বিবিধ
কাফকার পোকা, মুমূর্ষু ইউরোপ ও বাকি আত্মীয়স্বজন
Published
3 months agoon
কাফকার ছোট গল্প ‘মেটামরফোসিস’ কিসিমের গল্প পশ্চিমা সাহিত্যে বেশি নাই। ব্লুমসবাড়ি গোষ্ঠীর মৃদুভাবে আরোপিত উত্তর কলোনিয়াল আধুনিকতায় বেশ সাহস করেই ইউরোপের দানবকে এড়িয়ে চলে তাদের লেখায়। মানে সেই সাহিত্যের চরিত্রগুলা কষ্টে আছে কিন্তু ‘শেষ পর্যন্ত আমরাই শ্রেষ্ঠ’ ভাবটা শেষ পর্যন্ত টিকে যায়।
কাফকা এই স্বস্তিটুকু ভেঙে দেয় জোর হাতে। না কিছুই ঠিক নেই ইউরোপ বলে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে উপস্থিত হয় তার স্বল্পসংখ্যক পাঠকের সামনে। একজন মানুষ ঘুম থেকে উঠে দেখে সে একটা একটা বিকট বিশাল গুবরে পোকা হয়ে গেছে। কী করে কিছু ঠিক থাকে! এই চপেটাঘাত গোটা ইউরোপীয় সুশীল সমাজের গালে পড়েছে, সেটা বোঝা যায়, আজও কষ্ট দেয়। এই কারণেই কাফকা এখনো সাম্প্রতিক। কিন্তু এটা কি ব্যক্তিগত না সামষ্টিক, সমাজের দিকে না রাষ্ট্রের? এই হিসাবে মূল ধারার পশ্চিমা পণ্ডিতেরা যেতে চায় না। ইউরোপ থেকেও কেউ বলে না, এটা কাফকার নিজের গল্প কিন্তু তাকে মারল কে? আর আমাদের এখন কী হাল? এত শক্তি দিয়ে যে গলদটা এত বিকটভাবে একটা দানবীয় সিমিলি দিয়ে চিত্রিত করল, সেটার ভোক্তা সবাই; কিন্তু সূত্রটা কে বা কী, সেটার নীরবতা লক্ষণীয়? সে, আমরা না সবার ইতিহাস? যার হাতে লালিত হয়েছে ইউরোপ, ডেকে নিয়ে কারখানায় গেছে অথবা দরকার হলে মানুষ মারার চুল্লিতে কোনো নাৎসি ক্যাম্পে, তার আলোচনা এত কম কেন।
২.
কাফকার লেখা কমবেশি অনেকেরই পড়া; তাই সাহিত্যের মূল্যায়ন নয়, তার ভাবনার সূত্রের সচেতন, অবচেতন ও ঐতিহাসিক সূত্রগুলো নিয়ে এই ক্ষুদ্র আলোচনা। প্রশ্ন হলো—কাফকার ওপর ইউরোপের ইতিহাসের প্রভাব কতটা? বা কোন ইতিহাস তাকে কতটা সৃষ্টি করেছে? এবং সে যেমন একটা টালমাতাল ইতিহাসের মধ্যে বসবাস করেছে, সেই ইতিহাস যেটা তাকে তাড়া করে ফিরেছে—সেটা কি শেষ হয়? নাকি আমূলভাবে পাল্টে যায়? নাকি তার লেখা একধরনের ভবিষ্যতের চেহারা দেখায়, যাতে কাফকা বেঁচে থাকলে তার জায়গা হতো কি না, আমরা জানি না।
৩.
কাফকার তিনটি প্রধান সামাজিক পরিচয়। তিনি ইউরোপীয়, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিও-চেক, বোহিমিও; অর্থাৎ ১৯ শতকের পূর্ব ইউরোপীয় ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতি জনগোষ্ঠীর বিবরণ তার জাতীয় সনদপত্রের হলফনামায় পাওয়া যায়। যারা ওই কালের ইউরোপের ইতিহাস জানেন, তারা বুঝবেন, ইউরোপীয় একটি মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা ভৌগোলিক রাজনীতির চেয়ে তার মূলধারার অংশ না হলে মানসিকভাবে টিকে থাকা অত সহজ নয়। তাই তৃতীয় পরিচয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জার্মানিক ইহুদি, ঐতিহাসিকভাবে শরণার্থী।
৪.
আমাদের দেশে এই বিষয় নিয়ে কম আলাপ হয়; যে কারণেই হোক, কিন্তু ২০ শতাব্দীর ইউরোপে এটা চরম ও নির্মম বাস্তবতা ছিল তাদের জন্য। তারা ইউরোপীয় হলেও পুরা নয়। সমাজ কাউকে কাউকে ঘরে শুতে দিলেও সেটা বাইরের মহলে। ভেতরে প্রবেশ করলেও এমনকি বিয়েশাদিতে ডাকলেও ঘটক তাদের নাম প্রস্তাব করে না পাত্রীর জন্য। এই অন্দর-বাহির টানাটানির মধ্যেই কাফকার বেড়ে ওঠা, বসবাস। ঠিক যেভাবে পোকাটা পরিবারের একজন হয়েও কেউ নয়, যেহেতু সে এক পোকা। যাকে ফেলে রেখে সবাই বাইরে চলে যায় গল্পের শেষে। মানুষের মধ্যে থাকলেও সে আলাদা, কোথাও খুব গভীরভাবে এক বাদ পড়ে যাবার কষ্ট কাফকাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ওটা তার সাহিত্যে আসে কারণ ওটাই ছিল ইউরোপের বাস্তবতার ইতিহাস।
৫.
কাফকার সাহিত্য যেমন বিশাল বাস্তবতার মধ্যে ক্ষুদ্রের অবস্থান সেটা; পোকা বা গ্রেপ্তার হওয়া মানুষ বা অসহায় কৃষক, তার ইতিহাসের বৃহত্তর ব্যাকস্ক্রিনটা তেমনি বুভুক্ষু কোনো তাণ্ডবনৃত্যের মতো যার রোষ থেকে কেউ বাঁচে না। তাই কাফকার লেখায় ইউরোপীয় রাজনীতির হিংস্র ও নিষ্ঠুর ছায়াগুলা সামনে আসে লুকিয়ে থাকার পরও।
৬.
কাফকার বাবা-মা জগাখিচুড়ি জার্মান বলতেন অনেক ইউরোপীয় ইহুদির মতো, কিন্তু তারা শুদ্ধ জার্মান শিখিয়েছিলেন সন্তানদের, যাতে ছেলেমেয়েরা রুটিরুজি করতে পারে। এই দুই দুনিয়ার জাঁতাকলের মধ্যে থেকেই কাফকার সাহিত্য যাত্রার শুরু।
কাফকার লেখায় অনেক কিছুই হঠাৎ করে হয়। হঠাৎ করেই কেউ পোকা হয়ে যায়, হঠাৎ করেই কেউ গ্রেপ্তার হয়, বিচার শুরু হয়, হঠাৎ করেই কেউ উধাও হয়, এটা ঘটেই কাফকার লেখায়। যদিও উপসংহারে পার্থক্য কম।
৭.
ইউরোপ কেবল প্রথম নয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ প্রসব করে। আর যে মৃত্যু মেঘ ইউরোপের ইহুদিদের দিকে ধেয়ে আসছিল, বিশেষ করে জার্মান ইহুদিদের দিকে, তার পিছনে ধর্ম/জাতিবিদ্বেষ ছিল না, ছিল আন্ত-ইউরোপীয় রাষ্ট্রিক দ্বন্দ্ব। ইহুদির এই তর্কে কোনো ভূমিকা ছিল না। এবং সেটা হঠাৎ নয়, তৈরি হচ্ছিল দীর্ঘদিন তাদের ইতিহাসের শস্যখেতে। ইউরোপ যে একটি
রক্তাক্ত ভূমিখণ্ডে পরিণত হতে যাচ্ছে, সেটারই বিবরণ কাফকার লেখায়, প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীর মতো।
এতে ব্যক্তি সংকট আছে, প্রতিটি মৃত্যু তা-ই; কিন্তু প্রধান হচ্ছে রাষ্ট্র সংকট এবং শেষে যার সাথে যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক পশ্চিমা রাজনীতি, আমেরিকার জড়িয়ে পড়ার মধ্যে। যেসব সামাজিক শক্তি ইউরোপ ছিল, সেসব তখন নিশ্চিহ্ন হবার পথে আর এই বিলীন গর্ভ থেকেই জন্মেছে কাফকার সাহিত্যের ল্যান্ডস্কেপ। ইউরোপ আর কোনো দিন মহাশক্তি হয়নি দুই যুদ্ধের পর। তাই কাফকার লেখা একধরনের এই পতনের বা মৃত্যুর এপিটাফ।
৮.
পশ্চিমা কাফকা এক্সপার্টরা—বিশেষ করে ইউরোপীয়রা বলেন কাফকার প্রায় ‘সকল’ কষ্ট তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। আর ‘ট্রায়াল’ উপন্যাস হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদ’বিরোধী বা এর মানে যা ইউরোপীয় নয় সেটা সমাজতন্ত্রী হোক অথবা অন্য কিছু। তাদের কাছে প্রেম, ভালোবাসা এবং ওই পরিসরে তার ব্যর্থতা তার সাহিত্যের অনেকটাই প্রধান রসদ ভান্ডার। কিন্তু আরও অনেক ছায়া দেখতে পাওয়া যায় ব্যক্তিগত কষ্টসহ তার সাহিত্যে। কাফকার প্রেমিক মন, তার সম্পর্কগুলা, তার পারিবারিক জীবনের আকাক্সক্ষা এবং তাতে ফসলের অভাবটাই বড় হয়ে আছে। আবার মার্ক্সবাদীরা তাকে একধরনের বিপ্লবী বানান যেমন জায়নবাদীরা ভাবেন তিনি কেবল তাদেরই ঘরানার লেখক। আসলে মানুষের মনে তো সবই আছে কিন্তু পটভূমির দিকে কেন কম তাকান, বোঝা যায় না। ইতিহাস বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব?
৯.
কাফকার ক্ষেত্রে তার থিমগুলাই তাকে ধরিয়ে দেবে তার ঠিকানার নাম। তাই ‘ক্যাসেল’, ‘ট্রায়াল’—তার দুই শ্রেষ্ঠ কাজ—এখানে বার বার ক্ষমতাবানরা সামনে আসে। তারা বলবে না কেন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কেন তার বিচার হবে। অথবা ক্যাসেল উপন্যাসে, যারা কেল্লার ছায়ার মধ্যে বসবাস করে, কেন তাদের এত ভয়, কেন তারা নির্যাতনকে মেনে নেয় বাধ্য হয়ে। এই সব বাস্তবতা খুব কঠিন অস্বীকার করা এই কারণে যে কাফকার চোখে যা পড়ছে যেটা ঘটেছে চতুর্দিকে, সেটা কেবল তার নিজস্ব বাস্তবতা নয়, সবার বা অনেকের। আর তার জন্য অপেক্ষা করছে এক দৃশ্য, যেখানে তারই দেশ ও ভাষা—ভ্রাতাগণ পুড়িয়ে দিচ্ছে লেখকের ইতিহাস ও তার সব প্রিয় ঠিকানা। তার ইহুদি পরিচিতি একটি উছিলা মাত্র, আগুন দিচ্ছে ইউরোপের ইতিহাস তার নিজ বাসিন্দাদের।
১০.
পশ্চিমা পণ্ডিতগণ ইতিহাসের চেয়ে কাফকার যৌনজীবন সন্ধান করেন? তার বহু নারীগামিতা বা তার নিজের তথাকথিত ‘যৌন সমস্যার’ মধ্যে তার সাহিত্যের প্রায় সকল সূত্রগুলো সন্ধান করেন। কেউ কেউ রাজনীতি খুঁজলেও ইউরোপের ইতিহাসের দানবীয় চেহারা নয় তার বিশ্বজয়ী ভাবনা সেটা উদারতাবাদ হোক অথবা মার্ক্সবাদে অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। ইউরোপের দাবি করা ভূমিকা যে তারাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ—টাকায়, মেধায়, সাহিত্যে।
সবই তার সাহিত্যে আছে, তবে কোনোটাই ইতিহাসের বাইরে নয়। তৎকালীন সময়ের ও ইউরোপের বিশ্ব পরিচালনার যে কাঠামো তার উল্লেখ নাই; কেবল আছে তার আঘাতের বিবরণ। সেই দিক থেকে এটা প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্য। ক্ষমতার প্রবল লড়াই, বহু শক্তির মধ্যে কিন্তু সবগুলোই বৃহৎ ও কেল্লার পাশে থাকা কিষানের নাগালের বাইরে। যে লোকটাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় বিচার করতে কিন্তু জানায় না তার অপরাধ কী, সেটা সাধারণ মানুষের অবস্থার বর্ণনা। চাইলেও পালাবার পথ নাই। কোনো কিছু অক্ষত নাই, সেটা যৌনতা, ভালোবাসা, পরিবার, প্রেম, রাজনীতি বা আদর্শ। এটাই কাফকার দুনিয়া মনে হয়। এবং এটাই ঘণ্টা বাজিয়ে ঘোষণা করছে ইউরোপের মৃত্যুক্ষণ এল বলে।
১১.
পোকাটাকে ফেলে রেখে বাড়ির সবাই ঘুরতে বেরিয়ে যায়। থাকুক পোকাটা গৃহবন্দী হয়ে। কাফকা মারা গেলেন প্রথম মহাযুদ্ধের পর। যে দুনিয়ায় তিনি জন্মেছিলেন, বড় হয়েছিলেন—তার মৃত্যু ঘটে এই মহাযুদ্ধে। রাজা-বাদশাহর জমানা শেষ হয়ে যায়, দুটো মহাশক্তি সামনে এসে দাঁড়ায়, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পুঁজিবাদী সম্রাট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পুরোনো ইউরোপকে শাস্তি পেতে হয়, কোটি কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয় যুদ্ধ করার জন্য ভারসাই ট্রিটিতে। ইউরোপ উঠে দাঁড়াতে পারেনি। জার্মানি উঠেছে প্রতিশোধ বুকে নিয়ে, সাথে সাথে ব্যবহার করেছে ‘গণঘৃণা’, যা সব সময় কাজে লাগে নিজেদের সবল করতে। ইংল্যান্ড ও আমেরিকা চাইলে জার্মানিকে আগে রুখতে পারত কিন্তু তাদের মাথায় সমাজতন্ত্র নিয়ে দুশ্চিন্তাই তাদের উঠতে দিয়েছে, বাধা দেয়নি এই আশায় যে জার্মানরা রাশিয়াকে ঠেকাবে, জার্মানির জন্য আমরা তো আছি। এই পটভূমিতেই ইউরোপ হেঁটেছে তার নিজের সাম্রাজ্যের মৃত্যুর দিকে, একদা মহা শক্তিমান তখন নির্জীব একটি মহাদেশ।
১২.
কাফকার উপন্যাসের যেসব বিকট, উদ্ভট, অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, তার সাথে নাৎসি রাজনৈতিক ভাবনার মিল পাওয়া যায়; কিন্তু তাদের উত্থান ঘটে গোটা পশ্চিমের নয়া অর্থনীতির খেলায়। নাৎসিবাদ হত্যা করে কাফকার ৩ বোনকে, বেঁচে থাকলে কাফকার কী হতো? কিন্তু জার্মানি শুধু হারেনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে, গোটা ইউরোপ তলিয়ে যায় আমেরিকার শক্তির সামনে। কলোনি হাতছাড়া হয়। কাফকার লেখায় এই পতনের শুরুটা কেমন দেখতে হবে বা হতে পারে, সেই বাস্তবতায় তার বিবরণ পাওয়া যায়। কাকতলীয় নিশ্চয় যে তার শেষ উপন্যাসের নাম—’আমেরিকা’। কাফকার লেখা প্রান্তিক ইউরোপের, প্রান্তিক জনের সামষ্টিক ইতিহাস।