বাংলাদেশ
১৫ লাখ টাকার ছাগলকাণ্ড : কাস্টমস কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানের কত সম্পদ!
Published
3 months agoon
এবারের ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে মুসফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১৫ লাখ টাকা দামের একটি ছাগল কেনা সম্পর্কিত ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। একটি ছাগলের এমন অস্বাভাবিক দাম নিয়ে ব্যাপক আলোচনার এক পর্যায়ে জানা যায়, এই ইফাত কাস্টমস কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানের ছেলে। এর পরই একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল পরিমাণ টাকায় গরু-ছাগল কেনা নিয়ে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে মতিউর রহমান দাবি করেন, মুসফিকুর রহমান ইফাত তার ছেলে নন। এমনকি এই তরুণ তার পরিচিতও নয়। এই ঘটনার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
১৫ বছরে নামে-বেনামে তিনি গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। এই তালিকায় আছে পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউসের অংশীদারত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, জমি ও বিনোদন পার্ক। সন্তানদের নামে রয়েছে ডজনখানেক কোম্পানির মালিকানা।
এর আগে ক্যাডার পরিবর্তন করে বাণিজ্য ক্যাডারের ১১ ব্যাচ থেকে কাস্টমসের ১৩ ব্যাচে যোগ দিয়েছিলেন ড. মতিউর রহমান। নতুন ক্যাডারে যুক্ত হওয়ার পরই প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্পদ বাড়তে থাকে তার। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে যুগ্ম কমিশনারের দায়িত্বে থাকাকালেই মূলত শুরু হয় এই উত্থান। বর্তমানে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য হিসেবে কাস্টম ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
মতিউর রহমানের দাবি, তার বিপুল সম্পদের মূল উৎস পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ। তবে সেখানেও বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে রয়েছে কারসাজির অভিযোগ। এতদিন নানাভাবে এড়িয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘১৫ লাখ টাকার ছাগল’কাণ্ডে আলোচিত হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। অনুসন্ধানে এই কাস্টমস কর্মকর্তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের নানা তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ড. মতিউর রহমানের উত্থান মূলত ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে। পরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জায়গায় পদায়ন হয়েছে তার। সাবেক এক চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার হিসেবে। সেই সময় বিভিন্ন কোম্পানিতে ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য এনবিআর ও দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে রহস্যজনক কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দুই প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি সৈয়দ মুসফিকুর রহমান ইফাতের ছাগল কেনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। মতিউর রহমান এই তরুণকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করলেও ইফাতের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন তার পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানি এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে। আর এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন মতিউর রহমানের দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা। ইফাত মতিউর রহমানের সন্তান না হলে তার পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কীভাবে পেল—এমন প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন—সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।
মতিউর রহমানের দাবি, তার সব সম্পদ বৈধ এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে আসা মুনাফার মাধ্যমে অর্জিত। তবে অনুসন্ধানে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার নামে পুঁজিবাজার এবং এর বাইরের প্রায় ডজনখানেক কোম্পানির অংশীদারত্বের নথিপত্র এসেছে। এসব নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজীপুরের গ্লোবাল সু ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং কোম্পানিতে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার মালিকানা রয়েছে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে কৌশলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নেন মতিউর রহমান। আর গ্লোবাল ম্যাক্সের মালিকানা রয়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসকে ট্রিমস ইন্ডাস্ট্রিজে। ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান শাহজালাল ইক্যুইটিতেও মালিকানা রয়েছে তার। শুধু ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নয়, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন নামে পুঁজিবাজারের আরেক কোম্পানিতে ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ শেয়ার রয়েছে।
জানা গেছে, মতিউর রহমান বসুন্ধরার আবাসিক এলাকায় থাকেন। তার পারিবারিক মালিকানাধীন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিসও ওই এলাকায়। এ ছাড়া মতিউর রহমানের ছেলে অর্ণবের নামে অর্ণব ট্রেডিং নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া তার মেয়ের ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে ড. মতিউর রহমানের অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে তার মোবাইল ফোনে কল দিয়েও কথা বলা যায়নি।
গত বুধবার তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত তার ছেলে নয়। তার এক ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতা। এর বাইরে তার কোনো সন্তান নেই।
আলোচিত ইফাত কাস্টমস কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে বলে জানিয়েছেন তার আত্মীয় ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ছবি তিনি দেখেছেন। এটা তার মামাতো বোনের ছেলে। আর তার বাবা এনবিআর সদস্য ড. মতিউর রহমান। আর মতিউর রহমান তার বোনকে সামাজিক মর্যাদা দেন এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হয়েছেন।
মতিউর রহমান হয়তো রাগ করে ছেলেকে অস্বীকার করছেন বলে ধারণা এ সংসদ সদস্যের।
জানা গেছ, শুধু রাজধানী ঢাকা বা গাজীপুরে নয়, মতিউর রহমান অঢেল সম্পত্তি কিনেছেন শ্বশুরবাড়ি নরসিংদীতেও। তার স্ত্রী লায়লা কানিজ আগে সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। এখন চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। আর প্রভাবশালী স্বামীর প্রভাবে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন।
শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লার নামে পার্ক-রিসোর্ট থেকে শুরু করে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি-প্লট। এ ছাড়া রাজধানীর বসুন্ধরার ডি ব্লকের ৭/এ রোডের ৩৮৪ নম্বর বাড়িতে স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। বসুন্ধরার ডি ব্লকে রয়েছে ৫ কাঠায় ৭ তলা বাড়ি, যার দোতলায় মতিউর রহমান পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। এ ছাড়াও গাজীপুর সদর, খিলগাঁও মৌজায় ১০ দশমিক ৫০ শতক; ৩ দশমিক ৯০ শতক; ৭ দশমিক ৫০ শতক, ৬ শতক, ৬ শতক, ৭ শতক, ৬ শতক, ৪৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব, স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে শূন্য দশমিক ৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে। গ্লোবাল সুজ লিমিটেড কোম্পানির নামে ৭টি খতিয়ান মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ ৬০ শতাংশ। এ ছাড়াও সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১২ দশমিক ৫৮ শতক জমি রয়েছে। লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ জমি রয়েছে।
মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির নামে নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে শত বিঘা জমির ওপরে গড়ে তোলা হয়েছে লাকি পার্ক নামে আলিসান রিসোর্ট, যার বর্তমান নাম ওয়ান্ডার পার্ক। এ ছাড়াও নরসিংদীর নাগরিয়াকান্দির গোল্ডেন স্টার পার্কে রয়েছে অংশীদারত্ব। এসব পার্ক করতে গিয়ে জায়গা দখলেরও অভিযোগ রয়েছে।
এসব বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ছেলের বাবা যদি মতিউর রহমান হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অস্বীকার করে ন্যক্কারজনক কাজ করেছেন। আর সম্পদ আড়াল করার জন্য বিষয়টি হয়েছে কি না—তা খতিয়ে দেখা দরকার। সম্প্রতি যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে, তারা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ তারা দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে মতিউর রহমান শেয়ারবাজারে ব্যবসা করে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, এটা তার যুক্তি। এই যুক্তি তার আয়ের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা খতিয়ে দেখতে হবে।’