Connect with us

সম্পাদকীয়

আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা অপ্রত্যাশিত পতন

Published

on

স্বৈরচারী রাষ্ট্রের কারিগর যারা

১৯৬০-এর দশকে উঠতি মধ্যবিত্তের দল ছিল আওয়ামী লীগ। তখন গ্রাম থেকে আসা ছোট চাকরিজীবী, উকিল, মোক্তার, কেরানি শ্রেণির আকাঙ্ক্ষার ধারক-বাহক হয়ে ওঠার কারণে দলটি একসময় স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়। দলটি যে তখন জনমুখী ছিল, ছয় দফার দাবি ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার স্লোগান দেখলেই তা বোঝা যায়। কিন্তু সেই দলটি কালের বিবর্তনে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল।
বিষয়টি হলো, এই যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়ে গেল , তার মূল কারণ ছিল দেশে তরুণদের উচ্চ বেকারত্ব। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব বেশি; সেই তুলনায় কম শিক্ষিত মানুষের বেকারত্ব কম। কিন্তু একই সময়ে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। বিপুলসংখ্যক তরুণ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন; তাঁদের পরিবার তরুণদের ঘিরে স্বপ্ন দেখছে, এই ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে ভালো চাকরি (মূলত সরকারি) করে পরিবারের উত্তরণ ঘটাবে।
আমাদের সমাজে প্রবাদ আছে: লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে। অর্থাৎ পড়াশোনার মাধ্যমেই একমাত্র শ্রেণি উত্তরণ সম্ভব; এই চিন্তা দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই। বাস্তবতাও কমবেশি সেরকম; যারা রাজনীতি ও দুর্বৃত্তায়ণের সঙ্গে জড়িত নন, তাঁদের কাছে শ্রেণি উত্তরণের একমাত্র হাতিয়ার হলো শিক্ষা। শিক্ষা বলতে আবার আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা; মৌলিক বা প্রাথমিক শিক্ষা এখানে বরাবরই অবহেলিত।
সমাজে যে উচ্চশিক্ষার প্রতি মানুষের একধরনের মোহ আছে, নীতিনির্ধারকদের পক্ষেও তা কখনো অবহেলা করা সম্ভব হয়নি। সে জন্য দেশে বিগত ১৫ থেকে ২০ বছরে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, যদিও ১৯৯০-এর দশকে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে মূলত সেই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল: ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সেই সঙ্গে ছিল কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন দেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে শতাধিক। দেশে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণ কর্মজগতে প্রবেশ করছেন। কিন্তু তাঁদের জন্য যথেষ্ট শোভন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অগত্যা ভরসা সেই সরকারি চাকরি; সেখানে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় তরুণেরা মনে করেছেন, এটা তাঁদের জন্য বৈষম্যমূলক।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সালের পর দেশে উচ্চশিক্ষার দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। বিপুলসংখ্যক তরুণ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে বের হচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁদের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে। এই বিকাশের সঙ্গে পরিবার, ব্যক্তি খাত ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সামর্থ্যকে মিলিয়ে ভাবতে হবে। তরুণসমাজের নতুন ভাষা, আকাঙ্ক্ষা ও দাবিকে এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, বিগত কয়েক দশকে তরুণদের জন্য পরিবার, ব্যক্তি খাত ও রাষ্ট্রের দুটি বড় ধরনের বিনিয়োগ দৃশ্যমান। প্রথমত, সামগ্রিক শিক্ষা খাত ও উচ্চশিক্ষা খাতের প্রসার (যদিও তা যথেষ্ট নয় বলেই বিশ্লেষকদের মত)।
দ্বিতীয়ত, কম্পিউটার প্রযুক্তি, বিশেষত মোবাইল প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিনিয়োগ; এটি সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। পৃথিবীর যাবতীয় তথ্য আজ তরুণদের হাতের মুঠোয়। চ্যাটজিপিটি জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াও বদলে দিচ্ছে। লাইব্রেরিতে বা ঘরে বসে মোটা মোটা বই না পড়েও অনেক বিষয়ে স্রেফ আঙুলের ক্লিকে তরুণেরা অনেক কিছু জানতে পারছেন। ফলে যতই মনে হোক না কেন জেন-জি পড়াশোনা করে না, আদতে তাঁরা যথেষ্ট চৌকস।
তরুণদের মধ্যে একধরনের স্মার্টনেস তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে গত দেড় দশকে দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে, তা এদের মধ্যেও আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে দেশজুড়ে নতুন এক অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়েছে।
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে। তরুণেরা এখন আরও বেশি করে উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকছেন। মানুষের আয় বৃদ্ধির অর্থ হলো, পরিবারের পক্ষেও এখন ছাত্রদের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার অর্থায়ন করা সম্ভব হচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এই শ্রেণির তরুণ এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছেন। অনেক পরিবার কেবল সন্তানের পড়াশোনার জন্য ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করছে।
বিআইডিএসের সেই গবেষণায় জানা যায়, ২০০০-এর প্রথম দশকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর ছাত্রসংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ১৬ লাখ; ২০২১ সালে এসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬ লাখে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এর সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়েনি। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব এই সময়ে বেড়েছে। ২০১৩ সালে যা ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ; ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল ১২ শতাংশে। বেসরকারি খাতে যথেষ্ট শোভন কর্মসংস্থান না হওয়ায় এই তরুণেরা স্বাভাবিকভাবেই লোভনীয় সরকারি চাকরির প্রতি ঝুঁকেছেন। এই শ্রেণির তরুণেরাই এবার ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন।
প্রবৃদ্ধির সঙ্গে যে গুণগত উন্নয়ন জরুরি ছিল, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে তা হয়নি। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য দরকার ছিল যথেষ্ট পরিমাণে শোভন কর্মসংস্থান; সেই সঙ্গে স্বস্তিকর জীবন। কিন্তু প্রতি পদে পদে মানুষকে যে অপশাসন ও দুর্নীতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, সমাজে বেড়েছে বৈষম্য। ভয়ংকর এক স্বজনতোষণের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এই ১৫ বছরে। বিষয়টি ঠিক দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের লেন্সে বোঝা যাবে না। ইংরেজিতে একে বলে ক্রোনিজম। এর ফল হলো, সমাজে বৈষম্য বেড়ে যাওয়া।
এই বাস্তবতায় তরুণেরা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যে আগুন এত দিন ধিকি ধিকি জ্বলেছে, এবার তা যেন দাবানল হয়ে বেরিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা হলো, সেই আগুন দেখতে না পারা। ১৯৬০–এর দশকে পারলেও এবার পারল না তারা।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending