Connect with us

খোলামত

‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’

‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’

বৃহস্পতিবার রাতে কুমিল্লা থেকে এক সাংবাদিক বন্ধু সেখানকার মেডিকেল কলেজের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, সারি সারি গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী। শত শত মানুষের জটলা, চিৎকার। ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও কোমরে, কারও পিঠে গুলির চিহ্ন। পুরো হাসপাতালে ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। মেঝে, শয্যা, বারান্দা সর্বত্র গুলিবিদ্ধ মানুষের সারি।
রাত ১০টায় আমাদের দুই সহকর্মী ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে দেখেন, শত শত লোক ভর্তি হয়েছেন গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। কেবল চক্ষু বিভাগেই ৫০ জনকে পাওয়া গেল, গুলিতে যাঁদের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়, কুমিল্লার ঘটনা তার একটি খণ্ডচিত্র মাত্র।

২.
ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত শিক্ষার্থীদের একজন রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই ছবিতে তার খালা লিখেছেন, ‘দিস ইজ মাই ফারহান ফাইয়াজ। হি ইজ ডেড। আই ওয়ান্ট জাস্টিস।’
মৃত্যুর আগে নিজের ফেসবুকে ফারহান লিখেছিল, ‘এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে।’ ফারহান সে রকমই নিজেকে গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
কিন্তু আমরা কেউ চাইনি মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তার সম্ভাবনাময় জীবনের অবসান ঘটবে। সহপাঠীদের সঙ্গে সেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যোগ দিয়েছিল। ফিরে এল লাশ হয়ে।
শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়? তেমন যোগ্য সমাধি কই? মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো অথবা সুনীল-সাগর-জল—সবকিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!’
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকালে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে যে ২৭ জন মারা যান, তাঁদের ১১ জনই শিক্ষার্থী, ১ জন সাংবাদিক, ২ জন রিকশাচালক, ১ জন পথচারী। কোনো কোনো পত্রিকা মৃতের সংখ্যা ৩১ বলে উল্লেখ করেছে।
একটি মৃত্যু কেবল একটি জীবনের অবসান নয়। একটি পরিবারের স্বপ্নসাধ চূর্ণ হয়ে যাওয়া। আমরা যদি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের কথা বলি।
৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি একা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। বড় ভাই নিজে পড়াশোনা শেষ না করে ভাইকে পাঠিয়েছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়ে সহপাঠীদের নিয়ে তিনি মিছিল করে ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। পুলিশ যখন তাঁকে গুলি করে, তখন তিনি একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে পুলিশ সরাসরি গুলি করে। ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি ছোড়ার যে কথা পুলিশ বিভিন্ন সময় বলে, আবু সাঈদের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই তা বলা যাবে না।
সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করেছে। কিন্তু যে পুলিশ সদস্য তাঁকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি করলেন, তাঁর বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে কি? এভাবে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি করার বিধান কি আইনে আছে? সরকার যদি আবু সাঈদকে যিনি গুলি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, মানুষ তদন্ত কমিটির ওপর ভরসা রাখবে কী করে?

৩.
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মোকাবিলায় সরকার ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ইত্যাদি বাহিনী মোতায়েন করেছে। তারপরও ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নামাতে হলো কেন? তাহলে কি ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ছাড়া এসব বাহিনী মাঠে টিকতে পারত না?
বাংলাদেশের মানুষ অনেক আন্দোলন করেছে। অনেক আন্দোলন দেখেছে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার যা ঘটল, তার দ্বিতীয় নজির নেই। এক দিনে এত মানুষের প্রাণহানি আর ঘটেনি।
আমরা অতীতে দেখেছি, বড় বড় রাজনৈতিক দল হরতাল-অবরোধ পালন করত ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে। হরতালের খবর জানাতে আগের দিন শহরে মশালমিছিল করত। হরতালের দিন মোড়ে মোড়ে নেতা-কর্মীরা পিকেটিং করতেন।
কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গোটা বাংলাদেশ স্তব্ধ হয়ে গেল। গাড়ি চলল না। বাস বের হলো না। ট্রেনও থমকে গেল। একেই বলে তারুণ্যের শক্তি। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। নিকট অতীতে বাংলাদেশ এ রকম গণজাগৃতি প্রত্যক্ষ করেনি।
দুঃখের বিষয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১ জুলাই যখন আন্দোলন শুরু করে, সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা পাত্তাই দিচ্ছিলেন না। সবাই তারস্বরে আদালতের দোহাই দিতে থাকেন। তাঁদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে, এ রকম আদালত অনুগত সরকার দ্বিতীয়টি নেই।
শিক্ষার্থীরা শুরু থেকে বলে আসছিলেন, ‘আমরা আদালতে যাব না। সরকারের কাছ থেকেই সমস্যার সমাধান চাই।’ এ ছাড়া সরকারের মন্ত্রীরা শিক্ষার্থীদের এই অরাজনৈতিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা করলেন। বললেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ভেতরে তৃতীয় শক্তি ঢুকে গেছে। তাহলে তাদের উচিত ছিল তৃতীয় শক্তি ঢোকার আগেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল বা ছাত্রসংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একান্তই কোটা সংস্কারের আন্দোলন। দাবি পূরণ হলে তাঁরা ক্লাসে ফিরে যাবেন।

৪.
১৪ জুলাই পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও ক্যাম্পাসের ভেতরে সীমিত। কিন্তু যখন ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচি নেয়, তখনই সংঘাত শুরু হয়। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দিলেন, ‘আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ এভাবে কোটা ও মেধার পক্ষ–বিপক্ষ তৈরি করা হলো। এমনকি মঙ্গলবার সংঘর্ষে ছয়জন মারা যাওয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এল না। সরকারের মনোভাবটা ছিল এমন যে ধমক দিয়ে শিক্ষকদের মতো শিক্ষার্থীদেরও ঠান্ডা করা যাবে।
কিন্তু শক্তিবলে যে তারুণ্যের বিদ্রোহ দমন করা যায় না, সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা যখন বুঝলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুই দিন আগে মন্ত্রীরা আলোচনার প্রস্তাব দিলে হয়তো রাষ্ট্রকে এতটা ক্ষতি ও ধ্বংসের শিকার হতে হতো না। এত মানুষকে জীবন দিতে হতো না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে এত শক্তি প্রয়োগ করতে হতো না।
শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, ‘সরকারকেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।’ সরকারের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ৭ আগস্টের শুনানি ২১ জুলাই এগিয়ে আনা হলো। মন্ত্রীরা শিক্ষার্থীদের কাছে আলোচনার প্রস্তাব পাঠালেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ৮০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলোচনায় ৮০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রস্তাব দিলেন। শিক্ষার্থীরা তো পুরোপুরি কোটা বাতিল চাননি। তাঁরা সংস্কার চেয়েছিলেন।
মন্ত্রীদের আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষার্থীরা বলেছেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা চালিয়ে সরকারই আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে সরকার আলোচনার প্রস্তাব দেওয়ার পাশাপাশি আন্দোলন দমনে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? আরও মৃত্যু, আরও ধ্বংস। শুক্রবারও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, যদি এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজপথ থেকে সরানো না হয়, যদি হল, ক্যাম্পাস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া না হয়, যদি এখনো গুলি অব্যাহত থাকে, সেই দায় সরকারকেই নিতে হবে।
সরকার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইলে অবশ্যই শক্তি প্রয়োগের পথ পরিহার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়ে শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। ছাত্রলীগের দখলদারির অবসান ঘটাতে হবে।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending