বাংলাদেশ
বার বার তলিয়ে যাচ্ছে সিলেট, এবার দীর্ঘমেয়াদী বিপর্যয়ের শঙ্কা
Published
3 months agoon
বর্ষা আসতে না আসতেই প্রতিবছর তলিয়ে যাচ্ছে সিলেট। লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি। প্রাণ বাঁচাতে অনেককেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। বন্যা শেষে বাড়ি ফিরে তাদের বেশিরভাগই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এবার আরও গ্রামই শুধু নয়, শহরজীবনকেও তছনছ করে দিচ্ছে উজানের এই ঢল। এক রাতেই তলিয়ে যায় সিলেট শহর। এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? এ প্রশ্ন এখন সিলেটের সবার। গত ৬-৭ বছর ধরে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সিলেট শহর। আর জেলার নিচু জনপদগুলো তলিয়ে যায় চোখের নিমিষেই। উজানের পানি রাতারাতি এসে ডুবিয়ে দেয় সব। আবর জল নেমে যেতে সময়ও লাগে।
এবারের ঈদের দু’দিন আগে থেকেই টানা বৃষ্টি। এতে সিলেটের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। ঈদের সকাল থেকে নামতে থাকে উজানের প্রবল ঢল। রাতের মধ্যে ডুবে যায় সিলেট। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাড়িঘরে টিকতে না পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। জেলা প্রশাসনের হিসাবে সিলেট জেলায় প্রায় নয় লাখ ৫৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি। বাড়িঘরে পানি উঠে পড়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছেন প্রায় ২২ হাজার মানুষ। বৃহস্পতিবার বিকালে ১৩ উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছে সিলেট জেলা প্রশাসন। জেলার ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭৮৬ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে ওসমানীনগরে ১ লাখ ৮৫ হাজার ও গোয়াইনঘাটে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ। জেলার ১৫৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৩০টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০২টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত। আর সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ৫৫ হাজার। এমন পরিস্থিতি ২০২২ সালে হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট নগর ডুবছে, ডুববে এবং আরও ডুববে। এর কারণ, সিলেট দাঁড়িয়ে আছে পানি নিষ্কাশনের এক বিশেষ বেসিনে। সিলেটের উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসামের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল। এই দুই অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ হচ্ছে বাংলাদেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গত ৫-৬ বছর ধরে সিলেট অঞ্চল ও তার উজানে অতি বৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে আগে কখনো বৃষ্টি হয়নি। আবহাওয়ার তথ্য বলছে, চলতি জুন মাসে এ পর্যন্ত সিলেটের উজানের মেঘালয় বেসিনে ১৬৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা অতিবৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সিলেটে ১৭ই জুন পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৭০৮ মিলিমিটার।
২০২২ সালের ভয়ঙ্কর বন্যার সময়ও সিলেটে এত বৃষ্টিপাত হয়নি। তখন জুন মাসে সিলেটে বৃষ্টি হয়েছিল ১৪৫৬ মিলিমিটার। ফলে ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশে সিলেট অঞ্চলে অতিবৃষ্টিই বন্যার অন্যতম কারণ।
প্রতি বছর উজানের ঢলে মেঘালয় থেকে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারাসহ সীমান্তবর্তী নদীগুলোতে চলে আসে। অনেক আগে থেকেই পলিমাটি আসার কারণে প্রধান দুটি নদীসহ সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবেশ করা নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীগুলোর পানিধারণের সক্ষমতা কমে এসেছে। হাওর, খাল ও পুকুর ভরাট করে সিলেটে উন্নয়ন হচ্ছে।
সিলেট নগরের যে উপশহর প্রতি বছরই বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় সেটি আগে ছিল ডুবরীর হাওর। এখানে আবাসন করা হয়েছে। সুতরাং যে পানি এই হাওর ধারণ করতো সেই পানি এখন সিলেট নগরে চলে আসে। একইসঙ্গে হাওরে আরও কয়েকটি বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। নগরে পুকুর ও খাল ছিল পানির জলাধার বা বেসিন। কিন্তু এখন নগরেও আর পানির বেসিন বলতে কিছুই নেই। ফলে পানি মানুষের বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাটে চলে আসে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পানিধারণের জায়গা নষ্ট করে ফেলার কারণে এখন নগরের লোকালয়ে পানি চলে আসছে। এর জন্য দায়ী অপরিকল্পিত উন্নয়ন। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আজিজুর রহমানের মতে, সিলেট জেলায় এখন দু’দিক থেকে মেঘালয় ও আসামের পানি ঢুকছে। এতে করে সবচে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সিলেট মহানগর। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে; মেঘালয় বেসিনে যে বন্যা হয় সে বন্যার পানি বিছনাকান্দি, সাদাপাথর, জাফলংসহ কয়েকটি এলাকা দিয়ে ঢুকে সিলেটের উজানের অংশে চলে আসে। এতে সিলেট নগরও বন্যাকবলিত হয়। আর অমলসিদ হয়ে সুরমা, কুশিয়ারা এবং সারি নদীর পানি ঢুকে জেলার দক্ষিণ অংশ ডুবিয়ে দেয়। কানাইঘাটের পানি এসে প্রথমেই আঘাত করে সিলেট নগরে। তার মতে, আগে সিলেটের অবস্থা এ রকম ছিল না।
গত কয়েক বছর ধরে এ সমস্যা প্রকট হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিলেটের বেশির ভাগ পানি অপসারণের জায়গা হচ্ছে সুরমা নদী। কিন্তু জকিগঞ্জের অমলসিদ থেকে সুনামগঞ্জের ভাটিতে মেঘনা নদী পর্যন্ত এলাকা সুরমা কখনো খনন হয়নি। এ কারণে পানি দ্রুত নামছে না। এর বাইরে কিশোরগঞ্জে হাওরের মধ্যখান দখলের পাশাপাশি অষ্টগ্রাম-মিঠামইন যে রাস্তা করা হয়েছে, সেটিও সিলেটের জলাবদ্ধতার কারণ। সব মিলিয়ে সিলেট এখন দুর্যোগে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
পানি নামার জায়গা নেই। নদী খনন হয় না। আর যে উদ্দেশ্যে নদী খননের প্রকল্প নেয়া হয় সেটিও বাস্তবায়িত হয় না। এর জন্য প্রশাসনসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন অনেকে।
এদিকে, সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ সিলেটের বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেছেন ভারতের মেঘালয় বেসিনে অতিবৃষ্টি। গেল কয়েক বছর ধরে অতিবৃষ্টির কারণে সিলেট অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সিলেট সিটি করপোরেশনসহ সব দপ্তরকে একসঙ্গে বসে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। কোনো একটি, দুটি দপ্তর দিয়ে এ সমাধানের পথ বের করা সম্ভব নয়। এরপর সমাধানের জন্য যে কাজটিই শুরু করা হোক সেটি সবাইকে আন্তরিকভাবে করতে হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে নগরের তালতলা ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে পানি ঢুকেছে। বুক সমান পানিতে তলিয়ে গেছে ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়। পাশের ছড়া উপচে পানি ঢুকেছে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নিচ তলার কয়েকটি ওয়ার্ডে পানি ঢুকে পড়ায় দুর্ভোগ দেখা দেয়। তবে চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয় সহ কয়েকটি স্থানে পানি ঢুকে পড়েছে। নগরের উপশহরের অবস্থা করুণ। গত তিন দিন ধরে পানিতে ভাসছে গোটা উপশহরই। এই মুহূর্তে সিলেট নগরে জরুরি সেবা চালু রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ সহ মোবাইল নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক রাখতে কাজ করা হচ্ছে।
সিলেট নগরীর বিভিন্ন বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান, এমপি। বুধবার নগরীর মিরাবাজার কিশোরী মোহন বালক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করেন তিনি। এর আগে তিনি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়ও ত্রাণ বিতরণ করেছেন।