বাংলাদেশ
স্বৈরাচারের অন্যতম কারিগর বিচারপতি খায়রুল
Published
4 weeks agoon
কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক। কথা বলেন সুন্দর। চলাফেরা স্মার্ট। কিন্তু অভিযোগের আঙ্গুল তার দিকে। বলা হয়, গত এক দশকে বাংলাদেশে যে সংকট তার অন্যতম প্রধান স্থপতি প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার একটি রায়ের কারণেই ভেঙে পড়ে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা। অবশ্য এর পুরস্কারও পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে। আগস্ট ঝড়ে সে পদ অবশ্য হারিয়েছেন। পদত্যাগ করেছেন তিনি।
তবে খায়রুল হককে নিয়ে আলোচনা থামছে না। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর রায় পরিবর্তন শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি চলছে। বিভক্ত বাংলাদেশি সমাজের শীর্ষ সব আইনজীবী একটি প্রশ্নে একমত পোষণ করলেন। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা বহাল রাখার পরামর্শ দিলেন তারা। এমনকি শুনানির সময় প্রয়াত সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলে দেশে বিপর্যয় তৈরি হবে, গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল তাতে রা করলেন না। বিভক্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেল। যেখানে তিনি মুখ্য ভূমিকা রাখলেন।
তবে এখানেই থেমে থাকলেন না খায়রুল হক। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পথ খোলা রেখেছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ১৬ মাস পর যে রায় প্রকাশ করলেন সেখানে তিনি এ অংশটি রাখেননি। আপিল বিভাগের দুই জন বিচারপতি এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দৃশ্যত আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তই অনুসরণ করেছিলেন খায়রুল হক।
বিচারপতি খায়রুল হকের এ রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে এক আলোচনা সভায় এ নিয়ে কথা বলেন তিনি। বলেছিলেন, তিনি মনে করেন না অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি। পদ্ধতিগত কারণে আপিল বিভাগের রায়ে দেরি হতে পারে। তবে সেটা যৌক্তিক সময়, যেমন এক মাসের মধ্যে হতে পারে। কিছুতেই এক-দেড় বছর হতে পারে না। আর অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদেশের অংশ কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না। সেটা করতে গেলে রিভিউ আবেদন ও শুনানি হতে হবে। কিন্তু তা না করেই যদি রাতের অন্ধকারে, এক-দেড় বছর পর রায় পরিবর্তন করে ফেলেন, তাহলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ।
মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। বলেন, রায়ে এ ধরনের পরিবর্তন ফৌজদারি অপরাধ।
অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির এ প্রসঙ্গে বলেন, বিচারকদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের মূল হলো আস্থা ও বিশ্বাস। ঘোষিত রায় পরিবর্তন করা ফৌজদারি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ। এটা দণ্ডবিধির ৪০৬ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একইসঙ্গে এটি বিচারকদের আচরণবিধিরও লঙ্ঘন।
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়। পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর প্রথম নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। সেসময় সংঘাতে ব্যাপক প্রাণহানি হয় এবং সম্পদ বিনষ্ট হয়। একতরফা নির্বাচনের পরও আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নিয়েছিল। তবে সে নির্বাচন রাতের ভোট নামে পরিচিতি পায়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনও বিরোধী দলগুলো বর্জন করে।
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায় ছাড়াও একাধিক রায়, বক্তব্য, বিবৃতিতে বিচারপতি খায়রুল হকের রাজনৈতিক মতাদর্শ স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে যা কখনো দেখা যায়নি। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পরও অবশ্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়। তাকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বানানো হয়। সেখানেও তিনি পুরোদমে সরকারের প্রতি আনুগত্য বহাল রাখেন।