খোলামত
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও রাজাকারের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড মানুষ ভুলে যায়নি
Published
1 month agoon
‘রাজাকার’ একটি ঘৃণ্য শব্দ। রাজাকার মানে দেশ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী একটি শক্তি। এই রাজাকারেরা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল। বাঙ্গালী জাতি পাকিস্তানের দ্বারা দীর্ঘ ২৪ বছর যখন শোষিত আর নির্যাতিত হয়েছিল তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবী উপস্থাপন করে বাঙ্গালীর স্বাধীকার ও স্বাধীনতার ঘোষনাই দিয়েছিলেন। আর সেটির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ১৮ মিনিটের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা, অসহযোগ আন্দোলন এবং শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতির কথাও বলে দিয়েছেন। পাকিস্তান সরকারকে নন্কপারেশন করার কথা বলেছেন, আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করলে পাকিস্তানী শত্রুদের প্রতিহতের ঘোষণাও তিনি দিয়েছেন। এমনকি সরকারি কর্মচারিদের অফিস থেকে বেতন ভাতা তুলে নেয়ার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কাল রাত্রিতে যখন বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঘুমন্ত বাঙ্গালীর উপর আতর্কিত আক্রমণ শুরু করে, প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, পিলখানা বিডিআর হেড কোয়াটার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাত হল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হোস্টেল সহ বিভিন্ন জায়গায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায় এবং ঐদিন রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে আটক করে পাকিস্তান কারাগারে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আর ৩ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম হানির বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশটি স্বাধীন করে। আর রাজাকারেরা সেদিন কি করেছিল, রাজাকারেরা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। রাজাকারের প্রধান গোলাম আজম পাকিস্তান গিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছিল, বাংলাদেশের সমস্ত তথ্য উপাত্ত পাকিস্তান সরকারের কাছে সরবরাহ করেছিল যাতে পাকিস্তান বর্বর সেনারা সেই তথ্যের ভিত্তিতে খুব সহজে আক্রমণ চালাতে পারে। গোলাম আজমের রাষ্ট্রদ্রোহীতার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার তার নাগরিকত্ব ও বাতিল করেছিল। আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে যারা রাজাকার ছিল তারা সরাসরি আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোপগী হিসেবে কাজ করেছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অলিগলিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পাকিস্তানীদের নিয়ে যেতেন এই কুখ্যাত রাজাকারেরা। তারা আমার দেশের মা-বোনদের পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছিল গণধর্ষণ করার জন্য।
কুখ্যাত রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী, মোজাহেদী, কাদের মোল্লা, সাকা চৌধুরী, সাঈদী সহ কুখ্যাত রাজাকারগুলির নেতৃত্বে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, বিশেষ করে হিন্দুদের ঘর বাড়িতে আগুন দিয়ে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছিল। হিন্দু রমনীদের সহ সারা দেশে নারিদের নির্বিচারে রাজাকারেরা ও পাকিস্তানী সৈন্যরা মিলে মিশে ধর্ষণ করেছিল। এই রাজাকারেরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে নিয়ে তাদের বাসায় গিয়ে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে হত্যা করেছে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের। বাংলাদেশের সেরা সন্তানদের যারা ছিলেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ যারা ছিলেন তাদের সকলকে হত্যা করেছে এই কুখ্যাত রাজাকারেরা। এই রাজাকারেরা হিংস্র জানোয়ারের চেয়ে জঘন্য ছিল। তাদের মধ্যে কোন মানবিক গুণ ছিল না। অথচ জনসম্মুখে তারা মানুষকে দেখায় তারা খুব ধার্মিক মানুষ, দাঁড়ি টুপি পড়ে ভাল মানুষ সাজার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কি কোন দিন ভুলতে পারবে তাদের অপকর্মের কাহিনী তারা এদেশের নারিদের ধর্ষণ করেছে, নির্যাতন করেছে, তাদের ধনসম্পদ লুটপাট করেছে। বাড়িঘরে আগুন দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও তাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। তাদের চলন বলন আচরণ দৃষ্টিভঙ্গী ১৯৭১ সালের মতই রয়ে গেছে। দীর্ঘ ৫৪ বছরের এই সময়ে তারা স্বৈরাচারি জিয়া ও তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার আশ্রয় প্রশ্রয়ে অনেক বেশী প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারা শিক্ষা দীক্ষা অর্জন করেছে অনেকে কিন্তু শিক্ষিত হয়নি। তাদের অপরাধ প্রবণতা কমেনি, ১৯৭১ সালের অপকর্মের জন্য তারা নিজকে অপরাধী মনে করে নিজেদের সংশোধন করেনি। অথচ তারা এদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে, এদেশে ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করেছে তবে দেশের প্রতি তাদের কোন দেশপ্রেম নেই, নেই কোন আনুগত্য। তারা এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছে, তারা চায় এদেশকে আবার পাকিস্তান বানাতে। তারা এদেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে এই দেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়। তারা এদেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার জন্য বিশ্বের দেশে জঙ্গীদের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে আন্তর্জাতিক যত জঙ্গী সংগঠন আছে ভারতে, পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে, সিরিয়াতে, মিশরে, আলজিরিয়াতে, আফ্রিকাতে, তিউনিসিয়ারসহ সব জঙ্গীদের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ২০০১ সালে বেগম জিয়ার সাথে জোট করে এই রাজাকারেরা বাংলাদেশে ক্ষমতার অংশীদার হয়, তিনজন কুখ্যাত রাজাকারকে মন্ত্রী পরিষদে স্থান দেয় খালেদা জিয়া। এই রাজাকারেরা পুরো বাংলাদেশকে জঙ্গী আস্তানা বানিয়ে ফেলেছিল। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে, মসজিদ মাদ্রাসা তৈরি করে সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় সুরসুরি দিয়ে আড়ালে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, এমনকি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেন, আইমন আল জেহেরী, মোল্লা ওমরের মত সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশে এনেছিল গোপনে। জঙ্গীরা সারা বাংলাদেশে আস্তানা গেড়ে মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছিল। রাজশাহীর বাগমাড়ায় রীতিমত আদালত বসিয়েছিল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অথবা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ধরে এনে কথিত আদালতে বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে লাশ গাছের সাথে বেঁধে রাখতো দু’পা উপরে বেঁধে শাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রাখতো। কুখ্যাত রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীকে শিল্প মন্ত্রী বানিয়েছিল বেগম জিয়া। আর সেই নিজামী একজন রাষ্ট্রের মন্ত্রী হয়ে দশ ট্রাক অস্ত্র আমদানি করেছিল। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য।
২০১১ সালে এই রাজাকারেরা বিএনপির সাথে ক্ষমতার অংশিদার হয়ে সারা বাংলাদেশে জঙ্গী আস্তানা গড়ে তোলে ৬৪ জেলায় এক সাথে বোমা ফুটিয়ে তাদের শক্তির জানান দিয়েছিল। তারা আমার দেশের আদালতে হামলা করেছিল। দুজন জজকে হত্যা করেছিল। চট্টগ্রামের আদালতে জজের এজলাসে বোমা পুতে রেখেছিল। ঢাকার রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে একে-৪৭ রাইফেল উচু করে মিছিল করেছিল। বিএনপির সহযোগিতায় আর শ্লোগান দিয়েছিল আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান। মাথায় টুপি মুখে দাঁড়ি রেখে তারা নিজেদের ধার্মিক মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে চাইলেও আসলে তারা এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি, তারা কোন আইন কানুন মানে না। তারা কোন গণতন্ত্র বিশ্বাস করে না। তারা মানবতা বিরোধী জঘন্য বর্বর। দীর্ঘ ৫৪ বছরে তারা অনেক শক্তি অর্জন করেছে। জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের মাদ্রাসা, মসজিদ, মক্তবগুলোকে তাদের প্রশিক্ষণের নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছ নিয়েছে। আজ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে যা ঘটেছে তাতে যাদের স্পষ্ট রূপ বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। তারা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে যারা তাদের সন্তান সন্ততি বংশধর তাদের রাজাকার বানিয়েছে। কোটা আন্দোলনের নামে রাজাকারের সন্তানেরা সরাসরি তাদের বাপদাদাদের উত্তরাধিকারের দাবী নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে মিছিল করেছে—আমি কে, তুমি কে রাজাকার রাজাকার। রাজাকার শ্লোগান দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানাতে চান তারা রাজাকারের সন্তান। তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। তারা কি জানেনা তাদের পূর্ব সূরি রাজাকারেরা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী করেছিল, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, আমার দেশের নারিদের ধর্ষণ করেছিল। আমার দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, সারাদেশে জঙ্গীবাদ কায়েম করেছিল, দেশে অগ্নিসংযোগ করেছিল, মানুষের ধন সম্পদ লুটপাট করেছিল। নির্যাতিতা নারিদের গনিবতের মাল বলে অবজ্ঞা করেছিল। তারা যুদ্ধাপরাধী তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয়েছে যুদ্ধাপরাধের জন্য। দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে তাদের বিচার হয়েছে, তাদের ফাঁসীতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিশ্চয় এ প্রজন্মের সন্তানেরা এসব জানে এত কিছু জানার পরও তারা কীভাবে এসব সমর্থন করে এবং নিজেদের রাজাকারের উত্তরাধিকার বলে গর্ব করে?
স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও যেহেতু তাদের চরিত্র বদল হয়নি ১৯৭১ সালের দেশ বিরোধী হত্যা, ধর্ষণ নীতি থেকে সরে আসেনি। আজ জাতি তাদের ঘৃণা করে তাদের ঘৃণ্য অপরাধের জন্য কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর কেন ওদের বংশধরদের আজও রাজাকার বলা হয়? কারণ তাদের পূর্ব সূরিরা ৫৬ বছর আগেই যে অবস্থানে ছিল ৫৪ বছর পর তাদের সন্তানেরা লেখাপড়া শিখেও তাদের পূর্ব সূরিদের অপকর্মের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় দিনে দিনে তারা নিজেদের আরও প্রবল রাষ্ট্র বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গর্ববোধ করেছেন। তারা অনেকে নিজেদের জঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, জঙ্গী প্রশিক্ষণে অত্যাধুনিক অস্ত্র চালানো, বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংসের পথে হাটছেন। অর্থাৎ দিনে দিবেন তারা রাষ্ট্র দ্রোহী সন্ত্রাসী জঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এই দেশকে জঙ্গী তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর নীল নকশা তৈরি করেছেন যার প্রথম প্রমাণ কোটা আন্দোলনের নামে গোটা বাংলাদেশকে একসাথে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অংগার বানিয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে।