বিবিধ
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যদর্শন | রাজীব সরকার
Published
4 months agoon
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যকে যারা পরিমাণে ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে আসবে বুদ্ধদেব বসুর নাম। শুধু একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক হিসেবে বুদ্ধদেবের ভূমিকা সীমাবদ্ধ নয়। সাহিত্য সংগঠক ও প্রকাশক হিসেবেও বাংলা সাহিত্যকে পূর্ণতা দিয়েছেন তিনি। তরুণ প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিক আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা তুলনারহিত। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, পত্রসাহিত্য, আত্মজৈবনিক রচনা, সমালোচনা, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণকাহিনি, মহাভারতের নবরত ব্যাখ্যা—অতুল বৈভবমণ্ডিত সৃষ্টিজগতের অধীশ্বর বুদ্ধদেব। যুগস্রষ্টা সম্পাদক তিনি, কবিতা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন।
এভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার শিক্ষক। শুধু আধুনিকতার নয়, সাহিত্যচর্চারও। লিখতে যে শিখতে হয়, এ কথা তার আগে স্পষ্ট করে কেউ বলেননি। জোর দিয়ে বলেছেন, লিখতে শেখার একমাত্র উপায়—পড়া। ‘লেখার ইস্কুল’ প্রবন্ধে বলেছেন—‘…প্রতিভাবান চিত্রকরও আর্ট স্কুলে হাত পাকিয়ে থাকলে লজ্জাবোধ করেন না, সংগীতের স্কুলেও সাংগীতিকের উপকৃত হবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু লেখার কোনো ইস্কুল নেই। যে-লোক একখানা সাধারণ চিঠিও লিখতে পারে না, সেও মনে করতে পারে যে লেখক হওয়ার যোগ্যতা তার আছে। যেহেতু আমি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত, ইচ্ছে করলেই আমি লেখক হতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে করলেই লেখক হওয়া যায় না, লিখতে ও শিখতে হয়।’
শুধু লিখতে বুদ্ধদেব, লিখতে শিখিয়েছেনও। একজন নিষ্ঠাবান ঋষির মতোই সাহিত্যে ধ্যানমগ্ন ছিলেন তিনি আজীবন। রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর তৈরিতে বুদ্ধদেব বসু পালন করেছেন কেন্দ্রীয় ভূমিকা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পক্ষে সবচেয়ে বলবান প্রচারক ও সংগঠক তিনি। বিরুদ্ধপক্ষের আক্রমণের তিনিই ছিলেন মূল লক্ষ্য। সাহিত্যচর্চার শুরু থেকেই বিতর্ক তার সঙ্গী। এ বিতর্ক কখনো সাহিত্যিক কারণে, কখনো রাজনৈতিক কারণে। পিছু হটেননি তিনি।
বুদ্ধদেব জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, শিল্পসাহিত্যের কোনো সামাজিক উপযোগিতা বা লক্ষ্য থাকতে পারে না। এ কালের শিল্পীসমাজ বিচ্ছিন্ন। শার্ল বোদলেয়ার : তার কবিতার ভূমিকায় তিনি বলেছেন : ‘যে মধ্য-উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে উপযোগবাদের অভ্যুদয় হলো, সেই সময়ে বোদলেয়ার ঘোষণা করেন যে কবি কোনো “কাজে লাগেন না”। বায়রনি বিদ্রোহের দিন গত হয়েছে, পূর্ণ হয়েছে সমাজের সঙ্গে কবির বিচ্ছেদ; প্রতিবাদ করলেও প্রতিবাদের পাত্রকে স্বীকার করে নিতে হয়, অতএব, একমাত্র যা সহনীয় ও সম্ভব তা উপেক্ষা ও স্বেচ্ছাবৃত নির্বাসন।’
এ বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায় কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠেও। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ২৪ মে ১৯৪১ সালে বুদ্ধদেবকে প্রেরিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘আমরা এই ইতিহাসের দ্বারাই একান্ত চালিত এ-কথা বারবার শুনেছি এবং বারবার ভিতরে ভিতরে খুব জোরের সঙ্গে মাথা নেড়েছি। এ তর্কের মীমাংসা আমার নিজের অন্তরেই আছে, যেখানে আমি আর কিছু নই—কেবলমাত্র কবি। সেখানে আমি সৃষ্টিকর্তা, সেখানে আমি একক, আমি মুক্ত। বাহিরের বহুতর ঘটনাপুঞ্জের দ্বারা জালবদ্ধ নই।’
অথচ কলাকৈবল্যবাদের অনুসারী হিসেবে বুদ্ধদেবকেই সবচেয়ে বেশি সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখিত ‘সহে না সহে না আর জনতার জঘন্য মিতালী’ এবং বুদ্ধদেব উচ্চারিত ‘প্রান্তরে কিছুই নেই; জানালার পর্দা টেনে দাও’-এর মতো কিছু পঙ্ক্তি বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে বুদ্ধদেব এবং তার সহযাত্রী কবিবৃন্দ কতটা ‘জীবনবিমুখ’ ছিলেন। উপযোগিতামূলক সাহিত্য রচনার বিরোধী ছিলেন বলে বুদ্ধদেব এবং তার সঙ্গীরা অভিহিত হয়েছিলেন ‘পলায়নবাদী’ হিসেবে। এ অভিযোগ অসামান্য যুক্তিনিষ্ঠায় তিনি খণ্ডন করেছিলেন ‘পলায়ন’ প্রবন্ধে : ‘আমি যদি কবি হই তাহলে কবি হিসেবে আমার কর্তব্য ভালো কবিতা লেখা, তা ছাড়া কিছু নয়, জীবনের সঙ্গে সেই আমার যোগসূত্র। আমি যদি বাণিজ্য কি রাজনীতি সম্বন্ধে মূঢ় হই, ফুটবল কি ঘোড়দৌড়ের খবর না রাখি, তাহলে ক্ষতি কি? আমি বরং বলবো, ভালো কবিতা লেখবার জন্যে যে-রকম জীবন আমার নিজের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল বলে জানি আমি চাইবো আমার জীবনকে সে-ভাবেই গড়তে, সেটা এস্কেপিজম নয়, সেটা শুভবুদ্ধি।
এখানেও কবিতে কবিতে প্রভেদ হবে; কেউ চাইবেন নির্জন আত্মনিমগ্ন জীবন, কেউ বা সামাজিক জীবনের জটিলতা, অন্য কেউ হয়তো “ছাত্র আর মজুরের উজ্জ্বল মিছিল” থেকে প্রেরণা পাবেন—বেশিরভাগই কখনো এদিক কখনো ওদিক ঝুঁকবেন; সম্পূর্ণ আত্মসংহত কি সম্পূর্ণ বহির্ব্যাপ্ত কোন কবিই বোধ হয় নন, তবে বিশেষ এক দিকে পক্ষপাত সকলেরই ধরা পড়ে—সাহিত্যেও অভ্যন্তরীণ তাগিদ হিসেবে ও সবেরই সমান মূল্য, এর মধ্যে বিশেষ কোন-একটিকে গ্রহণ না-করাটাই পলায়নী মনোবৃত্তি এ-কথা বললে আর যা-ই হোক, সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু বলা হয় না।’
সাহিত্যকে প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক লক্ষ্য সাধনের অস্ত্র করে তোলার তীব্র বিরোধী বুদ্ধদেবকে আমরা ভিন্নরূপে আবিষ্কার করি ১৯৪২ সালে। সেই সময় ঢাকায় কমিউনিস্ট কর্মী ও তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ দাঙ্গাবাজদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এ নারকীয় ঘটনার প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে বুদ্ধদেব ‘প্রতিবাদ’ নামে একটি তাৎপর্যমণ্ডিত কবিতা লিখেছিলেন :
‘ক্ষমা? এরও কি ক্ষমা আছে? এ-উন্মত্ত হননবৃত্তিরে নীরবে সহিতে পারে এত বড়ো মানব মহিমা জানি না সম্ভব কিনা।’
কবিতাটি শেষ করেছিলেন এই সংকল্প ঘোষণা করে ‘পশুত্বের প্রতিবাদে নিখাদে রেখাবে আজ হোক উদ্দীপিতা। আমার কবিতা।’ নজরুল লিখিত ‘প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/ যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ’-এর সঙ্গে বুদ্ধদেবের সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
শুধু একটি কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি তিনি। ১৯৪২ সালে ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘ’ গঠিত হওয়ার পর সেই সংঘে যোগ দেন বুদ্ধদেব। রচনা করেন ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম’ নামে একটি বলিষ্ঠ প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শুরুতেই বুদ্ধদেব স্বীকার করেছেন রাজনীতি তার জীবনে কখনো আলোচনার বিষয় ছিল না। সাহিত্য সাধনাই তার ‘জীবনের মূল প্রেরণাশক্তি’। ‘নিরিবিলি ঘরের কোণে বসে পড়াশোনো করতে’ ও ‘মাঝে মাঝে এক-আধটা কবিতা লিখতে’ চান তিনি। এ জন্য যে শান্তির প্রয়োজন সেই শান্তি বিপন্ন হয়েছে ‘সংস্কৃতির প্রতিশ্রুত শত্রু’ ফ্যাসিবাদের তাণ্ডবে। তাই ফ্যাসিবাদের মতো একটি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাকে লিখতে হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ ‘মনুষ্যত্বের অবমাননা ও সভ্যতার বিনাশ’-এরই অপর নাম। ‘কমিউনিস্টবিরোধী’ বলে পরিচিত বুদ্ধদেব বসু এ প্রবন্ধে রাশিয়াতে মনুষ্যত্বের পূর্ণ মর্যাদাদান ও সভ্যতার পূর্ণ বিকাশের প্রশস্তি গেয়েছেন। রাজনীতিবিমুখ বুদ্ধদেব অপকটে বলেছেন : ‘শান্তির সময়, সুখের সময় নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব, হয়তো সে অবস্থাই স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল, কিন্তু চারিদিকে যখন অশান্তির আগুন লেলিহান হয়ে জ্বলে উঠে তখন কবি বলো, শিল্পী বলো, ভাবুক বলো, কারো পক্ষেই মনের মধুর প্রশান্তি অক্ষুণ্ন রাখা আর সম্ভব হয় না, যার প্রাণ আছে তার প্রাণেই ঘা লাগে। …তাই আজ পৃথিবী ভ’রে লোক যখন তার বীভৎসতম মূর্তিতে প্রকট তখন আমরা কবিরা, শিল্পীরা স্বভাবতই, নিজের প্রকৃতির অদম্য টানেই, ঐ বীভৎসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো—এর মধ্যে রাজনীতির কোনো গূঢ়তত্ত্ব নেই, আমাদের মনুষ্যত্বের, কবিচরিত্রের এটা ন্যূনতম দাবি।’
ফ্যাসিবাদবিরোধী ও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমর্থক বুদ্ধদেব বসুর রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায় ‘ফ্যাসিবাদ, শিল্প ও বিশ্বমানব’ প্রবন্ধেও—‘শিল্পীর যেটা সত্য পরিচয় সেটা কখনোই নঞর্থক হতে পারে না; তিনি যে শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে এ-কথা বললে তাকে অনেকটা ছোট করে দেখা হয়; তিনি যে প্রেমিক, তিনি যে বিশ্বমানবিক, তিনি যে দেশকালের সমস্ত সংস্কারের ঊর্ধ্বে, তিনি যে মনুষ্যধর্মের পুরোহিত এটাই তার সম্বন্ধে আসল কথা। …রোমা রোলাঁর বিখ্যাত বাণী আজ আমরা নিজেদের বাণী বলে গ্রহণ করবো : সকল উৎপীড়কের বিরুদ্ধে, সকল উৎপীড়িতের সঙ্গে।’
বুদ্ধদেব বসুকে তাই সমাজবিচ্ছিন্ন সাহিত্যিক বলা যাবে না। শিল্পের বিশুদ্ধতা রক্ষায় ব্রতী হয়েও যে সমাজ ও জীবনের বহুমাত্রিকতাকে ধারণ করা যায়, এর উজ্জ্বল উদাহরণ বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যচর্চা।