উপসম্পাদকীয়
ইব্রাহীম রাইসির মৃত্যু মুসলিম বিশ্বের অপূরণীয় ক্ষতি
Published
5 months agoon
বিশ্ব রাজনীতি যখন আধিপত্যবাদ আর অত্যাধুনিক ক্ষেপনাস্ত্র নির্ভর হয়ে মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বিশ্বের অসীম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ঠিক সেই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন তৈরি করে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন ইব্রাহীম রাইসী, আর তাতে সাড়া দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের হৃদয়ে আশার আলো জাগিয়ে তুলেছিল। ইব্রাহীম রাইসি বিবাদমান মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে এনে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরির পথে যাত্রা করেছেন আর সেটি মেনে নিতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইসরাইল। ঠিক সেই মুহূর্তে ইব্রাহীম রাইসির মৃত্যু হল। হেলিকপ্টার দূর্ঘটনায় গত ১৯ মে রোববার আজার বাইজানের সাথে সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করে ফিরে আসার সময় ইরানের পূর্ব আজার বাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজে ফেরার পথে। বলা হলো হেলিকপ্টারটি দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পতিত হয়ে বিধ্বস্ত হয়ে ভূপাতিত হয় এবং আগুন ধরে যায়। প্রেসিডেন্ট রাইসির সাথে ছিলেন তার মন্ত্রীসভার পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ আরও ৯ জন সরকারি কর্মকর্তা। সকলেই একসাথে মারা গেলেন এই মর্মান্তিক দূর্ঘটনায়।
সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হল হেলিকপ্টারটি এমন গভীর জঙ্গলে আর পাহাড়ের পাদদেশে বিধ্বস্ত হলো দূর্ঘটনার পর কোনরকম যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার করা ব্যাপারটিও ছিল খুব দূরহ, তারা কি জীবিত না মৃত ছিলেন তাও জানাযায়নি। পরে তুরস্ক থেকে ড্রোন এনেও সনাক্ত করা যায়নি। পরে ইরানী সামরিক বাহিনীর উদ্ধারকারি দল শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে সব কয়টি মৃতদেহ। দীর্ঘ ১ সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার ২৩ মে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এই বীরকে সমাহিত করা হয় তার নিজ এলাকা মাসহাদে। এখানেই তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। আর এই শহরেই ইমাম রেজা (আঃ) এর মাজার অবস্থিত। এর আগেও গত মঙ্গলবার ও বুধবার তাবরিজ, কোম ও তেহরানে কয়েক দফা জানাজা হয় আর তাতে ১০ লক্ষাধিক এর বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করে এই মহান নেতার জন্য চোখের জলে ভাসিয়ে দোয়া করেন এবং শেষ বিদায় জানায়। আর এরিমধ্যে দিয়ে মুসলিম বিশ্ব আরেক বার নেতৃত্বহীন হয়ে গেল। এখন প্রশ্ন হল ইরান যেখানে এত শক্তিশালী দেশ, যারা বিশ্বের কাছে শিক্ষায় দীক্ষায় প্রযুক্তিতে এত সমৃদ্ধ যা আমরা শুনে আসছি দীর্ঘ দিন ধরে তাহলে ইরান কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বেল ২১২ মডেলের অতি পুরাতন যেটি ১৯৭৯ সালের ইরানী বিপ্লবের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হয়েছিল, যেটি ৪৫ বছরের পুরাতন একটি হেলিকপ্টার সেই হেলিকপ্টারেই কেন প্রেসিডেন্ট উঠলেন, তার পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ ৯ জন সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে। ইরানের কাছে কি আর কোন হেলিকপ্টার ছিল না? প্রেসিডেন্টের সফরের সঙ্গী হিসেবে আরও দুটি হেলিকপ্টার ছিল বহরে সামনে পিছনে এবং হঠাৎ করে প্রেসিডেন্টের বহনকারি হেলিকপ্টারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাডার কাজ করছিল না। পরে ঐ দু’টি হেলিকপ্টার নিরাপদে অবতরণ করে। বিশ্বের রাজনীতি এবং আধিপত্য সব কিছুতেই এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে এই শক্তিধর রাষ্ট্র বলতে গেলে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো পুরোপুরি মার্কিন নিয়ন্ত্রণে, কারণ তাদের রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে মার্কিন সরকার ছাড়া কোন বিকল্প নেই। আর তাদের টিকে থাকাটাই যখন জরুরি সেখানে বিশ্বের কোন মুসলিম দেশ ধ্বংস হয়ে যাক, কেউ দখল করে নিয়ে যাক, নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করা হউক এতে রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলোর কোন মাথা ব্যাথা নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক নামক রাষ্ট্রের বিলীন করে দিয়েছিল, সেখানে ২০ লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র কোন কথা বলেনি এই বর্বরতা থামাতে পারেনি। সিরিয়াকে ধ্বংস করেছে আমেরিকা ও রাশিয়া মিলে মিশে আইএস দমনের নামে। আফগানিস্তানকে বোমা ফোটানোর কারখানা বানানো হয়েছিল কত মিলিয়ন বোমা আফগানের মাটিতে ফোটানো হয়েছিল তালেবান দমনের নামে শেষ পর্যন্ত এই তালেবানকে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে বাইডেন ফিরে আসলেন। তিউনিশিয়াতে বিপ্লব ঘটালেন যার নাম দেয়া হয়েছিল আরব বসন্ত। এরপর মিশরে বিপ্লব ঘটিয়ে বসানো হয়েছিল কট্টরপন্থী একজন ইসলামী মৌলবাদী নেতা মুসরীকে শেষ পর্যন্ত তাকেও সরিয়ে বসানো হলো সেনাপ্রধান সিসি পাত্তাকে। পাকিস্তানে তালেবান জঙ্গীদের ও ইন্দন দেয় আবার সরকারকে সহযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। এই তালেবানী জঙ্গীরা সরকারকে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল যেখানে সেখানে তালেবানী জঙ্গীরা শুধু বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে হাটে বাজারে, শপিংমলে, মসজিদে, জুমা নামাজে, জানাজায়, বিয়ে বাড়িতে এমন কোন জায়গা নেই তালেবানি জঙ্গীরা বোমা ফাটায়নি। মালালা স্কুল ছাত্রী যখন জঙ্গীদের এমন আচরণের তীব্র বিরোধীতা করেছিল। নারি শিক্ষাকে বন্ধ করে দিতে, স্কুল কলেজে নারিদের না যেতে তালেবানেরা বাঁধা প্রদান করতো সেই মুহূর্তে মালালা প্রতিবাদী হয়ে উঠলে তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করতে চেয়েছিল তালেবানী জঙ্গীরা। পরে মালালাকে ইংল্যান্ড সরকার জরুরি চিকিৎসা দিতে ইংল্যান্ড নিয়ে যান তাকে সুস্থ করে তোলেন পরে আবার এই মালালাকে নোবেল পুরস্কারও দেয়া হয়। সর্বশেষ পাকিস্তানের ইমরান খানের গদিটি কেড়ে নিল এই আমেরিকা। ক্ষমতায় বসালো বিশ্ব সেরা দূর্নীতিবাজ নেওয়াজ শরীফের ভাই শাহবাজ শরিফকে। একই চেষ্টা চলছিল বাংলাদেশে আরব বসন্তের আদলে আন্দোলন করিয়ে সরকার পরিবর্তনের সেখানে সফল হয়নি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কারণে। সে প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিত আবার লিখবো। এবার আসছি ইরান প্রসঙ্গে
সারা বিশ্বব্যাপী এত অস্থিরতা তৈরি, আধিপত্য বিস্তারের পরও আমেরিকার যখন তৃষ্ণা মিটেনা এবার শুরু করেছে নতুন যুদ্ধ গাজায়, সেখানে তারা সরাসরি যুদ্ধ না করলেও লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্ব সন্ত্রাসী ইসরাইলকে গাজা, রাফাসহ ক্রমান্বয়ে পুরো প্যালেস্টাইনকে ধ্বংস করে দিতে। গত অক্টোবর থেকে এযাবৎকাল গাজায় ৪০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে, পুরো গাজাকে বিলীন করে দিয়েছে ইসরাইলী বাহিনী তার নেতা নেতা নিহাদুর নেতৃত্বে। আমেরিকা সরাসরি অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে এই কাজটি করার জন্যই।
এমনি অবস্থায় বিশ্বের কোন মুসলমান দেশ বা তাদের নেতা আমেরিকা ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোন কথা বলছেনা এমনকি ইসরাইলকেও থামানোর কোন উদ্দ্যেগ নিচ্ছে না। বরং ইসরাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের শেখদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ইসরাইলী বিমান সৌদি আরব দুবাইতে অবতরণ করে ইসরাইলীরা দুবাইর হোটেলে থেকে রাত যাপন করে, শপিং করে, যাওয়ার সময় দুবাইর হোটেল থেকে কম্বল আর তোয়ালেও চুরি করে নিয়ে যায় কিছু বলছেনা আরব বন্ধুরা। ঠিক সেই মুহূর্তে ইরান একমাত্র দেশ গাজার মুসলমানদের রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইরান থেকে সরাসরি মিসাইল ছুড়ে মেরে বর্বর ইসরাইলীকে দমন করতে চেয়েছিলেন। ইরানের সাথে ইসরাইলী সম্পর্ক সব সময় বৈরি। ইরানকে ভীষণ
ভয় পায় ইসরায়েল। যার ফলে ইসরাইলকে নিরাপদ রাখতে মাার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সেনাপ্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানীকে খুন করেছে। তার আগেও আরও ৬ জন ইরানী জেনারেলকে খুন করানো হয়েছে ইসরাইলকে দিয়ে। মার্কিন বর্বরতা আর ইসরাইলী বর্বরতার জবাব দিতে ইরান একমাত্র দেশ যে নিজকে সম্পূর্ণ তৈরি করে রেখেছিল ঠিক সেই মুহূর্তে ইরানী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টারে দূর্ঘটনায় মারা গেলেন। তবে এটি কি নিছক দূর্ঘটনা নাকি ইসরাইলী মিসাইল দিয়ে হেলিকপ্টার ভূপাতিত করা হল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন এই মুহূর্তে ইউরোপের কয়েকটি দেশ যখন প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার কথা বলেছেন তখন বাইডেন বেজাই রাগ করেছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন ইসরাইলকে নিরাপদ রেখে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার কথা ভাবতে হবে।
ইসরাইল অনিরাপদ হলে কোনদিন আমেরিকা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা মেনে নেবে না। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে আমেরিকা তার সন্ত্রাসী রূপ অব্যাহত রেখেছে। এমন বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ যার সাহস ও দৃঢ়তা ছিল ইসরাইলীর মত সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার। তাকে হত্যার মাধ্যমে ইরানের সাহসী পথচলাকে থামিয়ে দেয়া হল। মুসলিম জাতিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঠেলে দেয়া হল।