বাংলাদেশ
গণহত্যার বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে: আসিফ নজরুল
Published
1 month agoon
সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদেরও বিচার সম্ভব
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংগঠিত গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০১৩ সালে সংশোধিত ট্রাইব্যুনালের আইনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চালানো গণহত্যার বিচার সম্ভব বলে জানিয়েছেন, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জড়িতদের বিচার করতে আওয়ামী লীগ সরকার এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল। এই ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধি হিসাবে জামায়াতের সাবেক আমীর মতিউর রহমান নিজামীসহ দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতা, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজনের ফাঁসির রায় হয়েছে। তাদের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। ৫০ বছর আগে সংঘটিত অপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনালের এসব রায় নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ছিল দেশ-বিদেশে। এসব বিচারের তদন্ত করে ট্রাইব্যুনালের নিজস্ব তদন্ত দল। কিন্তু এবারের জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার কথা জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা।
বুধবার সকালে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গণহত্যা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় বিচারের জন্য ইতিমধ্যে কিছু মামলা হয়েছে। আমরা নিজেরা, রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি করেছেন যে, এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার সুযোগ আছে কিনা। আমরা সেটা খতিয়ে দেখেছি। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন আছে, সেটা পরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধনী হয়েছে।
সেই আইনে আমরা জুলাই গণহত্যা, আগস্টের প্রথম পাঁচদিনের গণহত্যাও বোঝাচ্ছি। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য ইতিমধ্যে ছোটখাটো গবেষণা করেছি। আমরা দেখেছি, এই আইনের অধীনে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি ও যারা আদেশ দিয়েছেন এবং যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।
আসিফ নজরুল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি ইনভেস্টিগেশন টিম আছে, প্রসিকিউশন টিম আছে। এগুলোকে আমরা রিঅর্গানাইজড করার চেষ্টা করছি, আদালতটা একটু পরে করবো। ইনভেস্টিগেশন আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার চেষ্টা করছি। জাতিসংঘ থেকে বারবার আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বিচারের সত্যিকারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘের সর্বাত্মক তত্ত্বাবধানে আমাদের ইনভেস্টিগেশন টিম কাজ করবে। সেটার লক্ষ্যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করবো। আইন উপদেষ্টা বলেন, ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গে মিটিং করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। সহযোগিতা চাইবো। এ ছাড়া, আমাদের আরও উচ্চপর্যায় থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থা আছে, উনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। আশা করছি, দ্রুত এটা শুরু করতে পারবো। তিনি বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিচার করবো। হত্যাকাণ্ডে জড়িত বিদায়ী সরকারের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি। অর্থ পাচারের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেকোনো অপরাধের বিচার করার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য আমাদের আছে। আমাদের দেশের ব্যাংক ও সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে যাবে, এটা তো আমার-আপনার টাকা। সাবেক সরকারের মন্ত্রীদের টাকা না। জনগণের টাকা যারা নিয়ে গেছেন, তাদের অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করা ও বিচারের সম্মুখীন করার জন্য যতটুকু করা দরকার, অবশ্যই আমরা করবো। আইন উপদেষ্টা বলেন, সাইবার সিকিউরিটি আইনসহ যেসব নিবর্তনমূলক আইন আছে, সেগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। এসব আইন বাতিল অথবা সংশোধন করা হবে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার না হলে জাতির কাছে আমরা দায়ী থাকবো বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সাগর-রুনি হত্যার বিচার গতি পাবে কিনা; জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, অবশ্যই, আপনারা রাজপথে থেকে আমাদের চাপে রাখবেন। এই বিচার না হলে জাতির কাছে আমরা দায়ী থাকবো। আমি বিশ্বাস করতে পারি না, এমন একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে কীভাবে প্রহসন করা হয়। বিচার বিভাগ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়কে যে সহযোগিতা করতে হয়, সেটা আমরা সম্পন্ন করেছি। এরইমধ্যে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিরা নিয়োগ পেয়েছেন। আমরা এমন একজন প্রধান বিচারপতি পেয়েছি, যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছেন। এখান থেকে আপনারা বুঝে নেবেন, আমরা কীসের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। যোগ্যতা ও সততার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। বিচার বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়ের হিসাব আগামী ১০ দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে জানান আইন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, সারা দেশে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা ৩ দিনের মধ্যে প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ বাহিনী না থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। এখন পুলিশ কাজে যোগ দিয়েছে। আশাকরি আগামী ৩১শে আগস্টের মধ্যেই সেই সব মামলা প্রত্যাহার করা হবে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে ঢাকা শহরের মামলা প্রত্যাহার হবে। রোজিনা ইসলাম ও মাহমুদুর রহমান মান্নার মামলা প্রত্যাহার হবে। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা শিক্ষার্থী ফারদিন নূর ওরফে পরশকে হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা আবরার ফাহাদের কাছে অনেক ঋণী। আমাদের রাজপথের আন্দোলনের প্রেরণা ছিল আবরার ফাহাদ ও ফারদিন নূর পরশ। তারাসহ গত ১৫ বছরে যারা নিহত হয়েছেন, গুম হয়েছেন প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা হবে। আবরার ফাহাদসহ অন্যদের বিচার কার্যক্রম ইতিমধ্যে চলমান রয়েছে। আমরা প্রতিটি হত্যার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে কাজ করে যাবো।
আইনজীবীরা যা বলেন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন চারজন আইনজীবী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনজন আইনজীবী বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য। তাঁরা মনে করেন, আইন সংশোধন না করে বর্তমান আইনে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করা যাবে না।
তবে আরেকজন আইনজীবী ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হলে এই আইনেই বিচার করা যেতে পারে।
সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদেরও বিচার সম্ভব
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদেরও সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখে তাঁদেরও বিচার করা সম্ভব বলে মনে করেন আইন উপদেষ্টা। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাবেক সরকারপ্রধানসহ অন্য যাঁদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, যাঁদের আদেশ–নির্দেশ থাকার অভিযোগ রয়েছে, পত্রপত্রিকায় কিছু মন্ত্রীর নাম দেখা গেছে। সেখানেও কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা সেটা পর্যন্ত খতিয়ে দেখব।’
পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, আগে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ফিরিয়ে আনা পরের প্রশ্ন। জুলাই গণহত্যা বলতে আগস্টের প্রথম পাঁচ দিনের গণহত্যাও বোঝানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকে পুনর্গঠন করারও পরিকল্পনা করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, একটি তদন্ত দল আছে, প্রসিকিউশন দল আছে। এগুলোকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছেন। তবে আদালত পুনর্গঠন পরে করা হবে।