Connect with us

বিবিধ

নির্মলেন্দু গ‍ুণের প্রতিবাদের ভাষা

Published

on

নির্মলেন্দু গ‍ুণের প্রতিবাদের ভাষা

আধুনিক বাংলা কবিতা বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকেই বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। চল্লিশের দশকে এই বিভাজন স্পষ্ট রূপ লাভ করে। এই বিভাজন ছিল অনেক রকম। ব্রিটিশবিরোধী এবং পাকিস্তান আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত এই রকম একটি বিভাজনধারার স্রষ্টা। এই অভিঘাতকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পূর্বেই বাংলা সাহিত্য, বিশেষত কবিতা, এই দুই দেশকেন্দ্রিক প্রবণতায় পৃথক হয়ে গিয়েছিল। নজরুল ইসলামকে সামনে রেখে প্রতিবাদী কবিতার যে-ধারা যাত্রা শুরু করেছিল, পাকিস্তান সৃষ্টির পর তা বরং আরো বেগবান হয়। পাকিস্তানি শাসকদের ঔপনিবেশিক আচরণ তার একটি বড় কারণ। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক ও প্রতিবাদ ’৪৭-এর স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বেই শুরু হয়েছিল, পাকিস্তানি শাসকদের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক আচরণ আরো নতুন নতুন বিতর্ক ও প্রতিবাদ উসকে দেয়। ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কবিদের পক্ষে প্রতিবাদের ধারা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। কবির ব্যক্তিগত বা দলীয় মতাদর্শ যা-ই হোক – ইসলাম, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা জাতীয়তাবাদ, – সকলকেই প্রতিবাদী হতে হয়েছে, যদিও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন রকম। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রী ধারা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হতে থাকে। এঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক এতটাই গভীর এবং সহযোগিতাপূর্ণ যে, এঁদের অনেক সময় পৃথকভাবে শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এঁদের অনেকেই একইসঙ্গে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রী। এর একটা বড় এবং বোধ করি সবচেয়ে উপযুক্ত উদাহরণ নির্মলেন্দু গ‍ুণ।
একজন কবির চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তাঁকে গোষ্ঠীর ভেতরে থেকেও স্বতন্ত্র হতে হয়, তাঁর সাফল্য ও ব্যর্থতার সূত্র এখানেই নিহিত। নির্মলেন্দু গুণের কবিকৃতিকে এই অনুমান দিয়ে বিচার করা অমূলক হবে না বলেই আমার ধারণা।
কবি হিসেবে তাঁর উত্থান ষাটের দশকে। এই কাল-পরিসর সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন – তারপর যে সময়টাতে কবি হওয়ার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ ছেড়ে আমি ঢাকায় যাই, সেই সময়টা উদ্দাম যৌবনতরঙ্গের মতো এমনই মুক্তিমন্ত্রে ফুঁসে উঠেছিল যে, ওই সময়ের ঢেউ যার রক্তে লেগেছে তার পক্ষে নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি হওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না।
বলা চলে এই সময়েরই সন্তান তিনি। তাই তাঁর পক্ষে প্রতিবাদের ভাষা রপ্ত করা ছাড়া উপায় ছিল না। তাঁর ভাষায়– বাধ্য হয়েই শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে আমাকে কলম ধরতে হয়েছে। এভাবেই আমার কবিতার সংগ্রাম রূপান্তরিত হয়েছে সংগ্রামের কবিতায়।
কবিতাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন তাঁর ‘সংগ্রামী আত্মার হৃৎস্পন্দনচিত্র’ বলে। এই সংগ্রামের প্রবণতা ও অভিমুখকেও তিনি শনাক্ত করেছেন– আমার আত্মার আনন্দের সঙ্গে, উপলব্ধি ও আর্তির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশেছে বলেই আমি যখন
শ্রমিক-কৃষকের কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা বলি, তখন কেউ-কেউ ভুল করে ভাবেন– আমি বুঝি কবিতা বাদ দিয়ে রাজনীতি করছি। প্রকৃতপক্ষে মোটেও তা নয়। অপরের মুখ যখন আপনার হয়ে ফিরে আসে, তখনই বন্দনা গাই সেই মুখের। দুর্বলের প্রতি আচরিত অত্যাচার যখন ঘা দেয় আমার বুকে, তখন আমার নয় বলে তাড়িয়ে দিই না তাকে; আপনার বলে সে অনায়াসে গৃহীত হয় আমার কাব্যসত্তার ভিতর-মহলে। এভাবেই আমার কবিচিত্ত অপরের নিত্যদিনের জীবন-সংগ্রামে যুক্ত হয়। এই যুক্ত হওয়াটাই আনন্দের; নারীর সঙ্গে, সন্তানের সঙ্গে, সুন্দরের স্বপ্নের সঙ্গে যেমন।
তাই বলে তিনি প্রতিবাদ-সংগ্রামসর্বস্ব কবি নন মোটেও। বরং তাঁর কাব্যজগৎ পরিভ্রমণ করলে তাঁকে প্রধানত রোমান্টিক কবি বলেই মনে হবে। প্রেমই তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। তাহলে যা হওয়া অসম্ভব বলে তিনি মনে করেছিলেন শেষ পর্যন্ত তিনি কি তা-ই হয়েছেন? হয়তো সেটাই সত্য। তবে এই সত্যের সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে আছে। তিনি ‘নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি’ হওয়াকে অসম্ভব বলেছেন, অর্থাৎ ‘পক্ষপাতী বা ভেজাল রোমান্টিক কবি’ হতে অসুবিধা নেই। তাহলে এই ‘পক্ষপাতী বা ভেজাল রোমান্টিক কবি’র চারিত্র্য কী? তিনি কি সেটাই হয়েছেন? এ-সম্পর্কিত তাঁর একটি স্বঘোষণা এক্ষেত্রে পর্যালোচনা করা যেতে পারে – আমি অন্তহীন আনন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছি জীবনের মাঝে। পরিপার্শ্ব যতো বৈরীই হোক না কেন, – আমি তো আর মেনে নিচ্ছি না তা। আমি জানি, সংগ্রামই সত্য, সংগ্রামই সুন্দর। প্রেম, সেও এক সংগ্রাম।
আবার কবিতায় তিনি বলেন–
‘এইসব হারানোর বিরুদ্ধে রুখে-দাঁড়ানো বিদ্রোহী মানুষের
প্রথম সফল বিপ্লব হলো ভালোবাসা, হ্যাঁ ভালোবাসাই
তার প্রথম সফল উদ্ভাবন। তার অব্যয় অক্ষয় কাব্য।
অপ্রাকৃতিক বলেই সে মৃত্যুহীন, ঈশ্বরের মতো।’
তার মানে প্রেম এবং সংগ্রাম তাঁর দৃষ্টিতে অবিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর আকাক্সক্ষাকে তিনি অভিন্ন বলে বিবেচনা করেন। তাঁর প্রেম ও দ্রোহকে এই দৃষ্টিতে বিচার করাই যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমার মনে হয়।
নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই– প্রথম প্রকাশ ১৯৭০ সালে। এই গ্রন্থের সব কবিতা ষাটের দশকে লেখা, যে-সময়টা

‘উদ্দাম যৌবনতরঙ্গের মতো … মুক্তিমন্ত্রে ফুঁসে উঠেছিল’, যখন ‘নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি হওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না’। কিন্তু তখনো তিনি প্রেমবিবর্জিত ছিলেন না, তবে তাঁর প্রেম ছিল সংগ্রাম-অভিমুখী, বা তাঁর সংগ্রাম ছিল প্রেম-প্রাণিত– ‘তুমি বোললে তাই আমরা এগিয়ে গেলাম,
নিষ্পাপ কিশোর মরলো আবদুল গণি রোডে।’
এভাবে তাঁর প্রেম ও প্রতিবাদ একাকার হয়ে যায়। কবির এই প্রতিবাদ ও দ্রোহ প্রাথমিকভাবে মার্কসবাদী চিন্তাধারাসঞ্জাত; সমাজতন্ত্র যার অভিমুখ। আবার আ শির দশকের শেষদিকে পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনে কবি দ্বিধাগ্রস্ত হলেও হতাশ হননি। কারণ, তিনি ‘দর্শন বা তত্ত্বের চেয়ে মানুষের উপর বেশি আস্থাশীল, … মানুষের মুক্তির জন্যই দর্শন থেকে দর্শনান্তরে, তত্ত্ব থেকে তত্ত্বান্তরে কবির পথপরিক্রমা।’ তিনি মনে করেন, ‘ ‘ছাঁচে-ঢালা’ সংগ্রাম ও দ্রোহের পূর্বপরিচিত সেই পথের সঙ্গে হয়তো মিল থাকবে না, তাই বলে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে আর কখনও মার্কস-লেনিনের দর্শন বা ঐ দর্শননির্ভর সাহিত্যের কাছে ফিরে যাবে না– এমন কথাই বা বলি কী করে।’ তাঁর কাছে ‘কবিতা হচ্ছে কবির মনে রেখাপাত করা আপাতবিশ্বাসের শব্দবদ্ধ বাণীরূপ। বিশ্বাস ও সময়ের অমোচনীয় হৃদ্স্পন্দন।’ এর থেকে আমরা বুঝতে পারি, তিনি তত্ত্ব বা দর্শনের দাস হতে চান না, মানুষের মুক্তিই তাঁর মূল লক্ষ্য, প্রতিবাদ ও সংগ্রাম তাঁর হাতিয়ার। প্রয়োজনে তিনি তত্ত্ব বা দর্শনের বিষয়ে আপস বা সমন্বয় করতেও প্রস্তুত।
বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) প্রথমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং তারই ধারাবাহিকতায় পরে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। চারিত্র্যে কিছুটা প্রগতিশীল হলেও এ-আন্দোলন পুঁজিবাদী ও ঔপনিবেশিক ধারার বাইরে ছিল না। তথাপি, সমকালীন গণচেতনা এবং শাসকশ্রেণির স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে মার্কসবাদীদের একে স্বীকার করে নিতে হয়েছিল। ফলে তাঁদের মধ্যে সব সময়ই জাতীয়তাবাদী চেতনার এক ধরনের প্রভাব কার্যকর পরিলক্ষিত হয়। এরপর বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনে বাংলাদেশেও মার্কসবাদী রাজনৈতিক ধারায় ভাঙন ও পতন দেখা দেয়। চিন্তাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ না করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এদের অধিকাংশই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করেন। নির্মলেন্দু গুণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাঁর অষ্টম কাব্যগ্রন্থ বাংলার মাটি বাংলার জল (১৯৭৮) থেকে এই প্রবণতা ও প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করে, তাঁর কবিতার বিষয় ও ভাষায় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সমকালীন রাজনীতি, প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও প্রেম তাঁর কবিতায় অধিক হারে জায়গা পেতে থাকে। কিন্তু প্রতিবাদের ধারা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি।
নির্মলেন্দু গুণের মার্কসবাদী দর্শন তাঁকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি দান করেছে। বলা বাহুল্য, মার্কসবাদে উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার একটা শক্ত জায়গা আছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রও যে ঔপনিবেশিক হয়ে উঠতে পারে তার নজিরও বর্তমান। গুণের কবিতায় এই দ্বন্দ্বের কোনো ছবি নেই। বরং তিনি ফিলিস্তিন, ভিয়েতনাম, আফ্রিকার প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। এদিক থেকে তিনি ঔপনিবেশিকতাবিরোধী। তাঁর নিসর্গপ্রীতি বহুল না হলেও দুর্লক্ষ নয়। এবং কখনো কখনো তিনি প্রকৃতির ওপর প্রতিবাদের ভাষা ও দ্রোহ আরোপ করেছেন। কিন্তু এই আরোপ স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করেনি।
নির্মলেন্দু গ‍ুণের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ কখনো-কখনো নিসর্গের রূপকল্পেও প্রকাশিত হয়েছে, যা উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্বের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনার সৃষ্টি, বিকাশ ও লালন এবং ঔপনিবেশিকতার প্রতিবাদ ও উচ্ছেদপ্রচেষ্টা যখন নিজস্ব প্রকৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় তখন তাকে উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব বলে। এর প্রয়োগ গুণের কবিতায় সুলভ না হলেও একেবারে বিরল নয়। যেমন– ‘বুকের বোতাম খুলে প্রেমাংশুকে বলিনি কি দেখো,
আমার সাহসগুলি কেমন সতেজ বৃক্ষ;
বাড়ির পাশের রোগা নদীটির নীল জল থেকে
প্রতিদিন তুলে আনে লাল বিস্ফোরণ!’
তাঁর কবিতায় শোষণ-বঞ্চনা, অন্যায়-অবিচার, স্বৈরাচার-ঔপনিবেশিকতার চিত্র এবং তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ, দ্রোহ ও প্রতিবাদ অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। তবে এর জন্য তিনি সরাসরি ঔপনিবেশিকতাকে দায়ী করেন না, বা তাঁর ওপর সচেতন আদর্শ হিসেবে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের ভূমিকা প্রকট নয়। তাঁর কবি-মানস মার্কসবাদের প্রভাবে আন্তর্জাতিকতায় আক্রান্ত হলেও স্বদেশই তাঁর কাছে মুখ্য, এদিক থেকে তিনি প্রবলভাবে জাতীয়তাবাদী। কিন্তু দেশের প্রকৃতি তাঁকে ততটা আকৃষ্ট করতে পারেনি, নিসর্গ তাঁর কবিতায় প্রভাবশীল উপাত্ত নয়।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending