ছয় মাস ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক চলছিল। তবে গত ১২ ফেব্রুয়ারি হঠাৎই বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। সেদিন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আয়নাঘর পরিদর্শনের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের বর্বরতা সামনে চলে আসে। একই দিন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা, তার প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও তার দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনাহয়। তবে সেই রিপোর্টের সুপারিশে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হোক তা তারা চায় না জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন সুপারিশ যাই করুক, গণহত্যায় জড়িত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি আবার সামনে এসেছে। এখন নতুন করে
দলটি নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। সংগঠনটির নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘জাতি সংঘের প্রতিবেদনের পর শেখ হাসিনা এখন আন্তর্জাতিভাবে স্বীকৃত সন্ত্রাসী। তার দল আওয়ামী লীগও সন্ত্রাসী দল। গণহত্যার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ রাখতে হবে।’
আর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল না হলে গভীর সংকট দেখছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তাঁর মতে, কাজটি করতে না পারলে বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। খুনের দায়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দ্রুতগতিতে তাদের নিবন্ধন বাতিলের আহবান জানান তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘তারা কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন। সিপিবি চায়, ব্যক্তির অপরাধের বিচার।’
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবির বিষয়ে বিএনপি শুরু থেকেই বলে আসছে, এই সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ, সরকার নয়। তবে, দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর তাদের অপরাধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এরপর তাদের আর রাজনীতি করার অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না।’
সরকারের উপদেষ্টাদের দিক থেকে এবিষয়ে সম্প্রতি কোন বক্তব্য পাওয় যায়নি। তবে গত ৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্রমশ ঐক্যমত তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে। তবে গত বছরের ২৮ আগষ্ট আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ইতিহাসে বর্বরতম এক ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। এই কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিগত দায় থাকতে পারে। নেতাদের সামষ্টিক দায় থাকতে পারে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে। নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে গত ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন ‘সারডা সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন। ২৭ আগস্ট সেই রিটের শুনানি হয়। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চাইবে—কেউ এটি প্রত্যাশা করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এই সরকার মনে করে, মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দল অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। পরে হাইকোর্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে করা রিটটি সরাসরি খারিজ করে দেন।
‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯’ অনুযায়ী গত বছরের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সর্বশেষ ওই আইনেই গত বছরের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এর মধ্যে নবগঠিত জাতীয় ঐক্যমত কমিশন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ শুরু করেছে। সে সংলাপেও ঘুরে ফিরে আসছে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি। তবে এবিষয়ে সরকার কোন পথ হাটবে তা পরিষ্কার সহসায়ই হওয়া যাবে না এমনটাই মনেকার হচ্ছে।