঠাসা করে রাখার মতো কাজ করেছেন। উপরে উল্লেখিত তথ্য কীভাবে ফাস হয়েছে বা এর সত্যতা কী তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি এখনও।
২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেস সচিব পদে যোগ দেন খোকন। ছিলেন ২০২১ সাল পর্যন্ত। তার আগে তিনি চ্যানেল আইয়ের নর্থ আমেরিকার প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এ পদে ৬ বছর কাজ করেন তিনি।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending