দৃষ্টিশক্তির নানারকম সমস্যা রয়েছে অনেকেরই। এরকমই একটি সমস্যা অস্পষ্ট দেখা বা ব্লারি ভিশন। চোখের সামনের স্বচ্ছ অংশ কর্নিয়া প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলে এমনটা হতে পারে। তিনজন মানুষের এ সমস্যার সমাধান করা হয়েছে স্টেম কোষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে।
এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়েছে জাপানে। এর মাধ্যমে ইতিহাসে প্রথমবার স্টেম কোষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সমাধান হলো দৃষ্টিশক্তি সমস্যার। এটিকে স্টেম কোষ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিলেন মোট চারজন। প্রায় দুই বছর আগে অপারেশন করে স্টেম কোষ প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল এই রোগীদের চোখে। এর মধ্যে তিনজন পুরোপুরি হারানো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন। আরেকজন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেও প্রায় ৭ মাস পর তাঁর সমস্যাটি আবারও ফিরে আসে। তবে পুরোপুরি সেরে ওঠা তিনজনের চোখে এতদিনেও কোনো ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা সমস্যা দেখা যায়নি।
চারজনের প্রত্যেকের চোখের কর্নিয়ায় লিম্বাল স্টেম সেল ডেফিশিয়েন্সি বা এলএসসিডি নামের একটি সমস্যা ছিল। এ সমস্যা হলে কর্নিয়ার স্টেম কোষগুলো আর নতুন কোষ তৈরি করতে পারে না। এদিকে কর্নিয়ার কিছু কোষ মারা যেতে থাকে। এই মৃত কোষগুলো জমতে থাকে কর্নিয়ায়। এই দুইয়ে মিলে দৃষ্টিশক্তি অস্পষ্ট বা ঝাপসা হয়ে যায়। এ সমস্যার সমাধান হিসেবেই স্টেম কোষ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ফলে সেগুলো কর্নিয়ার ক্ষতি সারিয়ে তুলেছে। বিষয়টা সহজে বুঝতে কর্নিয়াকে জানালার কাচের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। এর কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দাগ পড়ে গেছে—এই হলো সমস্যাটি। সক্রিয় স্টেম কোষ এ ক্ষেত্রে ঠিক ওয়াইপারের মতো কাজ করে—দাগ পরিষ্কার করে ফেলে, ক্ষতিগ্রস্ত কাচকে জুড়ে দেয়, ফলে নতুনের মতো হয়ে ওঠে জানালার কাচ।
এই যে বারবার স্টেম কোষ বলছি, এই স্টেম কোষ আসলে কী? স্টেম সেল বা কোষের বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কাণ্ডসম-কোষ’। অর্থাৎ এমন এক কোষ, যেটা থেকে তৈরি হতে পারে একাধিক ও নানারকম কোষ। গাছের কাণ্ড থেকে যেমন বেড়ে ওঠে শাখা প্রশাখা, যারা নিজস্ব স্বকীয়তায় বিস্তৃত হয়, এই কোষও ঠিক সেরকম।
১৮৬৮ সালে প্রথম বিজ্ঞানী আর্নস্ট হাকল স্টেম কোষের ধারণা দেন। পরের প্রায় ৮ বছর এ ধারণা তেমন গুরুত্ব পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখা গেল, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের দেহে রক্ত-কোষ তৈরির ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। এ সমস্যা থেকে ক্যানসার বা লিউকেমিয়া হতে পারে। এর সমাধান মেলে মার্কিন বিজ্ঞানী আরভিং ওয়াইজম্যানের গবেষণার মাধ্যমে। ১৯৬০-৯০ পর্যন্ত তিন দশক গবেষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিষ্কৃত ফ্লো সাইটোমিটার ব্যবহার করে অস্থিমজ্জা থেকে স্টেম কোষ আলাদা করেন তিনি। বর্তমানে এ কোষ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজে লাগছে। এরই সূত্র ধরে এবার স্টেম কোষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে লিম্বাল স্টেম সেল ডেফিশিয়েন্সির সমাধান করা হলো। তবে এটি এখনো বহুল প্রচলিত চিকিৎসা হয়ে ওঠেনি। সে জন্য লাগবে আরও বিস্তৃত পরিসরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা। গবেষকেরা বর্তমানে তারই পরিকল্পনা করছেন।