Connect with us

উপসম্পাদকীয়

রাশিয়া, ইরান যেভাবে নিষেধাজ্ঞাকে হাস্যকর বানিয়ে ছাড়ছে

রাশিয়া, ইরান যেভাবে নিষেধাজ্ঞাকে হাস্যকর বানিয়ে ছাড়ছে

কাগজে-কলমে দেখতে গেলে ইরান ও রাশিয়া পাহাড়সম নিষেধাজ্ঞার চাপে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে উচ্ছন্নে যাওয়া রাষ্ট্রগুলো তাদের বিরুদ্ধে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সপাটে ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছে, যা থেকে যে প্রশ্ন সামনে চলে আসে, তা হলো, পশ্চিমা নেতারা কি তাঁদের নিজেদের নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিজেরা মনোযোগী কি না।
বাইডেন প্রশাসন বলছে ইরানের ওপর তারা ‘চরমমাত্রার নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করেছে, যাতে দেশটির জ্বালানি খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্যই বলছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ইরানের জ্বালানি তেল বিক্রি এতটাই বেড়েছে, সেটা ১৭ বিলিয়ন থেকে ৫৪ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ইরানের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিতে লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের বড় দুটি ব্যাংকে ব্যবহার করেছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের আরেক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ইরানের তেল পাচারের সঙ্গে যুক্ত তেলবাহী ট্যাংকারগুলো কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিমার আওতায় আনতে সফল হয়েছিল। এই তেলবাহী ট্যাংকারগুলো সেই সব ‘ভৌতিক নৌবহরের’ অংশ যেগুলো অবৈধভাবে ইরানের জ্বালানি পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন দেশের এ রকম নৌবহরের সংখ্যা প্রায় ৪৫০।
২০২২-২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগে ধীরে চলো নীতিতে চলে। তার কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল ইরানকে তারা ব্যর্থ হয়ে যাওয়া পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরিয়ে আনতে পারবে। সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বোকার মতো পাঁচজন মার্কিন জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে ইরানের জব্দ করে রাখা ৬ বিলিয়ন ডলার মুক্ত করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ভয় পেয়েছিল, ইরান চীনের কাছে অবৈধভাবে তেল বিক্রি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাতে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাবে। সেটা হলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা ও জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ইরান প্রতিবছর আঞ্চলিক প্রক্সিদের কাছে শত শত মিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়ার কাছে তাদের শাহেদ-১৩৬ ড্রোন পাঠাতে সক্ষম হচ্ছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অগ্রগতিকে রুখে দিতে পারেনি। সম্প্রতি ইরান তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় অগ্রসর প্রযুক্তির সেন্ট্রিফিউজার ব্যবহার করতে শুরু করেছে। মনে করা হচ্ছে, খুব শিগগিরই ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি হবে।
রাশিয়ার ওপর বর্তমানে সবচেয়ে ভারী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের তুলনায় বেশি হয়েছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, তুরস্ক ও আরব আমিরাত হয়ে সেমি কন্ডাক্টর, অগ্রসর প্রযুক্তি ও বিলাসবহুল পণ্য রাশিয়ার বাজার সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পর কিরগিজস্তানে জার্মান যানবাহনের রপ্তানি বেড়েছে ৫ হাজার শতাংশ। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ইউক্রেনে রাশিয়া যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করছে, সেখানে ৪৫০ ধরনের বিদেশি উপাদান রয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ান পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমা ভোক্তাদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যায় ও মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। আর মস্কোর কর্তাদের মুখে হাসি চওড়া হতে থাকে, কেননা তাঁরা অন্য দেশগুলোর কাছে তেল-গ্যাস বিক্রি বাড়িয়ে রমরমা মুনাফা করতে শুরু করেন। চীন রাশিয়ার তেল-গ্যাসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা আগে থেকেই ছিল। আর এ সময়কালে সামরিক ও বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হয় এমন চীনা প্রযুক্তিপণ্যের রপ্তানি রাশিয়ায় বাড়তেই থাকে। ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরের মধ্যে রাশিয়ায় চীনের যানবাহন বিক্রি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে এবং ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছে।
যাহোক, রাশিয়ার রক্তপিপাসু যুদ্ধ যন্ত্রের চীন যে রসদ জুগিয়ে যাচ্ছে, তা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বলার ক্ষমতা সীমিত, কেননা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করে চলেছে, তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে নিষেধাজ্ঞা, সেটাও হাস্যকরভাবে তাদের আরেকটা ভুল সমস্যার ভুল অস্ত্র প্রয়োগের নমুনা।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা চীন, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করেছে। এসব দেশ তাদের কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমন একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছে, যাদের পশ্চিমা বাজারে একেবারেই যেতে হচ্ছে না। ডলার বাদ দিয়েই তারা বাণিজ্য করতে পারছে। ২০২১ সালে সম্পাদিত সহযোগিতা চুক্তির আওতায় সম্প্রতি ইরান ও চীন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
গত ২০ বছরে বেশ কয়েকটি বিকল্প কূটনৈতিক পথ থেকে পশ্চিমা দেশগুলো সরে এসেছে। অথচ এসব হাতিয়ার বিদেশে তাদের প্রভাব তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গরিব দেশগুলোর জন্য পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। অথচ এ সময়ে বিশ্বে ব্যর্থ রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়েছে আর ২০১২ সালে থেকে এ পর্যন্ত ১২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে তার মিত্র ইসরায়েলকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের ভূমি দখল করেই চলেছে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ইরানের পারমাণবিক হুমকি, সুদান সংঘাত কিংবা চলমান অন্যান্য বৈশ্বিক সংকটে দৃষ্টি দেওয়ার মতো মানসিকতা কমই আছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম জাহাজ চলাচলের পথে হুতি মিলিশিয়াদের বেপরোয়া হামলা থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনী। এটা বিশ্বজুড়ে তাদের অসহায়তা ও অক্ষমতার একবারে নিখাদ দৃষ্টান্ত।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending