Connect with us

বিবিধ

অসীম সাহা : লেখালেখির যে জায়গাটি নির্মাণ করেছেন তিনি

Published

on

অসীম সাহা

শ্র দ্ধা ঞ্জ লি

জন্মেছিলেন নেত্রকোণা জেলার মামাবাড়িতে ১৯৪৯ সালে। পিতৃভূমি ছিল মানিকগঞ্জে। বাবার কর্মসূত্রে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছেন মাদারীপুরে। এরপর তারুণ্যে ১৯৬০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। তারপর বাকিটা জীবন কাটিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনকে ঘিরে, তার ৭৫ বছর অবধি, দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যাবার আগে পর্যন্ত। তার দিন আর রাত কেটেছে শাহবাগে, কাঁটাবনে, হাতিরপুলে, ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে, নীলক্ষেতে এবং বাংলা একাডেমিতে।
এই পরিমণ্ডলেই তাকে দেখা গেছে রাতে দিনে সকালে দুপুরে নিদ্রায় জাগরণে আড্ডায় ধ্যানে পথে প্রান্তরে রিকশায় বা বইয়ের দোকানে নয় তো বা সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠানের মঞ্চে বা দর্শকসারিতে। এরকমই ছিল রাজধানীকেন্দ্রিক তার জীবনের প্রায় ছয়টি দশক।
যার কথা বলছি তিনি কবি অসীম সাহা। গত মঙ্গলবার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন প্রবন্ধ বিচিত্র বিষয়ে, লিখেছেন ছোটদের জন্যে বড়দের জন্যে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ নিবন্ধ কবিতা ছড়া আর গান মিলিয়ে চমৎকার এক বই। তিনি অনুবাদ করেছেন মেক্সিকোর কবি অক্টাভিও পাজ এবং ক্যারিবীয় কবি ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা। আধুনিক বাংলা ভাষায় বিনির্মাণ বা তর্জমা করেছেন মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রী কৃষ্ণকীর্তন কাব্য’। তিনি এই সময়ের চলমান প্রাতিষ্ঠানিক অভিধান অস্তিত্বকে অনেকটা বাতিল করে প্রণয়ন করেছেন আধুনিক ব্যবহারিক সহজ বাংলা অভিধান।
তিনি যা কিছু করেছেন তার মধ্যে একটা নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি ছিল, নিজস্ব মেজাজ ছিল। তিনি ধ্যানমগ্ন জীবন পার করেছেন। তা কেবল পোশাকি ব্যাপার ছিল না। তিনি লেখালেখিকে নিবিড় চর্চা আর সাধনার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তা করতে গিয়ে নিরন্তর লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে রাজধানীতে টিকে থাকার রসদ জোগাড় করতে গিয়ে। তিনি হাল ছাড়েননি, লেখালেখির পাল সর্বদা তুলে রেখেছেন।
তার সাধনা আর চর্চার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলেই পরিষ্কার হবে, তিনি কেমনতর ধারায় লেখালেখিতে নিমগ্ন থাকতেন। তিনি উপরোক্ত অভিধানটি প্রণয়ন করার আগে নিয়ম করে প্রতিদিন এক ঘণ্টা ধরে টানা দশ বছর উপন্যাস পড়ার মতন যাবতীয় অভিধান পড়েছেন। তারপর আট বছর সময় ধরে তার নিজের অভিধানটি প্রণয়ন করেছেন।
অসীম সাহার ভেতরের তেজ সম্পর্কে একটু ধারণা পাবার জন্যে অভিধান বিষয়ে তার কথা থেকে উদ্ধৃত করতে চাই: ‘‘. . . বাংলা একাডেমি এ-পর্যন্ত অনেকগুলো অভিধান বের করেছেন। অনেক ভুল ও অসঙ্গতিতে ভরা এসব অভিধান সহযোগিতার বদলে অনেকক্ষেত্রেই বিভ্রম তৈরি করেছে।’’ এরকম একটি বাস্তবতায় অনেকটা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সংস্কৃতি ভাষানির্ভর বাঙালি পণ্ডিতদের গুরুচণ্ডালি প্রবণতা থেকে বাংলা ভাষার মানুষকে মুক্তি দেবার জন্যে নিজে সহজ অথচ আধুনিক সরল সুন্দর অভিধান প্রণয়নে টানা প্রায় কুড়ি বছর আত্মনিয়োগ করেছেন।
তিনি প্রজ্ঞা সাহস আর দ্রোহ বয়ে চলতেন। তা প্রকাশ করতেন নির্মোহ ভঙ্গিতে। কবি অসীম সাহার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত চেনা পরিচয় খুব বেশি ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে তাঁর নিজস্ব পরিমণ্ডলে তাঁকে অনেকবার কাছে থেকে দূরে থেকে দেখেছি। তার কথাবার্তাও শুনেছি কখনোসখনো দর্শকসারিতে বসে। তার কথা বলার মধ্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ত তেজ প্রকাশ পেত। ব্যাপক পড়াশোনা, জানাশোনা স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি; পাবার লোভ আর হারাবার ভয় না থাকলেই একজন পরিণত বয়সের মানুষের মাঝে এই তেজ প্রকাশ পেতে পারে। অনেক সময় তাঁর সঙ্গে তাঁর সহধর্মিনী কবি অঞ্জনা সাহাকেও দেখা যেত অনেকটা ছায়ার মত মায়ার মত; নন্দনসময়ের সাক্ষী এক কবিযুগল।
শেষতক কবি অসীম সাহার সঙ্গে দেখা হয়েছিল গতবছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার মূলমঞ্চে কাজী রোজী এবং দিলারা হাশেমের স্মরণে আয়োজিত সেমিনারে।

