Connect with us

বাংলাদেশ

ভারতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য খুন

Published

on

ভারতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য খুন

মেলেনি লাশ, দুই দেশের গোয়েন্দাদের তৎপরতা

ভারতে গিয়ে নিখোঁজ ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার বেঁচে নেই। তাঁকে কলকাতায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এমপি আজীমকে শুধু খুনই করা হয়নি; লাশ টুকরো টুকরো করে গুম করেছে দুর্বৃত্তরা। তবে সেই টুকরো লাশের খোঁজ এখনও পায়নি কলকাতা পুলিশ। বাংলাদেশের কোনো এমপির পাশের দেশে গিয়ে এমন খুনের ঘটনা নজিরবিহীন। এমপি আজীম হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী তাঁরই বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আখতারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে শাহীনের নিখুঁত ছকে। ৫ কোটি টাকার চুক্তিতে হত্যা মিশনে অংশ নেন ভাড়াটে কিলাররা।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি তারা।
এ ঘটনায় ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক তরুণীসহ তিনজনকে। এ ছাড়া ভারতে দু’জনকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেছে সেখানকার পুলিশ। ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরেই কলকাতার অভিজাত এলাকা নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটের খোঁজ মেলে। শাহীনের ভাড়া করা ওই ফ্ল্যাটের দেয়ালে মিলেছে রক্তের দাগও। পুলিশের জেরায় গ্রেপ্তার তিনজন স্বীকার করেন, কলকাতার যে ফ্ল্যাটটিতে তারা ছিলেন, সেখানেই নৃশংসভাবে খুন করা হয় আজীমকে। এর পর লাশ টুকরো টুকরো করে চারটি ব্যাগে ভরে গায়েব করা হয়। পরে ওই তিনজন বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
এ হত্যাকাণ্ডে ভাড়াটে খুনিসহ বাংলাদেশ ও ভারতের ছয়জন জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রধান পরিকল্পনাকারী শাহীন পেশায় ঠিকাদার। বাংলাদেশে তাঁর কয়েকশ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ চলছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। এরই মধ্যে শাহীনের ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে একটি ডায়েরি জব্দ করা হয়েছে। সেখানে ভাড়াটে খুনির কাকে কত টাকা দিয়েছেন, সে হিসাবও আছে। ভারত থেকে দেশের ফেরার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন শাহীন। তিনি এখন সেখানে অবস্থান করছেন বলে তথ্য মিলেছে।
এ হত্যারহস্য ভেদ করতে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ নিবিড় যোগাযোগ রাখছে। হত্যার ঘটনা জানাজানি হলে এমপির নির্বাচনী এলাকা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। আজীম ছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এদিকে গতকাল দুপুরে ঢাকার মিন্টো রোডে গিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবার হত্যার বিচার চান আজীমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।

ভারতে যাওয়ার পরদিন হত্যা
চুয়াডাঙ্গার দর্শনা চেকপোস্ট দিয়ে গেল ১২ মে একা ভারতে যান আজীম। এর পর কলকাতার ব্যারাকপুর-সংলগ্ন মণ্ডলপাড়ার স্বর্ণ কারবারি বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় উঠেছিলেন। চিকিৎসা ও বন্ধুর এক মেয়ের বিয়ের কথা বলেই ভারতে গিয়েছিলেন তিনি। ১৪ মে থেকে এমপিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে হত্যা মিশনে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে, ভারতে যাওয়ার পরদিন ১৩ মে আজীমকে হত্যা করা হয়। বন্ধু গোপালের বাসা থেকে বের হওয়ার পর কলকাতায় প্রথমে একটি সাদা গাড়িতে আজীমকে তুলে নেয় এক ব্যক্তি। ওই গাড়িতে চালক, এমপিসহ তিনজন ছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর লাল আরেকটি গাড়িতে ওঠেন আজীম। ওই গাড়িতে আজীমের বাল্যবন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীনের বেয়াই সৈয়দ আমানুল্লাহ ছিলেন। এমপির পূর্বপরিচিত আমানুল্লাহ। শাহীনের বাড়ি ঝিনাইদহ।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দুই দেশের গোয়েন্দারা বলছেন, ১৩ মে দুপুর পৌনে ১টার দিকে এমপিকে বহনকারী লাল গাড়িটি কলকাতার অভিজাত এলাকা নিউ টাউনের আবাসিক ভবন সঞ্জীবনী গার্ডেনে ঢোকে। বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে এমপির জুতা ও পলিথিনের দুটি বড় ব্যাগ হাতে নিয়ে ওই বাসা থেকে আমানুল্লাহ ও কিলিং মিশনের আরেকজন বেরিয়ে আসেন। গ্রেপ্তার তিনজনের বরাত গিয়ে গোয়েন্দারা সমকালকে জানান, হত্যার পর লাশের টুকরো চারটি ব্যাগে ভরা হয়। আরও দুটি ব্যাগ নিয়ে ১৪ মে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে যায় হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটি গ্রুপ।

হত্যা মিশনের আগাম দল
শীর্ষ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এমপি হত্যায় জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন আজীমের বাল্যবন্ধু শাহীন ও তাঁর বেয়াই আমানুল্লাহ। ঝিনাইদহে শৈশব-কৈশোরের বড় একটি সময় শাহীনের সঙ্গে কাটে আজীমের। তবে শৈশবের বন্ধুত্ব পরেও তারা অটুট রাখেন। হত্যার ১৩ দিন আগে গত ৩০ এপ্রিল শাহীন, তাঁর বান্ধবী সেলিস্তি রহমান ও আমানুল্লাহ কলকাতা যান। নিউ টাউনে তারা শাহীনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে ওঠেন। তবে আমানুল্লাহ ও সেলিস্তিকে কলকাতায় রেখে ১০ মে বাংলাদেশে বৈধ পথে ফিরে আসেন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শাহীন। মূলত কিলিং মিশনের অংশ হিসেবে ঘনিষ্ঠ সহচর আমানুল্লাহকে নিয়ে আগেভাগে কলকাতায় যান। সেখানে যে ফ্ল্যাটটি তারা ভাড়া নেন, সেটিও শাহীনের নামে।

ভাড়াটে দুই খুনির পাসপোর্ট
হত্যা ছকের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ভাড়াটে দুই খুনিকে কলকাতায় নেওয়া হয়। তারা হলেন জিহাদ ওরফে জুয়েল ও সিয়াম। তাদের দু’জনের পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়েছেন শাহীন। হত্যার সাত থেকে আট দিন আগে বাংলাদেশি দুই ভাড়াটে কিলার কলকাতায় যান। আর সেখানে আরও দুই ভারতীয় ভাড়াটে খুনিকে তৈরি রাখা হয়েছিল। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আজীম হত্যাকাণ্ডে ভারত-বাংলাদেশের মোট চার ভাড়াটে কিলার এবং শাহীন ও তাঁর বেয়াই আমানুল্লাহ জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। সরাসরি হত্যার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে আছেন আমানুল্লাহ, সেলিস্তিও। এ ছাড়া একজন ভাড়াটে কিলারও গোয়েন্দা হেফাজতে আছে।

পরিকল্পনাকারীর যুক্তরাষ্ট্রে উড়াল
হত্যাকারীর নাম-পরিচয় সামনে আসার আগেই গেল সোমবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশ ছাড়েন মূল পরিকল্পনাকারী শাহীন। তিনি ভিস্তেরা এয়ারলাইন্সে দিল্লি ও কাঠমান্ডু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। একাধিক সূত্র বলছে, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় শাহীনের বাড়ি রয়েছে। হত্যা মিশন শেষে সেখানে একটি পার্টিও দিয়েছেন তিনি। আবার দেশ ছাড়ার আগেভাগে তাড়াহুড়ো করে একটি দামি প্রাডো গাড়ি মাত্র ২৭ লাখ টাকায় বিক্রি করেন শাহীন। ওই গাড়ি পুলিশ জব্দ করেছে। এ ছাড়া শাহীনের ফ্ল্যাট থেকে একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে। সেখানে ভাড়াটে খুনির পেছনে কত টাকা খরচ হয়েছে, সে হিসাবও আছে।

দুই সিম দুই জায়গার নেপথ্যে
‘নিখোঁজ’ থাকা অবস্থায় ১৬ মে আজীমের মোবাইল নম্বরের দুটি সিমের লোকেশন দুই জায়গা দেখা গিয়েছিল। হত্যার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, কিলিং মিশন শেষে তারা দুটি ভাগে বিভক্ত হন। একটি গ্রুপ ঘটনার দিন বিকেলেই লাশের টুকরোর দুটি ব্যাগ নিয়ে নিউ টাউনের একটি পাবলিক টয়লেটের সামনে যায়। সেখানে ব্যাগ হস্তান্তর করে। আরেকটি গ্রুপ পরদিন বাসা থেকে আরও দুটি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আর গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করতেই জড়িতরা আজীমের দুটি সিম নিয়ে দুই এলাকায় অবস্থান করেন। এ ছাড়া ১৩ মে বন্ধু গোপালের বাসা থেকে বের হওয়ার পর হোয়াটসঅ্যাপে একটি খুদে বার্তায় এমপির ফোন থেকে বলা হয়, ‘গুরুত্বপূর্ণ কাজে দিল্লিতে চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করব। তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’ ১৫ মে বেলা ১১টা ২১ মিনিট আরেকটি মেসেজে জানানো হয়, ‘আমি দিল্লি পৌঁছালাম, আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছে। ফোন করার দরকার নেই।’ এখন বেরিয়ে এসেছে, মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের দ্বিধায় ফেলতেই খুনিরা এমপির ফোন থেকে এমন বার্তা গোপাল ও তাঁর পরিচিতজনের কাছে পাঠান।

দায় চাপাতে কৌশল
হত্যায় জড়িতরা ঘটনার দায় অন্যের ওপর চাপাতে অভিনব কৌশল নিয়েছিলেন। খুনের পরপরই ঢাকায় এমন কিছু লোকজনের মোবাইলে তারা ফোন করেছিলেন, যাদের সঙ্গে এমপি আজীমের খুব একটা যোগাযোগ নেই। এলাকায় তারা এমপির বিরোধী পক্ষ হিসেবে পরিচিত। হত্যায় জড়িতরা ঢাকায় যাদের ফাঁসাতে এমন ফোন করেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম মিন্টু ও ঝিনাইদহের সাবেক এক এমপি। খুনিরা চেয়েছিলেন তারা ফোন রিসিভ করলেই বলবেন– ‘বস ফিনিশড।’ মূলত হত্যার সঙ্গে তাদের নাম জড়াতেই এমন আয়োজন।

৫ কোটি টাকার চুক্তি
গ্রেপ্তার আমানুল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, আজীমকে হত্যার জন্য শাহীনের সঙ্গে তাঁর ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়। খুনের আগে কিছু টাকা অগ্রিমও দিয়েছেন। হত্যার পর ঢাকায় এসে শাহীনের সঙ্গে দেখা করেন আমানুল্লাহ। ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরে বোনের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। আমানুল্লাহ আরও জানান, ১২ মে আজীম কলকাতা যাবেন– এটা আগে থেকেই অবহিত ছিলেন শাহীন। হত্যার প্রস্তুতি হিসেবে কলকাতায় চাপাতিও সংগ্রহ করে রাখেন। ভারতে যাওয়ার পর কৌশলে সংসদ সদস্যকে বাসায় ডেকে নেন। এর পর সিয়াম, ফয়সাল, মোস্তাফিজ ও জিহাদ মিলে চাপাতির মুখে আজীমকে জিম্মি করে। এক পর্যায়ে তারা সংসদ সদস্যকে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য কড়া ভাষায় ধমক দেয়। এ নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হলে হঠাৎ বালিশচাপা দিয়ে আজীমকে হত্যা করা হয়।

‘হানি ট্র্যাপ’
একাধিক সূত্র জানায়, শাহীনের ‘গার্লফ্রেন্ড’ সেলিস্তি রহমান সরাসরি আজীম হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত কিনা– নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেলিস্তির বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে; বাড়ি টাঙ্গাইল। কলকাতায় শাহীনের ফ্ল্যাটে যখন এমপিকে খুন করা হয়, তখন সেলিস্তি ওই কক্ষে ছিলেন না। হত্যাকাণ্ডের পর ওই কক্ষে যান সেলিস্তি। ব্লিচিং পাউডারের উৎকট গন্ধ পেয়ে তার কারণ অন্যদের কাছে জানতে চান তিনি। তখন খুনিরা তাঁকে জানায়, ফ্ল্যাটে একজন মলত্যাগ করেছে। ওই গন্ধ দূর করতে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হয়েছে। আজীমকে ওই তরুণীর মাধ্যমে ‘হানি ট্র্যাপে’ ফেলা হয়েছে কিনা, তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। গেল ১৫ মে আমানুল্লাহর সঙ্গে একই ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন সেলিস্তি।

ডিএনএ পরীক্ষা
এখনও এমপির লাশ উদ্ধার না হওয়ায় জব্দ আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয়। কলকাতার যে ফ্ল্যাটে রক্তের দাগ মিলেছে, তার সঙ্গে আজীমের স্বজনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার কথা এরই মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশকে জানানো হয়। এদিকে কলকাতায় একজন গাড়িচালক সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছে, আজীমকে গাড়িতে তোলার পর সেখানে আরও কয়েকজন ছিল।

ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা
আজীম হত্যার ঘটনায় ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা করেছে তাঁর পরিবার। এরই মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

যেভাবে খুনের সূত্র
আজীম নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই নানামুখী তথ্য সামনে আসতে থাকে। কিছুদিন ধরে এমন শঙ্কাও করা হয়– তিনি জীবিত, নাকি মৃত। তবে হত্যা মিশনে জড়িত সন্দেহভাজন একজনের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ বাংলাদেশি গোয়েন্দার হাতে আসে। ওই নম্বরটি খুব ব্যবহৃত হয়। পরে ওই খুদে বার্তা ও ফোন নম্বরের সূত্র ধরে এমন একজনের খোঁজ মেলে, যিনি কিলিং মিশনে বড় ভূমিকা রাখেন। এর পর তাঁর বিষয়টি ভারতীয় পুলিশকে জানানো হয়। ঢাকার মাঠ পর্যায়ের এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা কলকাতা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় রাখেন, যিনি আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার পর জড়িত কয়েকজনকে ভারত থেকে আনতে ভূমিকা রাখেন।

হত্যার নেপথ্যে
নারী পাচারের অভিযোগে একসময় আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন আজীম। স্বর্ণ চোরাচালানের বিরোধের জের ধরেই দেড় মাস আগে এ খুনের পরিকল্পনা করা হয়। আজীমের বিরুদ্ধে হুন্ডি কারবার, মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ভারতে অবৈধ কারবারকেন্দ্রিক কোনো বিরোধের জের ধরে এ হত্যায় আর কারা জড়িত তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ।

আমানুল্লাহ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক নেতা
হত্যা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা আমানুল্লাহ একসময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন। গণেশ ও ইমান আলীকে হত্যার দায়ে তাঁর সাজা হয়েছিল। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৯১ সালে যশোরের অভয়নগরের গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। এরপর ২০০০ সালে ইমান নামে আরেকজনকে হত্যায় দায়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন তিনি। আমানুল্লাহর গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলার দামোদরে।

লাশ উদ্ধার করতে পারেনি কলকাতা পুলিশ
এদিকে কলকাতা প্রতিনিধি শুভজিৎ পুততুন্ড জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মহাপরিদর্শক (সিআইডি) অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, আজীমের লাশ এখনও পায়নি পুলিশ। তবে কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে তারা মনে করছেন, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এটি তদন্ত করবে।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির প্রধান জানান, পূর্ব কলকাতার নিউ টাউন অঞ্চলে যে ফ্ল্যাটে আজীম উঠেছিলেন, সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরের কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার রায়ের। সন্দীপের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি। আখতারুজ্জামানই ওই ফ্ল্যাটে আজীমকে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কলকাতার নিউ টাউনের অভিজাত আবাসিক এলাকা সঞ্জীবনী গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে গতকাল তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। সেখানে কী ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, তা সুনির্দিষ্ট করে জানাননি অখিলেশ চতুর্বেদী। তিনি বলেন, পুলিশের ফরেনসিক বিভাগ তদন্ত শুরু করেছে। অগ্রগতিও হয়েছে। তবে তারা কবে বেরিয়ে গেলেন, সে বিষয়ে আমরা তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে পারছি না। এটুকু বোঝা যাচ্ছে, ১৩ মে আজীম এখানে এসেছিলেন। তবে তার আগেও এসেছিলেন কিনা, সেটা আমরা এখনও জানি না। আরেকটি সূত্র জানায়, ফ্রিজে রাখা হয় আজীমের শরীরের কিছু টুকরো। এসব ফেলে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল অন্য একটি গ্রুপের।

অনেক অভিযোগ, তবু বারবার এমপি
আনোয়ারুল আজীমকে ধরিয়ে দিতে ২০০৭ সালে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের আদালতেও তখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। এরপরও তিনি পলাতক থাকায় ২০০৮ সালে চুয়াডাঙ্গার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাঁকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা জমা দেন, তাতে তিনি নিজের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা থাকার কথা উল্লেখ করেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মামলাগুলোর কোনোটিতে খালাস, কোনোটিতে অব্যাহতি পান তিনি, সে বিষয়টিও হলফনামায় তুলে ধরেন। এখন ভারতের কলকাতায় তাঁর খুন হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপটে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এর পেছনে সীমান্তে চোরাচালান-সংক্রান্ত বিরোধের বিষয় থাকতে পারে।
আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে এমন নানা অভিযোগের মধ্যে তিনি কীভাবে তিন দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন; তাঁকে দেশের অন্যতম একটি প্রধান দল আওয়ামী লীগই–বা কীভাবে মনোনয়ন দিয়ে আসছে, এখন এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, রাজনৈতিক দলের দুর্বলতার কারণেই নানা ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ওঠার পরও একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ পান। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দলের দুর্বলতা আছে বলেই ২১টি মামলা থাকার পরও আনোয়ারুল আজীমকে বারবার মনোনয়ন দিতে হয়েছে।
আনোয়ারুল আজীমের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার বিষয়েও নানা আলোচনা ছিল। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতা আবদুল মান্নানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন আনোয়ারুল আজীম। সেই আবদুল মান্নান যখন ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন, তখন তাঁর সঙ্গে আনোয়ারুল আজীমও আওয়ামী লীগে আসেন।
তবে আনোয়ারুল আজীমকে ঘিরে যেসব প্রশ্ন উঠছে, সেগুলো আমলে নিতে চান না আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। দলটির সূত্রগুলো বলছে, আনোয়ারুল আজীম রাজনীতির নানা সিঁড়ি পার হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন। ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশোর ও খুলনার কিছু অংশ একসময় সন্ত্রাসের জনপদ ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেটা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করেছিলেন আনোয়ারুল আজীম। এটাও তাঁকে সংসদের টিকিট পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, হুন্ডি ব্যবসা, সোনা চোরাচালানসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি ছিল ২০০৮ সাল পর্যন্ত। এ কারণে তিনি ২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পাননি বলে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইন্টারপোল থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ফৌজদারি মামলার পরও কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে থাকে। সেই যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য, সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনী আইনেই অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে, সে কারণে বিভিন্ন অভিযোগ থাকার পরও আনোয়ারুল আজীমের মতো কেউ কেউ বারবার সংসদ সদস্য হয়ে আসছেন।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending