Connect with us

বাংলাদেশ

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সাক্ষাৎকার: জনগণ কাজ দেখতে চায়

Published

on

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। এ ছাড়া তিনি একজন আইনজীবী ও পরিবেশবিদ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী। বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ রক্ষা এবং এ সংক্রান্ত আইন ও বাস্তবতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আপনার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী বলে মনে করেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: চ্যালেঞ্জ আগের থেকে বদলে যায় না। এবারের চ্যালেঞ্জ হলো, আগে দাবি করতাম এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এত বছর ধরে দাবি করে এসেছি, কিছু দাবি পূরণ হয়েছে। উচ্চ আদালতকে সরকার সম্মান করত।

একপর্যায়ে উচ্চ আদালতকে সরকার নিজের একটি অস্ত্র মনে করত। তখন উচ্চ আদালতের আদেশগুলো বাস্তবায়ন করেনি। আমার প্রথম কাজ হবে উচ্চ আদালতের অনেক আদেশ আছে, অনেক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে—সেগুলো বাস্তবায়ন করা। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যে আইনি উইং আছে, সেটাকে শক্তিশালী করা। আগে যে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো ছিল উন্নয়ন বনাম পরিবেশ—সেখানে আমি মনে করি, এখন একটা পরিবর্তন এসেছে। এখন পরিবেশকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা দেখেছি নদীগুলো দখল করে দূষণ করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ হবে কার্যক্রমকে সমন্বিত করা। শিল্প মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে যদি কথাটা বলতে পারি, তাহলে অনেক শক্ত হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটা সমন্বয়। শিল্প উৎপাদনকে ব্যাহত না করে কীভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, একটা কর্মপরিকল্পনা, ঐকমত্যে পৌঁছানো একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা মনে করি না এটা উতরাতে পারব না। বহু বছর এগুলো বলা হয়েছে। এখন জনগণ কাজ দেখতে চায়। জনগণ যে শুধু আমার থেকে কাজ দেখতে চায় তা নয়, জনগণ শিল্প-মালিককেও পরিবর্তিত দেখতে চায়। তাদের কাছ থেকেও সংস্কার আশা করে। আমাদের একটা নতুন অডিয়েন্সকে, নতুন প্রজন্মকে বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে। আশা করি চ্যালেঞ্জগুলো আমরা উতরাতে পারব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কর্তাব্যক্তিরা আমাকে বলেছেন, আমাদের রিসার্চ করার জন্য মাত্র ৪৫ লাখ টাকা আছে। এই যে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকা, সেটাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ। আশা করছি আমরা আগামী বছর থেকে এটাকে উত্তোলন করতে পারব।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনভূমি পুনরুদ্ধারে আপনার কৌশল কী?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রাকৃতিক বনভূমির সীমানা চিহ্নিত করা। কোনো কোনো জায়গায় বেসরকারিভাবে দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রিসোর্ট করেছে। কিন্তু রেকর্ডে এটি বনভূমি হিসেবে নিবন্ধিত না। বনভূমির সঙ্গে ভূমি প্রশাসনের একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেক বন যেটি প্রটেক্টেড বন, রিজার্ভ না—সেটা ডিসির নামে লিপিবদ্ধ থাকবে। পাশে লেখা থাকবে বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমি রেকর্ড সংশোধন বা আপডেট করার সময় ডিসি আর সেই কথাটি লেখেন না। তার বদলে ডিসির মালিকানাধীন বলে পরিচিত মহলকে তারা লিজ দিয়ে দেয়। আবার অনেক সময় কয়েক হাত বদল করে তারা বনের জমি কিনে ফেলেন। বন বিভাগ প্রথম দিকে নির্লিপ্ত থাকে। পরে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে বলে এটা তো আমার জমি। সেজন্য প্রথমে আমার সীমানা এঁকে ফেলতে হবে। তারপর যার যার সঙ্গে আমাদের বিরোধ রয়েছে, সেই বিরোধগুলো চিহ্নিত করে আমরা এগোব।
কিন্তু গাজীপুরের একটি তালিকা নিয়ে বসেছি। সেই তালিকা ধরে আমরা দখলদারি উচ্ছেদের পরিকল্পনা করি। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা দ্রুত পুনরুদ্ধারে যাচ্ছি। আরেকটা পুনরুদ্ধারের উপায় হচ্ছে বন বিভাগ নিজে নিজে জমি নিয়ে ওখানে শালবন কেটে ইউক্যালিপটাস লাগায়। অথবা দেশীয় অন্যান্য প্রজাতি লাগায়। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী, যে বনে যে গাছ লাগানোর কথা, সেই বনে সেই গাছই লাগাব। বননির্ভর জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে।

ইকো-ট্যুরিজম বনাঞ্চল ও পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: ইকো-ট্যুরিজমে আমাদের কোনো গাইডলাইন নেই। তবে তাদের সঙ্গে প্রাথমিক কথা হয়েছে। আমরা শুধু বনের ওপর নয়, বন, হাওর, রাতারগুলে যে সোয়াম ফরেস্ট রয়েছে, লক্ষ্মীর বাঁওড় আছে, সুন্দরবন আছে। এগুলো সব একসঙ্গে করে সাধারণ কিছু গাইডলাইন দেওয়া হবে। যাতে ইকো-ট্যুরিজম বা ট্যুরিজমের কারণে কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। কিন্তু বিভিন্ন দ্বীপ রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও করব। পর্যটকরা কী কাজ করতে পারবেন, কী কাজ করতে পারবেন না; এ তালিকাটা ট্যুরিজম বোর্ড, ট্যুরিজম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে করার জন্য প্রাথমিক কথা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কোন এলাকায় পড়ছে? বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনের সফলতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? জলবায়ু শরণার্থীদের জন্য সরকারের কী পরিকল্পনা আছে? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সাহায্য কতটুকু কার্যকর হচ্ছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। বাংলাদেশে বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বেশি। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ দুই ও সাত নম্বরে রয়েছে। যেভাবে করে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানি যদি নিয়ন্ত্রণে না আনে তাহলে দেখা যাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উপকূলের যে ১৯টি জেলা রয়েছে, তা সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সারা দেশে এবারের মত তাপপ্রবাহ আগে কখনো দেখিনি। নোয়াখালীর বন্যায় ফসলহানি, প্রাণহানি হলো, স্থাপনার ক্ষতি হলো। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, গবাদি পশুর ক্ষতি হলো। মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হলো।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন কাজ করতে হবে, উন্নতবিশ্ব যেমন তাদের মডেল বদলায়, তেমনিভাবে উন্নত বিশ্বকে তারা আন্তর্জাতিক আইনে বলেছে আমাদের অতিরিক্ত এবং নতুন টাকা দেবে; সেটা নিয়েও কথা বলতে হবে। লস এন্ড ডেমেজ নিয়ে একটি তহবিল হয়েছে। আমাদের নোয়াখালীর বন্যার যে অবস্থা, নোয়াখালীর বন্যাও লস এন্ড ডেমেজ রোধ করার জন্য ফান্ডের টাকা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। ওখানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা দুই লেভেলে কাজ করব। এক. তাদেরকে তাদের উন্নয়ন মডেল বদলাতে হবে। আমাদের জিম্মি করে তাদের উন্নয়ন মডেল চলতে পারে না। তারা কম কার্বন নিঃসরণ হয় এমন উন্নয়ন মডেলে যাবে। দ্বিতীয় হচ্ছে, আমাদের যে পাওনা টাকা তারা আমাদের দেবে। যাতে আমরা ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারি। উন্নত বিশ্ব আজ থেকে যদি বিধ্বংসী কাজগুলো না করে—এ যাবৎ যে কাজগুলো হয়েছে, সেগুলোর ক্ষতিগুলো পোষাতে অভিযোজনের কাজে আমাদের কারিগরি এবং আর্থিক সহায়তা চাইব। যদি উন্নত বিশ্ব আমাদের চাহিদা মোতাবেক টাকা না দেয়, যেটা আজ পর্যন্ত তারা দেয়নি, তাহলে কিন্তু আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের বন্যা সহিষ্ণু ধানের কথা, খরা সহিষ্ণু ধানের কথা ভাবতে হবে। আমাদের বিকল্প চাষাবাদের কথা ভাবতে হবে। এই কাজগুলো আমার মন্ত্রণালয় এককভাবে করবে না। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে করতে হবে। সেজন্য আমাদের ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানও রয়েছে।

প্লাস্টিক দূষণ রোধে মন্ত্রণালয়ের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটুকু কার্যকর হয়েছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্লাস্টিক দূষণ রোধ নিষিদ্ধকরণ কার্যকর করা হয়েছে। সুপার শপগুলোর কর্ণধারদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, প্লাস্টিক দূষণ রোধে ১ নভেম্বর থেকে তারা কোনো প্লাস্টিক ব্যাগ ক্রেতাদের দেবে না। মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়েও ক্রেতাদের বলা হচ্ছে, বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে আসুন। নতুবা আমাদের থেকে ব্যাগ আপনারা কিনে নেন। মানুষেরও একটা অভ্যস্ততার ব্যাপার রয়েছে। এটা নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, নিষেধাজ্ঞা ২০০২ সালের ছিল। এই নিষেধাজ্ঞা নতুন করে প্রয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে। ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারে এ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ শুরু হবে। একইভাবে পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে। প্লাস্টিক যারা উৎপাদন করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং কাঁচাবাজারের মালিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এটা কার্যকর ছিল। নিয়মিত বাজার মনিটরিং হচ্ছে। আমরাও নিয়মিত বাজার মনিটরিং করব। এই মুহূর্তে মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন। ২০০২ সালে মানুষ জানত না তার ব্রেনের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেছে। এখন কিন্তু এই কথা মানুষ জানে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্লাস্টিক দূষণ রোধে আইন হচ্ছে। অনেক দেশে যেমন মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ভারতের চেন্নাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পলিথিন ব্যাগ এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক থেকে ক্রমান্বয়ে সরে আসার কাজ শুরু হয়েছে। এটা যেহেতু আইন এটা তো প্রয়োগ করতেই হবে। ঐকমত্যে হলে খুবই ভালো নইলে আমাদের অভিযানে যেতে হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণে আইন বাস্তবায়নে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: পরিবেশ অধিদপ্তরের এক ধরনের নির্লিপ্ততা ছিল। তাদের যে সাহস দেবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবসময় সেই সাহসটা দেয়নি। বরং রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেখা গেছে, দূষণকারীর পক্ষেই কাজ করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলেও কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। আবার স্বচ্ছতারও একটার অভাব ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরে যেহেতু লোকবলের সংকট রয়েছে, সবাইকে একসঙ্গে টার্গেট না করে, সবচেয়ে বেশি দূষণকারীকে টার্গেট করে সেগুলোকে নিয়মিত মনিটরিংয়ে আনা, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা—এসব কাজ করতে হবে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান দিনের বেলা বর্জ্য ফেলবে না। কিন্তু রাতের অন্ধকারে লুকানো পাইপ দিয়ে তারা বর্জ্যটা ফেলে দেবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী যদি সজাগ থাকে, তাহলে তারা আমাদের দ্রুত সংবাদটা দিতে পারবে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে একটি নীতি—যে দূষণ করবে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। টেকসই উন্নয়ন পূর্ব সতর্কতামূলক নীতিতে এসব নীতি সন্নিবেশিত করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পরিবেশ দূষণকারীর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তালিকা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে কখন আমরা কী ব্যবস্থা নেব সেটাও আমরা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেব। জনগণ যে অভিযোগ করে তা একটি রেজিস্টারে তারিখসহ তালিকাভুক্ত করা, কত তারিখে নিষ্পত্তি হয়েছে তাও লিপিবদ্ধ করার কাজটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending