উপসম্পাদকীয়
৭৯ বছর কাটল, বিশ্ব কতটা ‘হিটলারমুক্ত’ হতে পারল
Published
5 months agoon
হিটলারের শুরু করা নৃশংস যুদ্ধ থেকে বিশ্বের মুক্তি মিলেছিল ৮ মে ১৯৪৫ সালে। সেই নারকীয় যুদ্ধে নিহত হয়েছিল ৬ কোটি মানুষ। জার্মানদের তথ্য–উপাত্ত, নাম–বৃত্তান্ত সঠিকভাবে লিখে রাখার ইতিহাস রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এর ব্যত্যয় হয়নি। জার্মানি তথা ইউরোপের দখল করা অংশে প্রায় এক শ বন্দিশিবিরে কাদের ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল বা কাদের হত্যা করা হয়েছিল, তাদের নাম–তথ্য উদ্ধৃত আছে।
হিটলারের নির্মমতার শিকার শুধু ইহুদি জাতিসত্তার মানুষ নয়, তার নির্মমতার শিকার প্রগতিশীল জার্মানরাসহ নানা ধর্ম ও জাতিসত্তার মানুষ।
আর আছে নৃশংস সব প্রামাণ্য দলিল। রাজধানী বার্লিন থেকে মাত্র ৩৭ কিলোমিটার দূরে সাক্সেনহাউজেন বন্দিশিবির গেলে এখনো দেখতে পাওয়া যাবে যুদ্ধবন্দীদের স্তূপ করে রাখা চুল, গ্যাস চেম্বারে ঢোকানোর আগে শরীরের চামড়া থেকে কেটে নেওয়া সুদৃশ্য উলকি। মেরে ফেলার পর খুলে নেওয়া দাঁত। এ তো শুধু সাক্সেনহাউজেন বন্দিশিবিরে রাখা প্রমাণাদি। এই রকম নানা বন্দিশিবিরের সংলগ্ন জাদুঘরগুলোতে রয়েছে অমানবিকতার নানা নিদর্শন।
যুদ্ধের শেষ দিকে হিটলার বার্লিন গেটের দক্ষিণে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ভিলহেলম স্ট্রাসে এবং ফস স্ট্রাসের কোনায় অবস্থিত চ্যান্সেলর অফিসের পেছনে, বিশাল বাগানের নিচে ভূগর্ভস্থ বাংকারে আশ্রয় নেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, ১৯৪৫ সালের ১ মে বার্লিনের পতন ঘটাতে চেয়েছিল সোভিয়েত জেনারেল গিওরগিজ সুকোভ ও জেনারেল ইভান কুনিয়েভ। হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মিত্রশক্তির শরিকগুলোকে পিছে ফেলে তাই সর্বাগ্রে বার্লিনের পতন ঘটাতে চেয়েছিল সোভিয়েত লাল ফৌজ।
এই বীরত্বগাথায় নাম লেখাতে গিয়ে তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও ফ্যাসিবাদের হাত গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের নেতৃত্বে সোভিয়েত সেনাদল বার্লিনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলেও হিটলারের বার্লিন আত্মরক্ষার যুদ্ধকৌশল তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তবে সোভিয়েত লাল ফৌজের প্রচণ্ড চাপের মুখে নাৎসি বাহিনীর সেই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হয়, আর ১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। বার্লিন দখল করতে গিয়ে সোভিয়েত লাল ফৌজের ৭৮ হাজার সেনা প্রাণ দিয়েছিল।
যুদ্ধের শেষ দিকে হিটলার বার্লিন গেটের দক্ষিণে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ভিলহেলম স্ট্রাসে এবং ফস স্ট্রাসের কোনায় অবস্থিত চ্যান্সেলর অফিসের পেছনে, বিশাল বাগানের নিচে ভূগর্ভস্থ বাংকারে আশ্রয় নেন।
১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল বাংকারে বসে হিটলারের নারী সহকারী গেট্রাউট ইউঙ্কে রাতভর হিটলারের ব্যক্ত করা বিষয়গুলো দলিলে লিখেছিলেন। অনেক কিছু লেখার পর দলিলের শেষে হিটলার পরাজয়ের লজ্জার চেয়ে সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ইভা ব্রাউনসহ স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা এবং আত্মহত্যা শেষে তাঁদের দেহ পুড়িয়ে ফেলার কথা লিখেছিলেন। দলিল লেখা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই হিটলারের বাংকারে খবর আসে, সোভিয়েত লাল ফৌজ হিটলারের বাংকার থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরবর্তী পস্টডামার স্কোয়ার এলাকায় গোলাবর্ষণ করছে।
৩০ এপ্রিল বেলা তিনটার একটু আগে বাংকারের কর্মচারী ও ঘনিষ্ঠ পার্শ্বচরদের কাছ থেকে হিটলার বিদায় নেন। এর পরপরই বাংকারে হিটলারের বসার ঘরের সোফায় ইভা ব্রাউন বিষাক্ত ক্যাপসুল গ্রহণ করেন আর হিটলার মাথায় নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। বিশ্বজুড়ে সমাপ্তি ঘটে মনুষ্যসৃষ্ট এক পৈশাচিক অধ্যায়ের।
নির্মমতায় ভরা ভয়াবহ সেই যুদ্ধ আর বন্দিশিবিরগুলোতে নির্যাতনে সেসব স্মৃতি আজকে গেল কোথায়! যেই জার্মান জাতি দুটি বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিল বা যারা সম্মিলিতভাবে জার্মানির ফ্যাসিস্ট সরকারকে পরাজিত করেছিল, তারা আবার পরোক্ষভাবে যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে—ভিন্ন শুধু যুদ্ধের পাত্র–মিত্র ও স্থান।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ বা পূর্বে ও সাম্প্রতিককালে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসী যুদ্ধ। এসব যুদ্ধের পেছনে রয়েছে পশ্চিমাদের লম্বা হাত। সেই ১৫ শতাব্দী থেকেই যুদ্ধবিগ্রহ দেশ দখল নিয়ে আছে ইউরোপীয়রা। আচার–আচরণে সভ্যতার অবতার বলে জাহির করার চেষ্টা করলেও ইতিহাসের কাছে বারবার তাদের বীভৎস চেহারা উন্মোচিত হচ্ছে।
অতীত ইতিহাসকে পাশে ঠেলে দিয়ে ভবিষ্যতের সিঁড়ি রচনা করা যায় না। তাই ঘুরেফিরে জার্মান জাতির সেই নির্মোহ সত্য ইতিহাসকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। সে কারণেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ৭৯ বছর আগের সেই মানবতাবিরোধী বিশ্বযুদ্ধ কোনো সামান্য যুদ্ধ ছিল না।
হিটলারের বাঙ্কারটি ভরাট করে সেখানে নির্মিত হয়েছে ফ্ল্যাট বাড়ি। তবে সাইনবোর্ডে আছে বাঙ্কারটির নকশা। এই যুদ্ধ অ্যাডলফ হিটলার ও তাঁর গুটিকয় সমর্থক যুদ্ধবাজ জার্মানের কাজ ছিল না। এর পেছনে ছিল অ্যাডলফ হিটলারের বিশাল ফ্যাসিবাদী সমর্থকগোষ্ঠী।
কিন্তু অতীত ইতিহাস থেকে কী শিক্ষা নিল ইউরোপ! কী শিক্ষা নিল জার্মানি! নাৎসিবাদী চিন্তাচেতনার ভূত বারবার ফিরে আসছে জার্মান রাজনীতিতে বা ইউরোপের দেশে দেশে। হিটলারের সেই ফ্যাসিবাদী দল নেই বটে, তবে আছে তাঁর রাজনীতির নীতিকৌশলের অনুকরণীয় ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষী দলগুলো।
এই মুহূর্তে তাদের শক্ত অবস্থান হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, ডেনমার্ক আর খোদ হিটলারের দেশ জার্মানিতে। কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটি জার্মান পার্লামেন্টের নির্বাচনে ১৯১৭ সালের নির্বাচনে ৯১টি এবং ২০২১ সালের নির্বাচনে ৭৯ আসন নিয়ে জার্মান সংসদে নিজেদের ভিত্তি রচনা করে নিয়েছে। এ ছাড়া জার্মানির ১৬টি রাজ্যের ১১টি রাজ্য সংসদে তাদের অবস্থান রয়েছে। জার্মানির পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে এই কট্টরবাদী দলটির প্রতাপ ক্রমশই বেড়েই চলেছে। আগামী ৯ জুন আসন্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনী পোস্টার টাঙাতে গিয়ে ৩ মে সামাজিক গণতন্ত্র দলের একজন সংসদ সদস্য মাথিয়াস একে ও পরিবেশবাদী সবুজ দলের সদস্য কট্টরবাদীদের হাতে প্রহৃত হয়েছে আঘাত গুরুতর হওয়াতে সংসদ সদস্যকে হাসপাতালে যেতে হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি তা ঠিক। তবে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ, গাজায় মানবতাবিরোধী হামলা ইউরোপে অন্য নামে নাৎসিদের আস্ফালন ইতিহাসের শিক্ষাকে লজ্জায় ফেলেছে।
জার্মানির এআরডি টেলিভিশনের ওয়েবসাইট গত ৮ নভেম্বর ২০২৩, জানিয়েছে, গত বছর নভেম্বরের শুরুতে, জার্মানি ইসরায়েলে আগের বছরের তুলনায় প্রায় দশ গুণ পরিমাণ অর্থের অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে।
২০২২ সালে ছিল ৩২ মিলিয়ন। তা বেড়ে ২০২৩ সালে অস্ত্র যাচ্ছে ৩০৩ মিলিয়ন ইউরো অর্থমূল্যের। আবার বিপন্ন জনপদ গাজার মানুষের জন্য আকাশ থেকে লোকদেখানো মানবিক সাহায্যের প্যাকেট ফেলছে। এই লোকদেখানো ভণ্ডামি শুধু জার্মানির নয়, পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা দেখে ষাটের দশকে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক পল টমাস ম্যান বলেছিলেন, ইতিহাস ভুলে নয়, ইতিহাসের সত্যটাকে মূল্যায়ন করে ইতিহাসের পুরোনো খোলস থেকে জার্মানদের আর ইউরোপীয়দের বেরিয়ে আসার বিষয়টিই মুখ্য।
মানবিকতা আর প্রতিবেশীদের সহানুভূতি আদায় করেই জার্মান ও ইউরোপীয় জাতিগুলোকে এগোতে হবে।
ইউরোপে বা জার্মানিতে ৮ মে মুক্তি দিবস বলে পরিচিত, কিন্তু ঐতিহাসিকেরা বলছেন, এটা জার্মান জাতির মুক্তির দিন নয়। দিনটি হলো বিশ্ব মানবিকতার মুক্তির দিন। আর জার্মান জাতির আত্মোপলব্ধির দিন।