Connect with us

বাংলাদেশ

বিশ্লেষণ: হঠাৎ কোথা থেকে, কেন এলেন মেজর ডালিম

Published

on

শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত ঘাতক শরিফুল হক ডালিম সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব লাইভে যা বলেছেন তাতে হয়তো নতুন তেমন কিছু নেই। ১৯৭৫ থেকেই মুজিব বিরোধীরা এসব কথা বলে আসছেন। তবে দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর আত্মগোপনে থাকা মেজর ডালিমের [পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.)] হাঠাৎ পূনঃআত্মপ্রকাশ প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। দীর্ঘ সময় পর তাকে দেখে অনেকেই অবাক হন। কারণ তিনি জীবিত কি না, এ নিয়েই ধূম্রজাল ছিল। এবার প্রশ্ন, কোথায় আছেন মেজর ডালিম? কোন দেশ থেকে তিনি এই লাইভ অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন? নিরাপত্তার কথা বলে বিষয়টি প্রকাশ করেননি ডালিম বা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক সাংবাদিক ইলিয়াস।
তবে দেশের শীর্ষ ইংরেজি সংবাদপত্র ডেইলি স্টার ২০০৯ সালে কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা সূত্রে জানিয়েছিল, মেজর ডালিম পাকিস্তানে বসবাস করেন এবং তিনি প্রায়ই লিবিয়ার রাজধানী বেনগাজিতে যাতায়াত করেন। সূত্রটি আরো দাবি করেছিলো,

বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাবেক চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ডালিম একবার ঢাকায়ও এসেছিলেন।
এদিকে, ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে জড়িতদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। দুবছর টাস্কফোর্সের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন ওয়ালি-উর-রেহমান। সাবেক এই রাষ্ট্রদূত ডেইলি স্টারকে ওই সময় বলেন, মেজর ডালিমের কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ব্যবসা আছে। এছাড়া ডালিম কেনিয়ার পাসপোর্ট সংগ্রহ করতেও সমর্থ হয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। এই দাবির প্রেক্ষাপট হচ্ছে ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রদূত হিসাবে কেনিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন ডালিম। তার আগে, ১৯৭৬ সালে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত করার পর প্রথমে চীনে কূটনীতিক হিসাবে প্রেরণ করা হয়। ১৯৮০ সালে তিনি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে যুক্ত হন। পরে ১৯৮২ সালে হংকং দায়িত্ব পালন করেন।
নিরাপত্তাজনিত কারণে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা গত অর্ধশতাব্দী ধরে এতটাই গোপন জীবন যাপন করছেন যে, তার আত্মীয় স্বজনও জানতেন না তিনি কোন দেশে আছেন। এমনকি বেঁচে আছেন কিনা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলেন না তারা।
পর্যবেক্ষকদের মতে সাংবাদিক ইলিয়াস মেজর ডালিমের সঙ্গে নয় বরং ডালিমের পক্ষ থেকেই ইলিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো শেখ মুজিব বিরোধী সাংবাদিক বা ইউটিউবার অনেক আছে, তবে ডালিম কেন ইলিয়াস হোসেনকেই বেঁছে নিলেন?
হয়তো ইলিয়াসের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে ডালিম এবং তিনি যাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন তাদের দর্শন ও বোঝাপড়ার মিল আছে। ইলিয়াসের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তিনি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির ঘোরতর সমর্থক। তাই সেই সূত্রে জামায়াতের জন্মভিটা পাকিস্তান বা পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের তত্ত্বাবধানে মেজর ডালিম আছেন এমন দাবি অগ্রাহ্য করার মতো নয়।
তবে ৫০ বছর লুকিয়ে রাখার পর এখন হঠাৎ কেন সামনে আনা হলো তাকে? এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে তিনি লাইভে এসে কী বলেছেন, তা বিশ্লেষণ করলে। আওয়ামী লীগ আর শেখ মুজিবুর রহমান কতটা খরাপ তা তিনি স্বাভবিকভবেই নানা তথ্য ও তত্ত্ব হাজির করে বোঝাতে চেয়েছেন। কেন শেখ পরিবারকে নির্মূল করা দরকার ছিলো তাও তিনি বলেছেন। এসবের পাশাপাশি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে হাজারো সেনা হত্যাকারী হিসাবে চিত্রিত করছেন। এই বক্তব্যের মাধ্য দিয়ে তিনি জিয়াউর রহমানের জনমূখী স্বচ্ছভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করার চেষ্টা করলেন। এছাড়া বিএনপি সব সময়ই দাবি করে আসছে মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দূরতম সম্পর্কও নাই জিয়াউর রহমানের। কিন্তু ডালিম দাবি করেছেন পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে ১৫ আগষ্টের অভ্যূত্থানকারিদের সঙ্গে থাকার শপথ করেছিলেন জিয়া। এসব কথার মাধ্যমে এক কথায় বিএনপির রাজনীতির মূলে আঘাত করতে ছাড়েননি মেজর ডালিম।
তাহলে এখানে স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, অর্ধশতাব্দী পরে মেজর ডালিমের হঠাৎ আত্মপ্রকাশে লাভবান হয়েছে মূলত বর্তামানের বিএনপি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাবার মধ্যে কবর রচিত হয়েছে আওয়ামী রাজনীতিরও। এখন বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ এক সময়ের মিত্র জামায়াত।
এদিকে, সেই ইংরেজ শাসনামল ১৯৪১ সালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠা করেন মওলানা মওদুদী। কিন্তু ৮৪ বছর পেরিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছিও যেতে পারেনি পাক-ভারত উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই দলটি। তবে ৫ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সরকার ও প্রশাসনে জামায়াতের প্রভাব বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে জামায়াতে ইসলামীর লোকদের পুনর্বাসনের অভিযোগও অস্বীকার করার উপায় নেই।
এসব দিক বিবেচনায় মেজর ডালিমের এই আত্মপ্রকাশকে জামায়াতের প্রভাবের পালে আরেকটু হাওয়া দেয়ার চেষ্টা হিসাবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এছাড়া আরো দুটি কারণ প্রকাশ করেছেন আরেক জনপ্রিয় ব্লগার, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, ‘আমাকে সুইডেনের বড় ভাই, যিনি মেজর ডালিমের শিষ্য, তিনি বলেছেন মেজর ডালিমকে তো দেশে আনা দরকার। তিনি (মেজর ডালিম) অবশ্যই দেশে আসবেন। আমাদের দেশে নতুন সংবিধান লিখলে ১৫ আগস্টের বিপ্লবকে অভ্যুত্থানের মর্যাদা দেব। পিনাকী আরও বলেন, ‘আগের রায়, বিচার, সবকিছু ইনভ্যালিড হয়ে যাবে। তিনি যখনই বীরের বেশে দেশে ফিরবেন। চব্বিশের বিপ্লব যারা রচনা করেছেন, তাদের অনেকেরই আইডল ছিলেন মেজর ডালিম। অন্তত আমার তো ছিলেনই।’
বাংলাদেশে যতবার জালিম আসবে, ততবার মেজর ডালিমরা জন্মাবেন মন্তব্য করে পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, ২৪-এর বিপ্লব একটা প্রকৃত বিপ্লব হয়ে উঠবে, যদি আমরা নতুন সংবিধান লিখে মেজর ডালিমকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি। সেদিন হবে বিপ্লবের প্রকৃত বিজয়।
পিনাকী ভট্টাচার্য স্পষ্ট করেই বলেছেন ‘আমাদের দেশে নতুন সংবিধান লিখলে ১৫ আগস্টের বিপ্লবকে অভ্যুত্থানের মর্যাদা দেব’। জামায়াত ও নবগঠিত দল জাতীয় নাগরীক কমিটিসহ তাদের ঘরনার কয়েকটি দল বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান লেখার পক্ষে অন্যদিকে বিএনপি এই দাবির ঘোর বিরোধী। তাই অনেকেই মনে করছেন মেজর ডালিমের আত্মপ্রকাশের মধ্যদিয়ে সংবিধান নতুন করে লেখার দাবি জোড়ালো করার পাশাপাশি ১৫ আগস্টের হত্যাোন্ডকে অভ্যুত্থানের মর্যাদা দেয়ার দাবি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা সদস্যদের হাতে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন সেনাবাহিনীর ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন সেনা কর্মকর্তা মেজর শরিফুল হক ডালিম। যদিও পরবর্তীতে তিনি লেফটেনেন্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পান। তবে সবাই তাকে মেজর ডালিম হিসেবেই চেনেন।
১৯৪৬ সালে ঢাকায় জন্ম নেয়া শরিফুল হক ডালিম তার বাবার চাকরির সুবাদে কুমিল্লায় বড় হয়েছেন। কুমিল্লা জিলা স্কুল এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র ছিলেন। তার বাবা কুমিল্লা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ছিলেন। তারা থাকতেন কুমিল্লা শহরের অশোকতলা চৌমুহনীর ১৪৯ নম্বর দোতলা সরকারি বাড়িটিতে। শিক্ষা জীবন শেষে ডালিম ১৯৬৪ সালে প্রথমে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তিনি বিমান বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে যোগদেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তাকে সেনাবাহিনীতে পুনঃনিয়োগ করা হয় এবং লে. কর্ণেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending