বিবিধ
পুরান ঢাকাইয়ারা কী ভাবে নতুন ঢাকাইয়াদের নিয়ে?
Published
2 months agoon
পুরান ঢাকা বনাম নতুন ঢাকা
ঢাকা ঢাকা ঢাকা! জনপদ হিসেবে ঢাকার গোড়াপত্তন হয় ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে, শহর হিসেবে এর গোড়াপত্তন হয় ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে। সমৃদ্ধিশালী জনপদ হিসেবে ঢাকা কলকাতার চেয়ে ৯৪০ বছরের প্রাচীন।
যদিও প্রথম দিকে, অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে এর ব্যাপ্তি বা প্রসার ছিল খুবই ধীর। সবুজ শ্যামলা, বনে ঘেরা ঢাকা আজ কল্পনা করাও কঠিন। ১৬০০ সালে মোগল, পরবর্তীতে ইংরেজদের শাসন, ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানি আমল, এরপর শুরু হয় স্বাধীনতা পরবর্তী যুগ আর ঢাকার সম্প্রসারণ।
এই ঢাকার এখন দুই রূপ— নতুন আর পুরাতন। বুড়িগঙ্গার তীরে দক্ষিণের এলাকাটি আজকের পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার মধ্যে পড়ে শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার, আমলিগোলা, আজিমপুর, ওয়ারী, বেগমবাজার, ফরাশগঞ্জ, সুত্রাপুর; অর্থাৎ, বুড়িগঙ্গার ধার ঘেঁষে উত্তর-পূর্ব-পশ্চিম তীরের এই অঞ্চলগুলো। এ অঞ্চলগুলোতে যারা বাস করেন, তারা সকলেই যে আদি ঢাকাইয়া বা পুরান ঢাকার মানুষ, তা নয়। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা সমিতি’র দেওয়া মানদণ্ড অনুযায়ী, যেসকল পরিবার আশি বছরেরও অধিক সময় ধরে পুরান ঢাকায় বসবাস করছে এবং ১৯১২ সালের তৈরি ক্যাডাস্ট্রাল মানচিত্রে যাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমির উল্লেখ আছে, তারাই প্রকৃতর্থে ঢাকাইয়া। (ঢাকাইয়াজ অন দ্য মুভ, পৃ ২৮)
ঢাকার সীমানা হলো— দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, উত্তরে তুরাগ, পূর্বে শীতলক্ষ্যা ও পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা। ঢাকা শহর প্রথম থেকেই বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে ক্রমেই উত্তর দিকে সম্প্রসারণ হতে থাকে। দেশভাগ, একাত্তরের পর ধীরে ধীরে দেশের প্রতিটি স্থানের মানুষ পা ফেলতে শুরু করে ঢাকার দিকে। কালের পরিক্রমায় এ শহর বিস্তৃত হয়েছে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকুঞ্জ, উত্তরা হয়ে টঙ্গী-গাজীপুর পর্যন্ত। পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠে বনানী, বারিধারা, নিকেতন, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও পূর্বাচল আবাসিক শহর। পর্যায়ক্রমে এখানকার বাসিন্দাদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করে গড়ে উঠতে থাকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালসহ নানান প্রতিষ্ঠান। এই সম্প্রসারিত অঞ্চলকেই আমরা চিনি ‘নতুন ঢাকা’ হিসেবে, আর এসব এলাকার বাসিন্দাদের ঢাকাইয়ারা বলে থাকেন, ‘নতুন ঢাকার বাসিন্দা’।
নতুন ঢাকার মধ্যেও আছে তারতম্য। বর্তমান সময়ে নতুন ঢাকা বলতে বোঝায় বারিধারা, বসুন্ধরা, গুলশান, বনানী–এ অঞ্চলগুলো; ধানমন্ডি, রমনা, মতিঝিল এখন পুরোনো। আবার অনেকের কাছে ধানমন্ডির জন্মই সেদিন। তাদের কাছে পুরান ঢাকা মানেই মোগল আমলের ঢাকাটুকুই।
নতুন বা পুরান এই বিশাল ঘিঞ্জি জনপদের কেউ কেউ দেশভাগের সময়, কেউবা স্বাধীনতার পরপর ঢাকার বাইরে থেকে এসে থাকা শুরু করেছেন। ঢাকাইয়া সংস্কৃতিতে ঢুকে গেলেও, আদি ঢাকাইয়ার তকমা তারা পাননি। আদি ঢাকাইয়া বলতে যাদের পূর্বপুরুষরা সেই ঢাকার গোড়াপত্তন থেকেই এখানে বসতি গড়েছেন। নতুন ঢাকার মানুষদের কাছে এই পুরান ঢাকাইয়া মানেই অন্য দুনিয়ার মানুষ। ভাষার বৈচিত্র্য, পুরান ঢাকার মানুষের অতিথি আপ্যায়ন, ভোজন বিলাস, অমায়িক ব্যবহার, উৎসবমুখর জীবনের জন্য ঢাকাইয়া জীবনযাপনকে আলাদা একটি সংস্কৃতি হিসেবে ধরা হয়।
পুরান ঢাকাইয়া বলতেই অনেকের ধারণা— তারা সারাবছর সবাইকে নিয়ে আমোদ-প্রমোদে মেতে থাকেন, রাত বারোটায়ও জমজমাট থাকে তাদের রাস্তাঘাট, দেরি করে ঘুম থেকে উঠেন আর দোকানে গিয়ে ডাল-ভাজি-পরোটা দিয়ে নাস্তা সারেন, তারা বিরিয়ানিখোর আর দিলখোলা হাসিখুশি মানুষ— এমন সব ধারণা রয়েছে ঢাকাইয়াদের নিয়ে।
এসব ধারণা সঠিক বা ভুল যা-ই হোক, পুরান ঢাকার জীবন নিয়ে কমবেশি সবার মধ্যেই রয়েছে কৌতূহল। সে এক অন্যরকম রঙ্গিন, শান্তি সুখী আর আনন্দের জীবন।
কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর আমাদের অনেকেরই জানা নেই, তা হলো- এই পুরান ঢাকাইয়ারা আসলে নতুন ঢাকাইয়াদের নিয়ে কী ভাবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কথা বলেছে পুরান ঢাকাইয়াদের সঙ্গে।
‘বোরিং’
সরকারি তিতুমীর কলেজে পড়াশোনা করছেন, শতদল কুমার নাগ। তিনি থাকেন শাঁখারিবাজারে। তার কাছে নতুন ঢাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সবার প্রথমেই আমার মনে হয়, নতুন ঢাকার মানুষ অনেক বোরিং হয়। রাত দশটা বাজলেই নতুন ঢাকার সব বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। কোনো উৎসব বা হৈ-হুল্লোড় নেই তাদের জীবনে। এদিকে আমাদের একটার পর একটা উৎসব লেগেই থাকে। সাকরাইন গেল, দোল গেল, সামনে বৈশাখ, এরপর ঈদ, এরকম কিছু না কিছু লেগেই থাকে।”
একইরকম ধারণা প্রিয়দর্শিনীরও। প্রিয়দর্শিনী থাকেন তাঁতিবাজারে শ্বশুরবাড়িতে। তিনি বলেন, “আমাদের এখানে বিভিন্ন পূজো, সাকরাইন, বৈশাখসহ নানা আয়োজনের প্রস্তুতি চলতে থাকে সারাবছর। আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় পূজো-অর্চনাও লেগে থাকে। কিন্তু আমি শুনেছি নতুন ঢাকায় এসব এত মানা হয়না। ওরাও মজা করে হয়তো ওদের মতো করে। কিন্তু আমাদের এখানে পুরো এলাকা, আত্মীয়-স্বজন মিলে যে একটা আনন্দ— সেটা ওখানে হয়তো নেই।”
শতদলও মনে করেন, পুরান ঢাকার ছেলে-মেয়েরা বেড়ে ওঠে তাদের আত্মীয় পরিজনদের সাথে মিলেমিশে। অপরদিকে, নতুন ঢাকার চিত্র হলো একক পরিবার, বাবা-মা বড় বড় কোম্পানিতে উঁচু পর্যায়ে কাজ করে, ছেলেমেয়েরা বড় হয় একা একা। যে যার বাসায় হয়তো ঘরে বসে ভিডিও গেমস খেলছে, সিরিজ দেখছে, অর্থাৎ চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। ফলে তাদের মধ্যে বিরাজ করে একাকীত্ব, হতাশা।
এমনকি নতুন ঢাকার বয়স্করাও খুব একাকীত্বে ভোগেন। ফলে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি, বিশেষ করে ছোটোদের মধ্যে।
শতদল বলেন, “আপনি এই শাঁখারিবাজারেই গত বিশ বছরে দশটা সুইসাইড পাবেন কি–না সন্দেহ। কিন্তু ওদিকে এটা সাধারণ একটি ঘটনা। এর কারণ একাকীত্ব। আমরা আমাদের বাবা মায়ের সাথে যতটা ফ্রি, সব কথা শেয়ার করি, সেভাবে ওরা পারেনা। এর কারণে অনেকে মাদকের দিকেও ঝোঁকে। আমার যদি দশটা বন্ধু থাকে, এরমধ্যে পাঁচজনই থাকবে যারা কোনো না কোনো নেশা করছে। ছেলেমেয়ে ভেদে সবাই। অথচ, ওদের বাবা মায়েরা জানেওনা।”
শতদল কুমার নাগের মেজো কাকা বিদ্যুৎ কুমার নাগ বললেন, “আমাদের এখানে (শাঁখারিবাজার) বেশিরভাগ যৌথ পরিবার। সবাই একবাড়িতে না থাকলেও কাছাকাছি বাড়িতেই থাকি। আবার আমাদের পূর্বপুরুষরা এখানে বাস করেছেন। তাই এই এলাকার সবাই সবাইকে চেনে। রাস্তার দোকানে সিগারেট খেতে গেলেও কেউ না কেউ দেখে ফেলতো। এইজন্য সিগারেট খাওয়াই ছাড়ে দিলাম। সালাম না দিলেও ডাক দিতেন মুরুব্বিরা। কিন্তু ওইদিকে যে যার মতো চলছে, পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে কেউ জানেও না। ফলে বাচ্চারাও সহজেই ভুল পথে পা বাড়ায়।”
লেখাপড়ার চাপ ও সুযোগ দুটোই বেশি
নতুন ঢাকা নিয়ে পুরান ঢাকাইয়ার ছেলেমেয়েদের অন্যতম একটি বিশ্বাস, নতুন ঢাকার ছেলে-মেয়েদের মাঝে পড়ালেখার চাপটা অনেক বেশি।
শতদল বলেন, “স্কুল কলেজ পর্যায়েই তারা এত বেশি চাপের মধ্যে দিয়ে যায়— অথচ, যদি বোর্ড পরীক্ষার ফলাফলে আমাদের এদিকের সাথে খুব একটা পার্থক্য নেই। ওরা সারাবছর কোচিং, রাতদিন পড়ালেখা করেও জিপিএ–৫ পায়, আমরা ঘুরেফিরে আড্ডা দিয়েও তাই পাই।”
তবে চাপ বেশির পাশাপাশি পড়ালেখার সুযোগটাও বেশি মনে করেন একই সাথে। উচ্চশিক্ষার জন্য নতুন ঢাকার ছেলে-মেয়েরা নিজেদের যেভাবে তৈরি করতে পারে, সেভাবে পুরান ঢাকার ছেলে-মেয়েরা পারেনা বলে মনে করেন শতদল ও তার বন্ধুরা।
আবার দেখা যায়, অবস্থাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির পুরান ঢাকায় চার-পাঁচটা বাড়ি থাকলেও পর্যাপ্ত ব্যাংক ব্যালেন্স থাকেনা। ফলে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ কম। পুরান ঢাকাইয়াদের মাঝে উচ্চশিক্ষার আশা কম। দেখা যায়, তাদের অনেকেই কলেজের পর পারিবারিক ব্যবসায়ে ঢুকে পড়েন। অভিভাবকরাও লেখাপড়া ও সৃজনশীলতার চেয়ে কর্মদক্ষতায় বেশি গুরুত্ব দেন।
এখানকার মেয়েরাও নতুন ঢাকার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে এখনও। আগে ইন্টারমিডিয়েটের পরই বিয়ে হতো, এখন তা বেড়ে অনার্সের পর হয়েছে। নতুন ঢাকায় মেয়েরা যেমন এখন আগে স্বাবলম্বী হতে চান, পুরান ঢাকার মেয়েদের মাঝে সে হাওয়া এখনো লাগেনি বলে তারা মনে করেন। যদিও ব্যাতিক্রম আছে। কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েরাই, অনার্সের পর পর বিয়ে করে ফেলেন এখনো।
তারপরও উত্তরসূরির একটি অংশ এই অচলায়তন ভেঙ্গে দিচ্ছে। তারা উন্নত জীবন এবং সন্তানের পড়ালেখার জন্য পৈতৃক জায়গা ছেড়ে স্থায়ী হচ্ছেন নতুন ঢাকায়।
সবাই অনেক প্রতিষ্ঠিত
তাদের মতে, নতুন ঢাকা মানেই ওখানে সবাই অনেক প্রতিষ্ঠিত, লেখাপড়া জানা এবং ইংরেজিতে দখল আছে। পুরান ঢাকায় যেখানে সবাই পারিবারিক ব্যবসাই দেখাশোনা করেন, সেখানে নতুন ঢাকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে নতুন কিছু করা স্বপ্ন, পশ্চিমা লেখাপড়ার মান এবং কর্মজীবন গড়ার একটি ইচ্ছে থাকে। ফলে ইংরেজিচর্চার প্রবণতাও বেশি।
এ নিয়ে পুরান ঢাকার লেখক ও প্রবন্ধকার সাবু শাহাবুদ্দীন বলেন, “পুরান ঢাকা থেকে যেসব পরিবার সন্তানের উচ্চশিক্ষার এবং উন্নত জীবনের আশায় নতুন ঢাকায় পাড়ি দেয়, তাদের সন্তানদের দেখা যায় হয় স্কলাস্টিকায়, নর্থ সাউথের মতো জায়গায় পড়াচ্ছে। আমি যেমন আমার ছেলেকে ঢাকাইয়া ভাষাতেই কথা বলতে উৎসাহ দিই। নতুন ঢাকায় এ চলটি নেই।”
তিনি বলেন, “সেখানে প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলার রীতি। ফলে ভাষাও নেই, সংস্কৃতিগুলোও মুছে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই ভুলে যেতে চাচ্ছে। কারণ এখানকার যে ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে চাই, তা নতুন ঢাকায় চলেনা। সেখানে উন্নত, আধুনিক এবং পশ্চিমা জীবনচারণকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।’
নতুন ঢাকার মানুষ ধনী
তাছাড়া, নতুন ঢাকার জীবন অনেক বেশি আধুনিক আর উন্নত বলে মনে করেন তারা। এখানকার ঘিঞ্জি রাস্তা, সরু গলি মানুষের হৈচৈ সেখানে নেই। সেখানকার রাস্তাগুলো বড়বড়, খোলামেলা, পরিকল্পিত বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট। নতুন ঢাকা নিয়ে তাদের অন্যতম বদ্ধমূল একটি ধারণা হলো- নতুন ঢাকা মানেই ধনী। নতুন ঢাকার মানুষদের আয় বেশি, ব্যয়ও বেশি। টাকা আছে বলেই ঢাকায় এসে জায়গা কিনে বাড়ি করে এত উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। না থাকলে কি বাইরে থেকে এসে এত টাকা দিয়ে জমি কিনে, এত খরচের জীবন চালানো যায়?
এ নিয়ে সাবু শাহাবুদ্দীন বলেন, “পুরান ঢাকার একটা দশ বছরের ছেলে পুরী পেঁয়াজু খতে পছন্দ করে, কিন্তু নতুন ঢাকার সে ছেলেটি খেতে চাইবে বার্গার, চিকেনফ্রাই, স্যান্ডুইচ। আবার নতুন ঢাকার একটি জন্মদিন মানেই এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে ট্রিট দেওয়া, বাইরে রেস্টুরেন্টে বসে ফাস্টফুড খাওয়ানো। আর আমরা আমাদের সন্তানের জন্মদিনে বন্ধুবান্ধবদের বাসায় ডাকি। মা ঘরে রান্না করে, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনও আসে। সবাই একসাথে ঘরের মধ্যে পালন করি।”
“তবে নতুনদের মতো তারাও বাইরে খেতে যান। সেটা ওয়াফেল, ডোমিনোজ আর কেএফসি না হয়ে হয় বিরিয়ানি, কাবাবের দোকান। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও অনেক দেখা যাচ্ছে এখন,” বলেন তিনি।
যান্ত্রিক জীবন
পুরান ঢাকাইয়াদের যেখানে ভাবা হয় তারা অনেক উদার, অতিথিপরায়ণ এবং আড্ডাবাজ। সেখানে নতুনদের নিয়ে তাদের ধারণা একদমই বিপরীত। বরং তারা মনে করেন, অনেকটা বিদেশিদের মতো জীবনব্যবস্থা নতুন ঢাকায়।
শাহাবুদ্দীন বলেন, “পুরান ঢাকায় যেমন মন চাইলে চাচাতো ভাইয়ের দরজায় বেল টিপে গিয়ে আড্ডা মেরে আসা যায়, ওখানে তা না। তাদের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিতে হবে। তাদের সময় নাই, তারা ব্যস্ত। আমাদের এখানে একটা দরকারে সবাই যেভাবে দৌড়ে আসবে, সেটা ওখানে আশাই করা যায়না। কারণ তাদের সময় কোথায়? যন্ত্রের মতো ছুটতে হচ্ছে তাদের।”
নতুন ঢাকাইয়াদের নিয়ে ঢাকাইয়াদের একটি মন্তব্য খুব শোনা যায়, ‘বাহির থেকে এসে সব নিয়ে নিছে। আমরা ঢাকায় থেকেও তা পারিনি।’
এ প্রসঙ্গে শাহাবুদ্দীন বলেন, “আমরা ঢাকাইয়ারা কয়েক পূর্বপুরুষ ধরে থেকেও নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে পারিনি। কিন্তু বহিরাগতরা এসে ঠিকই নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। তারা খুব পরিশ্রমী। আমরা আরাম আয়েশ করতে গিয়েই আজ এ জায়গায় এসেছি। এটি আমাদের আফসোস।”
‘শো অফ’ বা দেখানোর প্রবণতা
তারা ধনী, তাদের সামাজিক পদমর্যাদা উঁচু, তারা আশরাফ। ফলে, সবকিছুতে একধরনের ‘শো অফ’ বা দেখানোর প্রবণতা থাকে বলে মনে করেন সাহাবুদ্দীন।
তিনি বলেন, “পুরান ঢাকার কোনো বিয়ে হলে ধরেই নেই একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে যাব, সেখানে বউ কে সেটা বোঝা যাবেনা। আর নতুন ঢাকার কোনো বিয়ে হলেই জানি ওখানে গিয়ে কোনো হৈচৈ করা যাবেনা। খাবার টেবিলে থাকবে একটা কাঁটা চামচ, একটা ছুরি। হাত দিয়ে খেতে গেলে ভাবতে হবে। কবজি ঢুকিয়ে খাওয়া যাবে না। প্রাণ খুলে মেশা যাবেনা। তারা খুবই প্লেইন এবং এলিয়েনেটেড। আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সব হবে। পুরান ঢাকার একটা বিয়েতে এসব ছুরি কাঁটাচামচ পাবেন না। তাদের বিয়ে সাতদিন ধরে। টাকা পয়সা তুলে এনেও শৌখিন গরীবরা অনুষ্ঠান করে।”
“নতুন ঢাকায় যখন কেউ বিয়ে করে, ধরেই নেওয়া হয় তারা আধুনিক, বিচ্ছিন পরিবেশে ঢুকে যাচ্ছে। দূরে সরে যাচ্ছে। পুরান ঢাকায় বিয়ে করলে হৈচৈ, আসা যাওয়া থাকে। এই যেমন শবে বরাত গেল, আমি আমার এখানের সব আত্মীয়-স্বজনের বাসায় হালুয়া রুটি পাঠিয়েছি,” বললেন শাহাবুদ্দীন।
একইরকম ধারণা রাখেন বিদ্যুৎ কুমার নাগও। তিনি বলেন, “নতুন ঢাকার মানুষ বিচ্ছিন্ন থাকবে, সামাজিক স্ট্যাটাস মেনে চলবে। ফাইভ স্টার হোটেলে যাবে। ব্র্যান্ডের কাপড় পড়বে। আর এখানে কারও দশটা বাড়ি থাকলেও সে কাউকে বুঝতে দেবেনা।”
“নতুন ঢাকার বিয়ে হলো বনেদিয়ানা। আর আমাদের হলো সামাজিকতা। সেখানে সবকিছু টাকা দিয়ে করানো যায়। আর আমরা এদিকে বিয়েতে নিজেরা কাজ করি। আমি ওখানে গেলে আমাকে চিনবেই না। আর আমার এখানে নতুন কেউ আসলে তাকে গেট থেকে ধরে নিয়ে এসে একদম ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসব। আর এখানে আমরা টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে করার চেয়ে নিজেরা নিজেরা হাতে হাত লাগিয়ে করে ফেলি। কারও সামর্থ্য না থাকলে চান্দা তুলে করে ফেলি। এটাই ওখানের সাথে পার্থক্য,” যোগ করেন বিদ্যুৎ।
আরাম আয়েশ না সুখ?
রাজধানীর অন্যতম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষে পড়ছেন অপূর্ব। থাকেন পুরান ঢাকাতেই। তিনি বলেন, “আমি এখানে একরকম। আমার ক্যাম্পাসে আরেক রকম। ইউনিভার্সিটিতে যেভাবে চলি, সেটা আমার এলাকার মানুষ দেখলে পছন্দ করবেনা। কারণ তারা এখনো আগের ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী। আমি নিজেও ওখানে ওভাবেই মিশি। কিন্তু আমার পছন্দ আমার এই ঢাকাইয়া কালচারই। এখানে সবাই সবাইকে চেনে। বিপদে আপদে পাশেই থাকে। করোনায় সবাই যখন ঘরে বন্দী, আমরা ঠিকই এ বাসা ওই বাসায় গিয়ে সাহায্য করে আসছি। আমরাও আক্রান্ত হবো ভেবে দরজা জানালা আটকে বন্দি হয়ে থাকিনি।”
তবে নতুন ঢাকার কিছু জিনিস অপূর্বর ভালো লাগে। তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। অবশ্য তা স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই। আর দ্বিতীয়টি হলো, ভালো লেখাপড়া এবং ‘ক্যারিয়ার’ সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা।
ওখানে থাকলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই হয়তো অন্যরকম হতো বলে জানান অপূর্ব। কিন্তু এই জায়গাটি ছেড়ে যাবার কথা ভাবলে তার দমবন্ধ হয়ে আসে। কারণ মনের শান্তি এখানেই। নতুন ঢাকার মানুষের মধ্যে যেমন প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন থাকে, এদের তা থাকেনা। বরং এখানের লোক এভাবেই বসবাস করতে চায়।
যারা এই ধারা থেকে বেরিয়ে একটু উন্নত এবং স্বাভাবিক জীবন চান, তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে পৈতৃকভিটা ছেড়ে থাকছেন নতুন ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীতে। কিন্তু অপূর্ব, শতদল, বিদ্যুৎ কুমার নাগ কিংবা সাবু শাহাবুদ্দীনের মতো এখনো বড় একটা সংখ্যা চাননা নতুন ঢাকার সংস্পর্শে এসে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যাক। নতুন ঢাকার মতো আদব-কায়াদাতে আধুনিক হওয়ার কোনো ইচ্ছেও নেই তাদের। এখানের ছেলেরা এখনো লুঙ্গি পরে বের হতে পারে বাসা থেকে। আধুনিকতা এসে নতুনদের মতো তাদের ছেলেরাও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে রাস্তায় ঘুরুক তেমনটা চাননা। কিছুটা রক্ষণশীলই থাকতে চান।
তবে সেখানকার উন্নত স্বাস্থ্যসেবা বা পড়ালেখার সুযোগ-সুবিধা দেখে যদিও বা ইচ্ছে হয়। আবার পরমুহূর্তেই মনে করেন, সামাজিক অবস্থানটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘বিশ লাখ টাকা দিলেও যাব না ওদিকে। অর্থ কম আছে, কিন্তু পরিচয় আর সম্মান বেশি আছে। এখানে রাস্তা দিয়ে না তাকায় হাঁটলেও চিনবে সবাই আমাকে। ওখানে কেউ চিনবেনা। তো সে-ই উন্নত জীবন দিয়ে কী সুখ?’- এমনটাই বক্তব্য তাদের।
কারণ তাদের বিশ্বাস, এই সামাজিক যোগাযোগ, মেলামেশা, একতাই তাদের সুখ শান্তির প্রধান কারণ। ফলে আধুনিক হতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন জীবন তাদের প্রত্যাশা নয়।
অপূর্ব বলেন, “ওদের জীবনে অনেক সুযোগ-সুবিধা, আরাম আয়েশ। কিন্তু সুখ নেই এমনটা মনে হয় আমার। বলা যায় না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যেতে হতে পারে আমাকেও। কিন্তু আমি নিজে যেতে চাইনা। যাব যে, ভবিষ্যৎ ভালো, জীবন আরামদায়ক- এছাড়া কিছু তো দেখিনা ওখানে ভালো। বরং শান্তিটা এখানেই।”