Connect with us

সুস্বাস্থ্য

ইয়োগা বা যোগব্যায়াম নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর

Published

on

ইয়োগা বা যোগব্যায়াম নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর

ইয়োগা প্রশিক্ষকদের মুখে একটি কথা সবসময় শোনা যায় – ইয়োগা কেবল ব্যায়াম না, এটি সাধনা। সাধারণ দৃষ্টিতে ইয়োগাকে শারীরিক ব্যায়াম বা কসরত মনে হলেও বিষয়টি প্রকৃত অর্থে সে রকম নয়। এর সাথে মানসিক যোগসূত্র প্রবল বলে মনে করেন ইয়োগা প্রশিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা। এই বক্তব্যের পেছনে তাদের যুক্তি হল, ব্যায়াম মানে মোটাদাগে শরীরচর্চাকেই বোঝায়। কিন্তু ইয়োগা শুধু শরীর না, মনকেও স্থির করতে সাহায্য করে। সেই সাথে, নিয়মিত ইয়োগা মানুষক বিভিন্ন রোগ থেকে আরোগ্য পেতেও সহায়তা করে। এই ইয়োগা নিয়ে অনেকের কৌতুহল রয়েছে। তারা বুঝতে চান, ইয়োগা আসলে কী? জিমনেশিয়ামে ব্যায়াম করা ও ইয়োগার মাঝে মৌলিক পার্থক্য কোথায়? কিংবা ইয়োগা করলে আসলেই ওজন কমে কিনা।

ইয়োগা আসলে কী?
‘ইয়োগা’ মূলত সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় যার অর্থ ‘যোগ’, এর অর্থ সমন্বয় সাধন করা বা গ্রন্থিভুক্ত করা। কিন্তু কিসের সমন্বয় সাধন? বাংলাদেশি লেখক রণদীপম বসু তার ‘ইয়োগা সুস্থতায় যোগচর্চা’ বইতে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে— দেহযন্ত্রগুলোর কর্মক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে স্নায়ুতন্ত্রের পূর্ণ পরিচর্যার মাধ্যমে মনোদৈহিক সম্পর্কসূত্রগুলোকে প্রকৃতিগতভাবেই একাত্ম করাই হল সমন্বয় সাধন। এই পুরো বিষয়টিকে যদি আরও সহজভাবে বলি, তাহলে যা দাঁড়ায়— ব্যক্তির মন ও শরীরকে শরীরচর্চার মাধ্যমে একসূত্রে গাঁথা বা যুক্ত করাকেই বলে যোগ বা ইয়োগা।

ইয়োগা করে কী কী লাভ হয়?
ইয়োগা প্রশিক্ষকরা বলে থাকেন, ইয়োগা করলে নানা ধরনের রোগ-বালাই থেকে নিরাপদ থাকা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ড. পুনম খেত্রাপাল সিং-এর ডব্লিউএইচও-তে প্রকাশিত একটি নিবন্ধেও এ বিষয়টির উল্লেখ আছে। তিনি লেখেন, “ইয়োগা অনুশীলন করলে দেহ ও মন, এমনকি মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে এক ধরনের সংযোগ স্থাপিত হয়। এটি মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা অর্জনে সাহায্য করে।” বাংলাদেশি ইয়োগা প্রশিক্ষক নায়লা বাশার জানান, ইয়োগা করলে হজমশক্তি বাড়ে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করে তোলে। “দেহের সব অংশে এটি কার্যকর। তবে কেউ যদি মনে করে, আজকেই ইয়োগা করে সব এচিভ করে ফেলবো, কিচ্ছু হবে না। কারণ এটা সাধনার ব্যাপার,” তিনি বলেন। তার মতে, কেউ যদি ধৈর্য ধরে এবং মন থেকে নিয়মিত ইয়োগা অনুশীলন করেন, তাহলে তাদেরকে বিষন্নতা ততটা ছুঁতে পারে না। সেইসাথে, শরীরের বিভিন্ন ব্যথারও উপশম করা সম্ভব। বাংলাদেশের আরেক ইয়োগা প্রশিক্ষক আনিকা রাব্বানিও একই কথা বলেন। তার ভাষায়, “আমাদের দেহ একটা মেশিনের মতো। তাকে মুভমেন্টের মাঝে রাখলে সে ভালো থাকে।” এক্ষেত্রে তারা দু’জনই বিশেষভাবে নারী স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। নায়লা বাশার বলেন, “মেনোপজ শুরু হলে অনেক অসুবিধা শুরু হয়, যা ছেলেরা বুঝে না। আমরা মনে করি, আমি মনে হয় বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আর হয়তো কোনোদিন আমায় আমার হাজব্যান্ডের সাথে ভালো লাগবে না। আমি বাইরে যেতে পারবো না। তখন ঘুম আসে, শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে দেই।” কিন্তু নিয়মিত ইয়োগা অনুশীলনে সেটি অনেকাংশেই কেটে যায় ও রাগ নিয়ন্ত্রণে থাকে, তিনি জানান। এর বাইরে অনেক নারীই আছেন, যারা পিরিয়ডের সমস্যায় ভুগেন। এ বিষয়ে এই প্রশিক্ষকের বক্তব্য, “একটু ধৈর্য্য ধরে আসনগুলো করলে পিরিয়ডের সমস্যাগুলো ঠিক হয়ে যায়, ঔষধ ছাড়াই।” এর বাইরে নিয়মিত এই চর্চার সাথে জীবন-যাপন করলে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুসসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গের কর্মক্ষমতা বাড়ে। মোট কথা, “শরীরের ইমিউন সিস্টেম অনেক স্ট্রং থাকে,” বলেন মিজ রাব্বানি।

ইয়োগা ও জিমের মাঝে প্রধান পার্থক্য কী?
আমাদের চারপাশের অনেকে ধারণা, ইয়োগা ও জিম পরস্পরের প্রতিপক্ষ। কিন্তু বিষয়টি আদতে তেমন? ইয়োগা প্রশিক্ষকদের মতে, একদমই না। বরং, এই দু’টোকেই পাশাপাশি করার পরামর্শ দেন তারা। তবে ইয়োগা ও জিমের কিছু সুবিধা-অসুবিধা আছে। জিম করলে দ্রুত ওজন ঝরিয়ে ফেলা যায়। “কিন্তু জিম আপনার শরীরকে যত তাড়াতাড়ি কমাবে, তত তাড়াতাড়ি ফ্যাটও করবে। ইয়োগা ছেড়ে দিলে মোটা হয় না,” বলেন মিজ বাশার।
জিমের পাশাপাশি ইয়োগাও করা উচিৎ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইগোয়া মনের শান্তি আনে এবং “ফিটনেস ও গ্লোয়িং ফেইস” ধরে রাখতে সাহায্য করে। তবে মিজ রাব্বানি বলেন, “জিম ও ইয়োগা, দু’টোই শরীরের জন্য ভালো। কারণ একটি জিনিস করতে করতে শরীর অভ্যস্ত হয়ে যায়। শরীর সাড়া দেয় না।”
“নারীদের বয়স চল্লিশের বেশি হলে মাংসপেশী ক্ষয় হওয়া শুরু হয়। মেনোপজে গেলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় এবং আরও বেশি ‘মাসল লস হয়’। সেজন্য মেয়েদের জন্য জিম করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে আমাদের হাড় মজবুত থাকে,” তিনি যোগ করেন। তবে জিমের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা আছে। অনেকে আছেন, যারা হার্টের রোগী। তাদের জন্য জিমের ভারী ব্যায়াম করাটা হিতে বিপরীত হতে পারে। “সেজন্য সবার জন্য জিম না। জিমে লাফালাফি করতে গেলে হার্টে চাপ দেয়। কিন্তু ইয়োগা একটু ধীর, স্থির গতি মেনে করা হয় বলে এটা তাদের জন্য ভালো,” বলেন মিজ বাশার।

ইয়োগা করলে ওজন কমে?
ওজন কমানোর উপায় জানা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই এবং অনেকে মনে করেন, ইয়োগা অনুশীলন করে ওজন কমানো যায় না। তবে বাস্তবে এই ধারণা সঠিক নয়। ইয়োগা প্রশিক্ষক আনিকা রাব্বানি বলেন, “ইয়োগা করে ওজন কমানো যাবে। কিন্তু একটা বার্গার, এক বাটি পোলাও খেতে পারবেন না।” “বেশি খেলে ওজন কমবে না, পাঁচ ঘণ্টা ব্যায়াম করলেও না। সেক্ষেত্রে জিম নাকি ইয়োগা, সেটার ওপর এটি নির্ভর করবে না। ওজন কমানো নির্ভর করে ৭০% ডায়েট, ৩০% ব্যায়ামের ওপর,” তিনি বলেন।
এ বিষয়ে নায়লা বাশারও বলেন যে “বাইরে পোলাও খেয়ে যদি বলে ওজন কমছে না, তাহলে লাভ নাই। ইয়োগার জন্য শ্রম দিতে হয়, ইয়োগা জিমের থেকে টাফ।” তিনি মনে করেন, কেউ যদি ইয়োগা অনুশীলনের মাধ্যমে ওজন কমাতে চায়, তাহলে তাকে অন্তত ছয় মাসের লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে এবং সেক্ষেত্রে সুষম ও পরিমাণমাফিক খাবার খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ইয়োগা’র জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ?
অনেকে সময়ের অভাবে বা টাকার কথা বিবেচনা করে ইয়োগাশালায় গিয়ে ইয়োগা করেন না। তারা হয় ইউটিউব দেখে দেখে একা একা ইয়োগা করেন। অথবা, অনলাইনে কোনও ইয়োগা সেন্টারের সাথে জুমে সেশন করেন। কিন্তু এর কোনোটাতেই খুব বেশি মাত্রায় উপকার হয় না। ইয়োগা প্রশিক্ষকরা বলেন, ইয়োগা আসলে গুরুমুখী শিক্ষা। অনেকটা ঐ নাচ শেখার মতো। একবার আয়ত্বে এসে গেলে একা একা ঘরে বসে অনুশীলন করা যায়। ইয়োগাকে আনিকা রাব্বানি বলেন, “ইয়োগা গুরু-শিষ্য পরম্পরা।”
“একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধায়নে থেকে ইয়োগা শেখা উচিৎ। নিজে নিজে ইউটিউব দেখে ইয়োগা শেখা হয় না। আমি আমার জুমের শিক্ষার্থীদের বলি, ইয়োগা শেখা হচ্ছে না,” তিনি যোগ করেন। “আমি এনাটমি শিখেছি। ফিমেল পেলভিস যে কতটা জটিল, সেটাও শিখেছি। এগুলো যদি ঠিকভাবে না বুঝে, তাহলে সমস্যা হয়।”
তিনি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, “একজন গর্ভবতী নারী যদি প্রশিক্ষকের কাছে না গিয়ে নিজে নিজে ইউটিউব দেখে ইয়োগা করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে সবসময় একটা ঝুঁকি থেকে যায়।” “স্কুলে না গিয়ে পড়াশুনা করা যায়? হয়তো করে অনেকে। কিন্তু স্কুলের মতো ইয়োগাশালাতে গিয়ে ইয়োগা শেখাটা পুরোপুরি ভিন্ন।”

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending