বিবিধ
ঘোড়ার পিঠে সভ্যতা
Published
2 months agoon
আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে অ্যামেরিকা মহাদেশ থেকে ঘোড়া বিলুপ্ত হয়ে যায়। ঠিক কী কারণে হঠাৎ করে ঘোড়ার মত একটি শক্তসমর্থ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে অ্যামেরিকা থেকে ঘোড়া বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার দুইটা তত্ত্ব রয়েছে। সম্ভবত ঘোড়ার বিলুপ্তির সাথে এই দুইটি কারণই জড়িত। একটি কারণ হলো অ্যামেরিকাতে মানুষের আগমন, আর দ্বিতীয় কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অ্যামেরিকার স্তেপ অঞ্চলের উদ্ভিদের ধরন বদলে যাওয়া। সম্ভবত এশিয়া থেকে প্রাচীন অ্যামেরিকাতে যে মানুষগুলো গিয়েছিল ওরা ঘোড়া শিকার করত। প্রাচীনকালে ঘোড়া বাস করত মূলত স্তেপের ঘাসি জমিতে। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অ্যামেরিকান স্তেপে ঘোড়ার খাওয়ার মত ঘাসের অভাব দেখা দেয়, আর অন্যদিকে শিকার করার কারণেও ওদের সংখ্যা কমতে থাকে। আর এভাবেই প্রায় ১০ হাজার বছর আগে অ্যামেরিকা মহাদেশ থেকে ঘোড়া চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে অ্যামেরিকা থেকে ঘোড়া বিলুপ্ত হলেও পৃথিবী থেকে ঘোড়া বিলুপ্ত হয়নি। কারণ ইউরেশিয়াতে তখনো ঘোড়া ছিল। তবে ঘোড়ার উদ্ভব হয়েছিল মূলত উত্তর অ্যামেরিকাতে। এশিয়া বা ইউরোপে আজ থেকে ১০ লক্ষ বছর আগে কোনো ঘোড়া ছিল না। কিন্তু ৮ থেকে ৯ লক্ষ বছর আগে এই বন্য ঘোড়াগুলোর একটা অংশ অ্যামেরিকা থেকে ইউরেশিয়াতে চলে আসে। আপনি হয়তো ভাবছেন ঘোড়া কীভাবে অ্যামেরিকা থেকে এশিয়া বা ইউরোপে আসবে? আসলে ওই সময় বেরিং প্রণালী বলে কিছু ছিল না, তার বদলে সেখানে ছিল “বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ”। অর্থাৎ বরফ জমে সমুদ্রের উচ্চতা কমে গিয়েছিল, ফলে হেটে হেটেই তখন অ্যামেরিকা থেকে রাশিয়া হয়ে এশিয়া বা ইউরোপে চলে আসা যেত। কয়েক দল বন্য ঘোড়া সম্ভবত খাদ্যের অভাবে “বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ” দিয়ে রাশিয়াতে এসে পৌঁছায়, এগিয়ে যেতে যেতে পেয়ে যায় ঘাসি জমি। আর সেই প্রাচীন কাল থেকেই ইউরোপ আর এশিয়ার মাঝামাঝিও একটা বিশাল স্তেপ ছিল। ঘোড়াদের জন্য যেহেতু স্তেপের ঘাসি জমি একদম আদর্শ বাসস্থান, ফলে প্রাচীন এই বন্য ঘোড়াগুলো ইউরেশিয়ার এই অঞ্চলে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করে। অর্থাৎ, অ্যামেরিকার স্তেপের ঘোড়া চলে আসে ইউরেশিয়ান স্তেপে।
শুনতে হয়তো অবাক লাগবে- ইউরেশিয়ান স্তেপের এই ঘোড়া নামক একটি প্রাণী আমাদের মানব সভ্যতার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘোড়া নামের এই প্রাণীটি না থাকলে হয়তো মানব সভ্যতার ইতিহাসটাই হতো পুরো অন্যরকম। পন্টিক স্তেপ, অর্থাৎ বর্তমান ইউক্রেন এবং রাশিয়ার কিছু অঞ্চলের একদল যাযাবর মানুষ প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই মানুষগুলোর নাম দিয়েছে বোতাই সংস্কৃতির মানুষ। বোতাইরা প্রথম দিকে ঘোড়ার মাংস খেতো, পরে ধীরে ধীরে ঘোড়াকে পোষ মানাতে শিখে। বোতাইরা এককালে ছিল পুরোপুরি যাযাবর, ফলে এক সময় ওদের মধ্যে দীর্ঘ পথ ভ্রমণের চর্চা ছিল। ওরা দেখতে পায় যে- ঘোড়া প্রাণীটা বেশ দ্রুত চলতে পারে, আবার প্রাণীটি খুবই শক্তিশালীও বটে। সময়টা আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের। মানুষ ততদিনে ভেড়ার মতো অনেক প্রাণী পোষ মানাতে শিখে গেছে। তাই বোতাইরা চিন্তা করল ঘোড়াকে পোষ মানালে আমাদের অনেক সুবিধা হবে। বোতাইদের পরে আরও অনেক যাযাবর জাতি এই ঘোড়াকে পোষ মানাতে শিখে। এই একটা বিশেষ প্রাণীকে পোষ মানাতে শিখে যাযাবর গ্রোত্রগুলোর ভাগ্য চিরতরে বদলে যায়।
যাযাবর জাতিগুলো সাধারণ স্তেপের বিস্তীর্ণ ঘাসি জমি বা মরুভূমিতে বাস করে। কিন্তু আমাদের আজকের আলোচনা মূলত ইউরেশিয়ান স্তেপের যাযাবর সম্প্রদায়। স্তেপ আসলে অতি বিশাল এলাকা। কয়েক হাজার কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকাতে শুধু ঘাস আর ঘাস, মাঠের পর মাঠ, কোনো বড় গাছ নেই। এই ধরনের অঞ্চলে অস্থায়ী জীবনযাপন করে টিকে থাকতে হলে বেশকিছু দক্ষতা থাকতে হবে। স্তেপের প্রায় বেশিরভাগ গোত্রই একটা পর্যায়ে ঘোড়াকে পোষ মানায়। এর পাশাপাশি ওরা হয়ে উঠে খুবই শক্তিশালী যোদ্ধা। এদের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী আবার ছিল তীর ধনুক চালনায় খুবই দক্ষ। মোটের উপর স্তেপের এই যাযাবরদের রুখে দেওয়া ছিল খুবই কঠিন। ওরা স্তেপ ছেড়ে বিভিন্ন সময় আশেপাশের স্থায়ী রাজ্যগুলোতে গিয়ে হামলা চালাত। আর ওদের আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতা খুব কম রাজ্যেরই ছিল।
প্রাচীনকালে এই ধরনের যাযাবরদের আক্রমণের সবথেকে বেশি শিকার হয়েছে সম্ভবত চীন। প্রাচীন চীনের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল উত্তর চীনের একটি সমভূমিতে। এই এলাকাটাকে ইংরেজিতে বলে “সেন্ট্রাল প্লেইন”। এলাকাটা সমতল এবং উর্বর ছিল বলে এখানেই বিকশিত হয় চীনের প্রাচীন সভ্যতা। কিন্তু স্তেপের আদিবাসী গোত্রগুলো প্রায়ই এই সমভূমিতে গিয়ে আক্রমণ চালাত। ওরা আক্রমণ করতো খুব দ্রুত বেগে, ঘোড়া নিয়ে। ফলে এই আক্রমণ ঠেকানো চীনের রাজাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। পরবর্তীতে চীনের রাজারা বুঝতে পারে যে- এদের সাথে ঝামেলা করে আমরা পারব না। যদি এদের সাথে আমরা টক্কর দিতে চাই তাহলে আমাদেরও ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা শিখতে হবে। ফলে ধীরে ধীরে চীনের রাজারা স্তেপের যাযাবর যোদ্ধদের সাথে বিভিন্ন জিনিসের বিনিময়ে ঘোড়া কেনার প্রস্তাব দিতে থাকে। যাযাবর নেতারাও এই অফার গ্রহণ করে। কারণ একে তো তাদের জিনিসগুলোর দরকার। দ্বিতীয়ত, ওরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্থায়ী বসতি দখল করত। তখন ওইসব স্থায়ী বসতিতে এত ঘোড়া পুষে রাখা ওদের জন্য সম্ভব ছিল না। ফলে বাড়তি ঘোড়াগুলোকে বিদায় করতে পারলেই ওদের জন্য সুবিধা। এভাবে ধীরে ধীরে চীনের রাজাদের সাথে যাযাবরদের সাথে একটা লেনদেন গড়ে উঠে।
প্রাচীন এই যাযাবরদের আসলে অনেকগুলো গোত্র ছিল। চীনে বহু যাযাবর আক্রমণ চালিয়েছে। এইসব গোত্র ছাড়াও স্তেপের পশ্চিম দিকেও অনেকগুলো গোত্র বাস করত। এমন একটি দলকে এখন আমরা আদি ইন্দো-ইউরোপীয় নামে জানি। এই আদি ইন্দো-ইউরোপীয়রাও বাস করতো বোতাইদের মত সেই পন্টিক স্তেপ অঞ্চলে। ইন্দো-ইউরোপীয়রা ছিল ধনুক বিদ্যায় খুবই পারদর্শী। ওরা ওদের ঘোড়ার সাথে চাকা জুড়ে দিয়ে রথ তৈরি করা শিখেছিল। ঘোড়া, রথ আর তীর-ধনুক, সব মিলিয়ে ওরা হয়ে উঠে মারাত্মক যোদ্ধা। ওদের হারানো ছিল প্রায় অসম্ভব। এই অসাধারণ যুদ্ধবিদ্যা নিয়ে ওরা যে অঞ্চলে গিয়েছে পৃথিবীর সেই অঞ্চলই ওরা জয় করেছে। ওরা একটা পর্যায়ে ইরানে এসে প্রাচীন পারস্য সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। একটা পর্যায়ে ওদের একটা দল ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে প্রবেশ করে তৈরি করে আর্য সভ্যতা বা বৈদিক সভ্যতা। আজকের দিনের যে হিন্দু ধর্ম আমরা দেখি তার মূল ভিত্তি হলো বেদ। সেটা মূলত এই আর্যদের তৈরি করা।
ইন্দো ইউরোপীয়দের ভাষা এবং সংস্কৃতি ছিল খুবই শক্তিশালী। ওদের একটি দলই জার্মানি হয়ে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পরে। আজকের দিনের পৃথিবীতে যত মানুষ বাস করে তাদের প্রায় অর্ধেক মানুষ কথা বলে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষায়। ঘোড়া, তীর ধনুক আর রথের শক্তি নিয়ে ইন্দো ইউরোপীয়রা ছড়িয়ে পরে সারা বিশ্বে। আর ওদের শক্তিশালী ভাষা আর সংস্কৃতির কারণে তা ছড়িয়ে পরে আশেপাশের অঞ্চলে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, স্প্যানিশ, ফ্রেন্স, সুইডিশ, ড্যানিশ, নরওয়েজিয়ানসহ আরও অনেক ভাষা এসেছে ওই প্রাচীন যাযাবর গোষ্ঠীদের ভাষা থেকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল মঙ্গোলরা। এই মঙ্গোলরাও ছিল যাযাবর। ওরা যখন ঘোড়ায় চড়ে চীন আক্রমণ করে তখন চীন সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেনি। সামান্য এক যাযাবর গোত্র থেকে মঙ্গোলরা খুব দ্রুত হয়ে উঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের স্রষ্টা। এই মঙ্গোলরা কাগজের টাকার ব্যবহার থেকে শুরু করে এমন কিছু কাজ করে যা পরবর্তীতে মানব সভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মঙ্গোলদের মতো হান এবং সিথিয়ানরাও ছিল স্তেপের যাযাবর। ওরাও তৈরি করেছিল মহাশক্তিশালী সাম্রাজ্য।
কয়েক হাজার বছর ধরে এই যাযাবর গোষ্ঠীরা- স্থায়ীভাবে বসবাস করা মানব সভ্যতার সাথে নানাভাবে যুক্ত ছিল, ওরা আমাদের মূলধারার সভ্যতাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। আমরা যখন ইতিহাস পড়ি তখন মূলত মূলধারার মানব বসতি এবং রাজাদের ইতিহাস পড়ি। কিন্তু আজকে মানবজাতি যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে পৌঁছাতে গিয়ে যা যা ঘটেছে তার একটা বিশাল অংশ আসলে এই যাযাবর গোষ্ঠীদের দ্বারা প্রভাবিত, ওদের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, ওদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি দ্বারাও প্রভাবিত। কিন্তু ইতিহাসে সেই অর্থে এই প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসবিদরা সম্প্রতি ওদের সংস্কৃতির প্রভাব এবং তার বিশাল গুরুত্বকে বুঝতে শুরু করেছেন। প্রাচীন চীন, ইউরোপ, রোমান সাম্রাজ্য, প্রাচীন পারস্য সভ্যতা বা প্রাচীন ভারত উপমহাদেশ, এই সবগুলো অঞ্চলের স্থায়ী সভ্যতাই আসলে ইউরেশিয়ান স্তেপের যাযাবরদের সংস্কৃতি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।