Connect with us

সম্পাদকীয়

ভারতের লোকসভা নির্বাচন : তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি

Published

on

ভারতের লোকসভা নির্বাচন : তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি

বিশ্ব অর্থনীতির দোদুল্যমান পরিস্থিতি, যুদ্ধ ইত্যাদি ছাপিয়ে এ সপ্তাহে একটি আলোচিত ঘটনা ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন। সারা পৃথিবী বিশেষ করে এশিয়ার জন্য এটি নিঃসন্দেহে বিরাট এবং প্রভাবশালী ঘটনা। কারণ বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের পিছু হঠার এই সময়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। যেখানে সব হিসেব-নিকেশ উল্টে দিয়েছে এবারের ফলাফল। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের বিশেষ দিক হিসেবে আমরা দেখতে পাই যে, বিজেপির জোট এনডিএ দুর্বল হলেও, শক্তি ফিরে পেল ভারতের বহুদলীয় গণতন্ত্র। সেখানে এবার দল নয়, বরং জিতল গণতন্ত্র। ধর্মীয় জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে দেশকে একচেটিয়াতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার খেলাও হোঁচট খেল।
এবার জোটের ওপর ভর করতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে। কারণ ভোটযুদ্ধে বিজেপি জোট পেয়েছে ২৯৩টি ও কংগ্রেস জোট পেয়েছে ২৩৩টি আসন। ২০১৪ সালে ২৮২ আসন পেয়ে সরকার গড়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। পাঁচ বছর পর আরও এগিয়ে পেয়েছিলেন ৩০৩ আসন। সুতরাং জোট সরকার চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা মোদির নেই। টানা তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে হলে এবারই প্রথম তাঁকে জোট সরকার গঠন করতে হবে। এবং সেটিই হচ্ছে।
এবারের নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা হলো ধর্মকেন্দ্রীক রাজনীতির যে মেরুকরণ করে ইতোপূর্বে ক্ষমতার মসনদে বসেছিল বিজেপি, তা এবারে যেন পূর্নাঙ্গরূপে স্পষ্ট হয়েছে ভারতের জনগণের নিকট।
প্রায় দেড় মাস ধরে ভোটের লড়াই-জোটের লড়াই চলেছে। তীব্র গরমের মধ্যে চলেছে প্রচার ও পাল্টাপাল্টি লড়াই। আবহাওয়ার প্রভাব ভোটের হারে পড়তে পারে বলে একটা আশঙ্কাও ছিল। তবে সেই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে ভোটদানে এগিয়ে এসেছিল ভারতের জনগণ, এবার ভোট দিয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার প্রেস ব্রিফিংয়ের বক্তব্যে প্রকাশ করেন, প্রায় ৬৪.২ কোটি মানুষ এবার ভোট দিয়েছেন। এরমধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩১.২ কোটি। এটি ছিল এক অর্থে বিশ্বরের্কড। বিশ্বের এই বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের বৃহৎ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ৬৮ হাজারের বেশি মনিটরিং দল ও দেড় কোটি ভোট ও নিরাপত্তাকর্মী এবার অংশগ্রহণ করেন।
এশিয়ার সর্ববহৎ রাষ্ট্রের এই নির্বাচন বহুমাত্রিকভাবে প্রভাব রাখে তার আশপাশের অনেক দেশের ওপরে। সেই প্রভাববলয় থেকে আমরা কেউ-ই বাইরে নই। বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। সে রাজ্যেও এবারের ভোট ছিল একেবারেই তীক্ষ্ণতর ঈগলের ঠোঁটের মতো। এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, বাম দল সিপিআই(এম), ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট মিলে লড়াই ছিল একেবারে হাড্ডাহাড্ডি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের লড়াই ছিল কেবলমাত্র বিজেপি নয়, কংগ্রেস এবং বামদের বিরুদ্ধেও। একদিকে বিজেপির আক্রমন ঠেকিয়ে নিজের দলকে সুসংহত রাখা আর নিজের ভোটব্যাংককে উজ্জীবিত করে রেখে ভোটের ফল দিয়ে চমকে দিয়েছেন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতা-কর্মী এবং দলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের হাজারো অভিযোগ, তবুও ২৯ আসনে জিতে ফের প্রমাণ করলেন মমতা এককভাবে কতটা শক্ত ভিত রচনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গে। ৪২টি আসনেই প্রার্থী দিয়েছিল মমতার ঘাসফুল প্রতীক। বাংলায় তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন ২ কোটি ৭৫ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫৬১ জন ভোটার। বাংলা ছাড়া আরও ৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল তৃণমূল। তার মধ্যে কোনো আসনে জিততে পারেনি তারা। সবমিলিয়ে দেশে প্রদত্ত ভোটের ৪.৩৭ শতাংশ তৃণমূল পেয়েছে।
হিন্দুত্ববাদের কথা বলে হিন্দু-মুসলিম ভোটের ভাগাভাগিতে ওস্তাদ মোদীজি এবারে ভোটের লড়াইয়ে কি সত্যি জিতেছেন? এ প্রশ্নে প্রথমেই চোখ দিই বাংলায়। দেখি যে, এ রাজ্যে বিজেপির তিন বাঘা নেতাও নাকানি-চুবানি খেয়েছেন, হেরে গিয়েছেন বিজেপির হেভিওয়েট প্রার্থী দিলিপ ঘোষ। অথচ ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা এনডিএ জোটের প্রধান শরিক দল বিজেপি, উনিশের লোকসভা নির্বাচনে যে বিজেপি একাই পেয়েছিল ৩০৩টি আসন। সেই দলের চব্বিশের নির্বাচনে আসন কমেছে। এবার তারা পেয়েছে ২৪০টি আসন। দেশের ২৩ কোটি ৫৯ লক্ষ ৭৩ হাজার ৯৬২ জন ভোটার বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। দেশে প্রদত্ত ভোটের ৩৬.৫৬ শতাংশ পেয়েছে গেরুয়া শিবির।
যে রাজ্যে একদা লাল ঝান্ডা উড়তো সর্বদা, সেইরাজ্যে বামদের সিট আজ শূন্যে। যদিও এই নির্বাচনে বামরা রাজ্যে তাদের নতুন নেতৃত্ব প্রদর্শন করতে শুরু করেছেন। সিপিআই(এম) একদল শিক্ষিত নেতাকে প্রার্থী করেছিলেন, সঙ্গে ছিল প্রবীণ নেতারাও। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে দেশের অন্যান্য রাজ্য মিলিয়ে ৪টি আসন পেয়েছে সিপিএম। দেশজুড়ে কোটির বেশি ভোটার সিপিএম-কে সমর্থন জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে সিপিএম পেয়েছে ১ কোটি ১৩ লক্ষ ৪২ হাজার ৫৫৩ জন ভোটারের সমর্থন। দেশে প্রদত্ত ভোটের ১.৭৬ শতাংশ পেয়েছে তারা।
অন্যদিকে, দিল্লি ও পঞ্জাবে ক্ষমতায় রয়েছে আম আদমি দল। কংগ্রেস, বিজেপির মতো তারাও জাতীয় দল। কিন্তু, আবগারি দুর্নীতি মামলায় জেলবন্দি ছিলেন দলপ্রধান কেজরীবাল, শেষ মুহূর্তে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের জন্য জামিন পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, ভোটের বাক্সে তার প্রভাব তেমন পড়েনি। দেশে সবমিলিয়ে ২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩টি আসনে জয়ী হয়েছে তার আপ। আর কেজরীর দলকে ভোট দিয়েছেন ৭১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৮৮৭ জন ভোটার। তবে এবারের ভোটে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব। উত্তর প্রদেশে কার্যত ম্যাজিক দেখিয়েছেন অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি। উত্তর প্রদেশের ৮০টি আসনের মধ্যে ৬২টি আসনে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল তার দল। ৩৭টি আসনে বিজয়ী হয়েছে।
এদিকে বাংলায় এবারের ভোটে একটি আসন জিতে জোর-জবরদস্তিতে খাতা খোলা রাখা জাতীয় কংগ্রেস কতটা ভালো ফল করেছে ভারতে তা ভাবনায় ফেলবে। দেশের ১৩ কোটি ৬৮ লক্ষ ৬ হাজার ৮৯ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন কংগ্রেসকে। প্রদত্ত ভোটের নিরিখে ২১.১৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে তারা। কংগ্রেসের এই উন্নতি কারও কারও মতে যুবরাজ রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো’র ফল বলে মনে করেন। তাহলে ইন্ডিয়া জোট কিছু নয়- প্রশ্নটা টুপ করে চলে এসেছে মস্তিষ্কে। না বিষয়টি তেমন নয়, রাহুল গান্ধী মোদীজির মতো অতোটাও পোড় খাওয়া তুখোড় নন, কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লড়াকু এবং একগুঁয়ে ছিলেন না এতদিন। এবারের নির্বাচনে তাকে দেখে মনে হয়েছে- তিনি পোক্ত হচ্ছেন, রাজনীতিতে ঢুকছেন, এবারের লড়াইয়ে সম্ভবত সেইজন্য এনডিএ জোটের ওপর ভর করেই বোধ করি নরেন্দ্র দামোদর মোদীকে ক্ষমতায় বসতে হবে। তবে সেই ক্ষমতার চেয়ার যে কতদিন স্থির থাকবে তা বোঝাটা মুশকিল, কারণ- চেয়ারের চারটি পায়ার দুটি যদি হন চন্দ্রবাবু নাইডু আর বিহারের নীতিশ কুমার তবে তো সত্যি মোদি স্বস্তি পাবেন না। নীতিশ কুমার কিংবা চন্দ্রবাবু নাইডুর যে অস্থির স্বভাব ক্ষমতায় থাকতে চাওয়ার, ভালো কোনো প্রস্তাব পেলে সরকার ফেলে অন্য নৌকায় উঠবেন না এমনটা বলা যায় না। ফলে এইসকল চিন্তাকে মাথায় রেখে ইন্ডিয়া জোট যে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে, একথা নিশ্চিত বলা যায়। অন্যদিকে এনডিএ জোট জিতেও যেন দোদুল্যমান।
এখন দেখার বিষয়, যে জোট সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তা বিজেপির নেতৃত্বে হলেও তার ভবিষ্যৎ এবং রাজনৈতিক প্রভাব আগের মতো থাকে কিনা, নাকি অল্প সময়ে তা ভারতের আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের পথে গড়ায়। কারণ ভারতের মতো বিশাল দেশ, শত সমস্যা এবং বিশ্ব ভূ-রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনের আবর্তে এ ধরনের জোট সরকারের পক্ষে সন্নিবেশিত সিদ্ধান্ত নেয়া দুষ্কর হলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দারুণ প্রভাব পড়বে। আর অন্যতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ নিশ্চই আশা করবে যে, ভারতে অতীতে যেই উদার গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই উদাহরণই বহাল থাকবে। এবং বাংলাদেশের সাথে তার দ্বিপক্ষীয় স্বার্থগুলো নিষ্পন্ন করার ব্যাপারে আরও বেশি আন্তরিক হবে।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending