কমিউনিটি সংবাদ
মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি বিপাকে, প্রবাসী আয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বাংলাদেশ
Published
1 month agoon
বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে নিউইয়র্কে মানি এক্সচেঞ্জগুলো সময়মতো দেশে অর্থ পাঠাতে পারছে না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে ব্যাংকিং লেনদেন স্বাভাবিক করা গেছে। ইন্টারনেট সমস্যাও নেই তারপরও দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে ভোগান্তিতে পড়ছেন মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলো।
নিউইয়র্কে ব্যবসা করছে এমন বেশ কিছু মানি এক্সচেঞ্জ হাউজ নিউইয়র্ক সময়কে জানিয়েছে, গেল ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইন্টারনেট-নির্ভর সার্ভার ব্যবহার বন্ধ ছিল। ওই সময়ে প্রায় সকল যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলো রেমিট্যান্স পাঠাতে না পারায় নিরুপায় হয়ে পড়ে। এতে তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা রেমিট্যান্স না পাঠাতে পারায় দেশে কাঙ্ক্ষিত পরিমান রেমিট্যান্স যায়নি। পাশাপাশি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলো প্রতিদিনের, প্রতি সপ্তাহের, প্রতি মাসের যে টার্গেট থাকে, জুলাই মাসে সেই টার্গেট পূরণ করতে পারেনি। এতে মানি এক্সচেঞ্জগুলোর লোকসান হয়েছে। দেশও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রবাসী আয়ের দিক থেকে।
এরপর ইন্টারনেট সচল হওয়ার পর যদিও বা দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো সম্ভব হচ্ছে কিন্তু যে পরিমাণ আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। আর যেসব পরিবারের কাছে অর্থ প্রেরণ করার কথা, তা-ও যায়নি।
এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্কের স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেস সিইও মোহাম্মদ মালেক জানান, বাংলাদেশে চলমান কারফিউর কারণে ব্যাংক সীমিত আকারে চলেছিল, আবার ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ের শাখাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা অর্থ পাঠালেও তাদের পরিবার পরিজন সে অর্থ উত্তোলন করতে পারেনি চাহিদা অনুযায়ী। জানান, এখন নিউইয়র্কের বাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকাগুলো থেকে পুরোপুরিভাবে দেশে অর্থ পাঠানো যাচ্ছে, তবে ব্যাংক ডিস্ট্রিবিউশনের গতি কম থাকায় পেমেন্ট শ্লো হচ্ছে। আবার দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা থাকায় অনেকে টাকাও কম পাঠাচ্ছেন। অনেকে ভাবছেন এখন পাঠাবেন কিনা। তিনি আরো বলেন, রেমিট্যান্সে ডলারের রেটও এখন স্বাভাবিক। এক ডলার হিসাবে ১১৮ টাকা পাচ্ছেন সুবিধাভোগীরা। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে সরকারের দেয়া নগদ আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। এই রেমিট্যান্স বিশ্লেষক জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অশান্ত ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করার কারণে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটি খুবই সাময়িক। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলেই রেমিট্যান্সও আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। খুব সহসাই এ সংকট কেটে যাবে বলে আমরা আশা করি।
অন্যদিকে সানম্যান গ্লোবাল এক্সপ্রেসের সিইও এবং এবিএএসটিএর প্রেসিডেন্ট মাসুদ রানা তপন বলেন, ১৭ থেকে ২৬ জুলাই ১০ দিনে যে ব্যবসা হওয়ার কথা, এর মধ্যে আমরা ৯ দিনের ব্যবসা হারিয়েছেন তারা। জানান, প্রতিদিন কমপক্ষে এক মিলিয়ন ডলার দেশে পাঠায় তার প্রতিষ্ঠান। ১৭ থেকে ২৩ জুলাই কোনো অর্থ পাঠানো সম্ভব হয়নি। বলেন, ২৭ ও ২৮ জুলাই থেকে চালু হলেও ২৮ তারিখ মাত্র দুই লাখ ভলার পাঠিয়েছি। তার হিসাবে আন্দোলনের সময় দেশে ৭০০-৮০০ মিলিয়ন ডলার যায়নি বলেও ধারনা দেন তিনি।
তার এ ধারনার সত্যতা মেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত ঘেটেও। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ২১ থেকে ২৭ জুলাই এই সাত দিনে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় গেছে মাত্র ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর মধ্যে ১৯-২৩ জুলাই সময়ে সরকারি ছুটি ও সাধারণ ছুটির কারণে ব্যাংক বন্ধ ছিল। এ ছাড়া টানা ৫ দিন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং ১০ দিন মোবাইলে ইন্টারনেট সেবা ছিল না। পাশাপাশি গত শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ জারি রয়েছে। সব মিলিয়ে জুলাইয়ের প্রথম তিন সপ্তাহে ৪০-৫০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় জমা হয়েছে। এর মধ্যে ১-২০ জুলাই আসে ১৪২ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। সেই হিসাবে ২৭ জুলাই পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় গেছে ১৫৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলার।
মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, প্রবাসী আয় কমার পেছনে ইন্টারনেট বন্ধ থাকা কেবল নয় তার চেয়ে বেশি কাজ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গুজন ছড়ানো। অনেক প্রবাসী ইন্টারনেটে বার্তা দিয়ে দেশে বৈধ পথে না পাঠিয়ে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করায়। যারা ফেসবুক ও অন্যান্য মিডিয়ায় এ ধরনের প্রচারণা চালিয়েছে, তাদেরকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কারণ কোনো দেশে বসে অবৈধ পথে মুদ্রা প্রেরণে উৎসাহিত করা অপরাধ। তাই চাইলে আমেরিকার সরকারও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এদিকে বৈধ চ্যানেলে অর্থ না পাঠিয়ে প্রবাসীরা এখন হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, কেবল পরিবার-পরিজনদের জন্য এখান থেকে মানুষ রেমিট্যান্স পাঠায়, বিষয়টি এমন নয়। অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থাপনা তৈরিসহ বিভিন্ন কাজেই রেমিট্যান্স পাঠান। আসলে সার্বিকভাবে অনেকেই ক্ষতির সম্মুখীন। তবে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না। জুলাই মাসের কয়েক দিনের আন্দোলনে আমরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে না পেরে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর অনেকেই কিছু কিছু পাঠাচ্ছেন, তবে তা কম। এখনো অনেকেই অপেক্ষা করছেন পরিস্থিতি দেখার জন্য। বিশেষ করে, অনেকেই ভয়ে আছেন বিদেশ থেকে দেশে অর্থ পাঠানো ব্যক্তিদের তালিকা করা হয় কি না, তারা কোথায় কার কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন এগুলো মনিটর করা হবে কি না। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হলে তখন রেমিট্যান্স পাঠানোও স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।
এ বিষয়ে সোনালী এক্সচেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত সিইও নবাব হোসেন বলেন, দেশে আন্দোলন চলাকালে আমরা রেমিট্যান্স পাঠানোর লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলেও অফিস খোলা ছিল। কিছু কিছু রেমিট্যান্স গেছে। এখন আবার মানুষ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, তবে আগের মতো নয়।
প্রবাসী আয় নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা নিউইয়র্ক সময়কে বলেন, ‘রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য বিদেশে ক্যাম্পেইনসহ যা যা করা দরকার সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকার কারণে ওই সময় রেমিট্যান্স আসার গতি কমেছে। তবে যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, তাঁরা অপপ্রচারে কান দেবেন না বলে আমরা আশাবাদী।’
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রেমিট্যান্স পাঠানো হয় প্রধানত পরিবারের প্রয়োজনে। ফলে সংঘবদ্ধভাবে অনেক দিনের জন্য মানুষ রেমিট্যান্স পাঠাবে না, কিংবা হুন্ডি করবে তা বাস্তবসম্মত নয়। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে জাতিসংঘ যদি তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা নেয়, তখন বিদেশি ঋণ ও অনুদান বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকও সরে দাঁড়াতে পারে।’