এই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেছিলেন অসীম সাহা। অন্যদের মাঝে আমিও দিলারা হাশেমকে নিয়ে কথা জন্যে ডাক আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাসির আহমেদ ও তপন রায়। আলোচনায় আরো অংশগ্রহণ করেন আসলাম সানী, শাহেদ কায়েস এবং শাহনাজ মুন্নী।
সভাপতির ভাষণে অসীম সাহা অল্পকথায় পুরো প্রসঙ্গ মেলে ধরেছিলেন। সেই সঙ্গে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে খেদ ঝাড়তেও ভুলে যাননি। মুক্তমঞ্চে এরকম দীর্ঘ সেমিনারের জন্যে পরিণত বয়সের একজন সভাপতির জন্যে ভবিষ্যতে খাটিয়া রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কথাটা রূপক অর্থে বললেও সংশ্লিষ্টদের বোধোদয়ের তাগিদ থেকেই কথার ঝাঁজটা মিশিয়েছিলেন শব্দ ও প্রকাশের মুনশিয়ানা যোগ করে।
চমৎকার বাচনভঙ্গির অধিকারী শক্তিমান এই প্রতিভার কবিতাসহ লেখালেখির বিবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে তার বিচিত্র প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে তার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের বইয়ে। ১৯৭০ এর দশকে তার তারুণ্যে ‘প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা’ গ্রন্থ সাহিত্যে গণনীতি, কবিতায় পরিমিতি বোধ, স্বপ্নচারিতা, ছন্দ, মধুসূদনের লেখালেখি, রবীন্দ্রনাথ,, নজরুল, সুকান্ত, যাত্রা ও নাটক নিয়ে বিচিত্র সব প্রবন্ধ লিখেছেন। লিখেছেন সংস্কৃতি রাজনীতি ও বিজ্ঞানের পরস্পর যোগসূত্র নিয়েও।
তার একটি বয়ের শিরোনাম থেকে ধারণা পাওয়া যায় কত বিচিত্র তার ভাবনার পরিধি: ‘লেখালেখির এলোমেলো নামতাপাঠ।’
তার সম্পাদনার হাত এবং দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজটি হলো তার সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থ ‘চিরায়ত কিশোর কবিতা’। এরকম একটি চিরায়ত গ্রন্থের কাছে বাঙালিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পরস্পরায় ফিরে আসতেই হবে। এখানে বাংলা আদি ও অকৃতিম দ্রুপদী কবিতার প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হতেই হবে। চিরায়ত এই গ্রন্থে আব্দুল হাকিম থেকে শুরু করে রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীর কবিতাসহ অর্ধশতক কবির কবিতা গ্রন্থভুক্ত হয়েছে।
লেখালেখি ঘিরে বহুবিধ বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে নিবেদন করলেও অসীম সাহা শেষ পর্যন্ত কবিই ছিলেন। তা যেমন ছিল বলনে চলনে নিবেদন ও প্রকাশেও। তার সকল উপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দিত, জাগিয়েও তুলতো এই বোধে যে অসীম সাহা একজন কবি। একজন মানুষের উপস্থিতির এরকম ‘কবি আবেদন’ একটি প্রজন্মে খুব বেশি মানুষের জীবনে ঘটে না। যে বিষয়কে ইঙ্গিত করে বলা হয়ে থাকে অনেকেই কবিতা লেখেন, কবিযশের পেছনে কাঙালের মত ছুটেন, নামের আগে পেছনে ডক্টর অধ্যাপক সচিব পাইক পেয়াদা এরকম অনেক কিছু না, এর সঙ্গে জুড়ে নেবার পরও ‘কবি’ শব্দটির জন্যে কাঙাল হয়ে থাকেন।
এর বিপরীতে অসীম সাহার মত মানুষেরা একটি ভাষা সাহিত্যের প্রজন্মে সদা কবিযশ প্রাপ্তির বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী কবিতার জন্যে নিবেদিত একজন স্বভাব এবং সচেতন কণ্ঠস্বর। কবি অসীম সাহা ছিলেন ঢাকা শহরের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের অল্প কয়েকজন অবশিষ্ট অলঙ্কারের একটি। যে জায়গাটা নির্মাণ করেছিলেন আপন মায়ায়, তার বিদায়ে সেই জায়গাটি ফাঁকা হয়ে গেলো। যত দিন যাবে দেশ এবং নগরের লেখালেখি পরিমণ্ডল তার অনুপস্থিতি টের পেতে থাকবে কোথায় যেন ছন্দের একটা পতন হয়েছে, নন্দনভাবনার কোথায় যেন ফারাক থেকে যাচ্ছে। এই ফারাকটির নাম কবি অসীম সাহার অনুপস্থিতি।

তার একটি কবিতা দিয়ে এই লেখার সমাপ্তি টানছি:

যাও
অসীম সাহা

যে প্রশস্ত পথের সন্ধান তুমি পেয়েছো
সেই পথ ধরে তুমি সামনের দিকে এগিয়ে যায়
প্রলয়ের অন্ধকার তোমার পথরোধ করে দাঁড়াবে না!

শুধু আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিও;
বিভক্ত কাছের দুপাশে দুরকমের তুমি
আর নেপথ্যের হাহা অন্ধকারে আমি এক!

তুমি আর একবার বুঝে নাও —
প্রশস্ত পথ ধরে তুমি সামনের দিকে
এগিয়ে যেতে পারবে কিনা?

আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি:
অন্তত আমার প্রলয়ের অন্ধকার
কিছুতেই তোমার পথরোধ করে দাঁড়াবে না!

যদি তুমি পারো তবে যায়—
তুমি যায়!!

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending