বাংলাদেশ
স্বাস্থ্যের পলাতক মিঠুর সঙ্গে ব্যবসায় বেনজীর-সাকিব
Published
9 months agoon

এবার স্বাস্থ্য খাতের বিতর্কিত ঠিকাদার পলাতক মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর সঙ্গে আলোচিত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে জড়িয়েছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও। অভিযোগ পাওয়া গেছে, কৃষকদের প্রায় ৩০ একর জমি জবরদখল করে নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ এলাকায় ‘নর্থস চিকস রংপুর লিমিটেড’ নামে এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। আর জমি দখল ও পাহারা দিতে ব্যবহার করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। জমি দখলে বাধা দেওয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক কৃষক গুলিবিদ্ধসহ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন তখন। এ কোম্পানি গড়ে তুলতে গিয়ে নিজেদের সম্পৃক্ততা আড়াল করতে এর সাতজন অংশীদারের নামে একই মোবাইল ও ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। তবে বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসায় ২২ দিন আগে প্রতিষ্ঠানটির মূল গেটে তালা মেরে পালিয়েছেন কর্মকর্তারা।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রভাবশালী মিঠুর সঙ্গে বেনজীর আহমেদ এবং সাকিব আল হাসান যুক্ত হওয়ায় তারা দুর্ভোগ পোহালেও ভয়ে মুখ খুলতে পারেননি। এখন জোর করে দখল করা জমি তারা ফেরত চান। তাদের ওপর করা অত্যাচারের বিচার দাবি করেন তারা।
আমাদের সময়ের হাতে আসা তথ্য ও নথিপত্রে দেখা গেছে, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার উত্তর চাঁদখানা এলাকার কৃষিজমিতে ‘নর্থস চিকস রংপুর লিমিটেড’ নামের কোম্পানি গড়ে তোলা হয়। পোল্ট্রি শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা কোম্পানির অংশীদার সাতজন। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান স্বাস্থ্য খাতে শতকোটি টাকা দুর্নীতি লুটপাটে জড়িত মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু। কোম্পানিতে তার শেয়ারের সংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজার। এ ছাড়া পরিচালক জগলুল হায়দার চৌধুরী, অংশীদার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ব্যবসায়ী সিদ্দিক মাহমুদ, বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের প্রত্যেকের ৫০ হাজার করে শেয়ার রয়েছে। কোম্পানির আরও একজন অংশীদার সুজানা শারমীনের রয়েছে ৫ হাজার শেয়ার। কোম্পানির ফায়ার লাইসেন্সে দেখা যায়, কোম্পানিটি যে ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে, তার মেঝের আয়তন এক লাখ ৮০ হাজার বর্গফুট।
স্থানীয়রা জানান, কোম্পানিটি ২০১৩ সালে নর্থস পোল্ট্রি লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ২০২২ সালে নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘নর্থস চিকস রংপুর লিমিটেড’। প্রতিষ্ঠাকালে ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে জমি কিনে জবরদখল করা হয়। জমি দখলের পাশাপাশি খোলা জায়গায় মুরগির বিষ্ঠা ফেলায় চরম হুমকির মুখে পড়ে পরিবেশ। গ্রামবাসী চরম দুর্ভোগে পড়েন।
আমাদের সময়ের স্থানীয় প্রতিনিধি গোপাল চন্দ্র রায়কে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার (অ্যাডমিন ও এইচআর) মো. সিরাজুল হক বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম নর্থ পোল্ট্রি। কামরুল হক মানিক তাদের প্রতিষ্ঠানের মালিক। মিঠু নামের কেউ এর সঙ্গে জড়িত নন। নর্থ চিকস রংপুর লিমিটেড তাদের প্রতিষ্ঠান নয় বলে দাবি করেন। তবে আমাদের সময়ের হাতে আসা সিরাজুল হকের প্রতিষ্ঠানের ভিজিটিং কার্ডে লেখা রয়েছে, তিনি নর্থস এগ লিমিটেড ও নর্থস চিকস রংপুর লিমিটেডের ম্যানেজার (এইচআর ও অ্যাডমিন), যা এমআই গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কামরুল হক মানিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
ইতোমধ্যে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে বিপুল জমিজমা ও সম্পদের সন্ধানের হদিস পেয়েছে দুদক। দুদক এখন পর্যন্ত বেনজীর ও তার পরিবারের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে ৬২১ বিঘা জমি, কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও ইনানী সৈকতের পাশে প্রায় তিন একর জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার, গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব এবং শেয়ার ব্যবসায় ৩টি বিও অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছে। আদালতের আদেশে এসব সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বেনজীরের দেশের বাইরের সম্পদের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে দুদক।
এদিকে, ২০২২ সালে চারটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারসাজির ঘটনায় বিএসইসির তদন্তে সাকিব আল হাসানের নাম আসে। ক্রিকেটের এই অলরাউন্ডার এর আগেও বেশ কয়েকবার বিতর্কিত হয়েছিলেন। এক জুয়াড়ির দেওয়া প্রলোভনের বিষয়টি গোপন করায় ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) তাকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল। ২০২২ সালের আগস্টে জোয়ার সাইট বেটউইনারের একটি সহযোগী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হন সাকিব আল হাসান। নানা ক্ষেত্রে বিতর্কিত হওয়ায় সাকিবকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর থেকে বাদ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বেটিং সাইটের সঙ্গে জড়িয়ে বেশ কয়েকবারই বিতর্কের মুখে পড়া সাকিব আল হাসানের পর তার বোনের নামও উঠে আসে।
জানা গেছে, মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রামের কছিরউদ্দীনের ছেলে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মিঠুর নামে-বেনামে ও আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের নামে তার কমপক্ষে ৩০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১৬ সালের ৯ মে প্রকাশিত বহুল আলোচিত পানামা পেসার্স কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশ থেকে অন্যতম অর্থ পাচারকারী হিসেবে মিঠুর নাম আসে। এক যুগ ধরে দুদক মিঠুর বিরুদ্ধে কয়েক দফা তদন্তের উদ্যোগ নিলেও কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে দুদক অনেক অনুসন্ধান করলেও মিঠু বরাবরই রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানা গেছে, ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ কমপক্ষে ৩০ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি), স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ঔষধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদপ্তর, প্রায় সব ক’টি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ঠিকাদারি করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং জেনারেল হাসপাতালগুলোতেও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে তারা।
মিঠুর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১০ মে একটি ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করে দুদক। রাজধানীর বনানী থানায় দায়ের করা মামলাটির এজাহারে বলা হয়, ৫০ কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসার পর ২০১৩ সালে মোতাজ্জেরুল ইসলামকে সম্পদবিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ জারি করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তিনি সম্পদবিবরণী জমা দেননি কিংবা সময় বাড়ানোর আবেদনও করেননি।
মিঠুর সঙ্গে হেলিকপ্টারে যান বেনজীর : স্থানীয়রা জানান, ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই ভুয়া দলিলে দখল করা জমিতে নর্থ পোল্ট্রির সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করতে গেলে চাঁদখানা ইউনিয়নের চরকবন্দ গ্রামের মানুষ বাধা দেয়। তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে পুলিশ গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ-গ্রামবাসী সংঘর্ষে তিন পুলিশ কনস্টেবলসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে হাফিজার রহমান (৫৫), আবদাল হোসেন (৫০), কানু বালা (৪০), অজিফা বেগম (৪৫), আছিয়া বেগম (৪০), ফাতেমা (৫০), নুর বানুসহ (৩৫) কয়েকজনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে পুলিশের গুলিতে আহত আবদাল হোসেনকে তখন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আহত গ্রামবাসী হাফিজার রহমান তখন জানিয়েছিলেন, তার মামাদের পৈতৃক জমিতে নর্থ পোল্ট্রি ফার্মের মালিক ভুয়া দলিল দেখিয়ে দখল ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করার সময় তারা বাধা দেয়। কিন্তু পুলিশ এসে অতর্কিত হামলা ও গুলি চালায়।
স্থানীয়রা জানান, অপকর্ম হয়েছে বেনজীর আহমেদের প্রশ্রয়ে। সাবেক এই আইজিপি একদিন হেলিকপ্টারে চড়ে মিঠুর সঙ্গে এখানে আসেন। ২৭/২৮ একর জমি প্রশাসনের সহায়তায় দখল করা হয় বেনজীর ও মিঠুর ইশারায়। তাতে ১৫-২০ দিনের মধ্যে ওয়াল তুলে দেওয়া হয়। পরে কিছু লোককে ভয় দেখিয়ে অল্প দামে রেজিস্ট্রেশন করে নেয়। ৪০/৫০ বিঘা জমি এখনো রেজিস্ট্রেশন ছাড়া তাদের দখলে আছে। এ বিষয়ে আদালতে মামলা চলছে। বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানে একটা মুরগির খামার, ফিড মিল, পুকুর করে মাছচাষ করা হয়। এরপর গত কয়েক বছরে কয়েক দফা মারামারি হয়।
নীলফামারীর চাঁদখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান জাদু গতকাল রাতে বলেন, তার ৪ ফসলি জমি দখল করা হয়েছে। অনেক কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। কারখানায় তেমন কর্মসংস্থানও হয়নি। কিছু অর্পিত জমি ছিল। ২০ বিঘার মতো। স্থানীয় কৃষকরা আবাদ করছিল। এটাই ছিল তাদের জীবিকার উপায়। অর্পিত জমি হওয়ার সুযোগ নেয় দখলকারীরা। ফার্ম নির্মাণেও নিয়মকানুন মানা হয়নি। ফলে আশপাশে পরিবেশের অনেক সমস্যা হচ্ছে। স্কুল-কলেজে লেখাপড়ায় সমস্যা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বঞ্চিত কৃষককে জমি ফেরত দিতে হবে। অথবা ন্যায্য পাওনা দিতে হবে।

ফ্যাসিবাদের উত্থান-পতন

আন্তর্জাতিক আইন: যেন শুধু ক্ষমতাবানদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার

মিশিগানে আল-আকসা সুপারমার্কেটের গ্র্যান্ড ওপেনিং সহস্রাধিক ক্রেতার ঢল

যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসী গ্রেপ্তার ৬২৭ ভাগ বেড়েছে
