বিবিধ
ব ই আ লো চ না | মার্কেজের অসন্তুষ্ট সমাপ্তি
Published
3 months agoon
জীবনের শেষ বছরগুলোতে গ্যাবোর স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছিল। লিখতে গিয়ে স্মৃতিবিভ্রাট নিয়ে বেশ ভুগছিলেন। এ নিয়ে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘স্মৃতি একই সঙ্গে আমার উৎস এবং হাতিয়ার। এটা ছাড়া কিছুই নেই।’
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ২০১৪ সালে মারা যান। এ বছর মরণোত্তর তার শেষ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। যদিও ‘আনটিল আগস্ট’ বা ‘আগস্ট পর্যন্ত’ নামের এ উপন্যাসটি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না গ্যাবো। ১৯৯৭ সালে এর রচনা শুরু করলেও, পরবর্তীকালে অন্য উপন্যাসে হাত দেওয়ায় এ লেখাটিকে তিনি বহুদিন ফেলে রেখেছিলেন। তবে জীবনের শেষ দিনগুলোতে যখন আবার তিনি এটিতে হাত দেন, তখন স্মৃতিবিভ্রাটের কারণে উপন্যাসটির অনেক কিছুই তিনি আর মনে করতে পারছিলেন না। অর্থাৎ উপন্যাসটি নিয়ে তার প্রথম দিককার চিন্তা, এর প্লট নিয়ে তার পরিকল্পনা, চরিত্রের নানা বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি কিছুই আর তখন তার কাছে আগের অবয়বে নেই।
তবু সেই অবস্থাতেই মার্কেজ উপন্যাসটি নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। স্মৃতিদুর্বলতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে তিনি তার অভিজ্ঞতার মার্কেজকে বা মার্কেজীয় মানকে খুঁজে পাননি।
এসব কারণে তিনি তার দুই ছেলেকে এ পাণ্ডুলিপিটি তার মৃত্যুর পরও প্রকাশ করতে নিষেধ করে গিয়েছিলেন।
২০০৪ সালে মার্কেজ বলেছিলেন, এ উপন্যাসটির প্রোটাগনিস্টকে নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট হলেও, উপন্যাসটির বর্তমান সংস্করণটি তার মনঃপূত হয়নি। পরবর্তীকালে তিনি উপন্যাসটি আর শেষ করেননি। উপরন্তু জীবনের শেষ দিনগুলোতে মার্কেজ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। উপন্যাসটি আর উপযুক্ত সমাপ্তির মুখ দেখেনি।
মার্কেজের মৃত্যুর পর পাণ্ডুলিপিটি টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের রেনসাম সেন্টার আর্কাইভে রাখা হয়েছিল। তার পরিবার যদিও এটি আর কখনোই প্রকাশ করবে না বলে ভেবেছিল, কিন্তু ২০২২ সালে গার্সিয়া মার্কেজের ছেলেরা পাণ্ডুলিপিটির পুনর্পাঠ করে। মার্কেজ উপন্যাসটির সমস্যার কারণে যদিও এর প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গিয়েছেন, তবু এ সময়ে তার সন্তানরা পাণ্ডুলিপিটির সাহিত্যিক মূল্য বিবেচনা করে এটির সম্পাদনা ও প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ বছর ৬ মার্চ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ৯৭তম জন্মবার্ষিকীর দিনে প্রকাশিত হয় তার শেষ উপন্যাস ‘আগস্ট পর্যন্ত’। যদিও বাবা এবং লেখকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশ করার কারণে সুধীসমাজে নানারকম সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছিল।
এ উপন্যাসটিও তার ‘মেমোরিজ অব মাই ম্যালানকলি হোর্স’ বা ‘আমার স্মৃতির বিষাদ গণিকারা’ (২০০৫) উপন্যাসের মতো অনেকটা বয়স্ক মানুষদের মধ্যকার প্রেমের ঘটনাবহুল। তবে মার্কেজ সাধারণ যে বিষয়ের জন্য জগদ্বিখ্যাত হয়েছিলেন, অর্থাৎ তার জাদুবাস্তবতা—সেই ঘরানা এই ‘আগস্ট পর্যন্ত’ উপন্যাসে নেই। এটি আনা ম্যাগডেলেনা বাচ নামের এক নারীর গল্প। একজন পঞ্চাশোর্ধ সুখী বিবাহিত নারী, যে কি না প্রতি বছর ১৬ আগস্ট তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে দূরের এক ক্যারিবিয়ান দ্বীপে যায়, তার মায়ের কবরে। মার্কেজের প্রথম কোনো নারী প্রোটাগনিস্ট বা প্রধান চরিত্রকে দেখা যায় এ উপন্যাসে। যার ৫৪ বছর বয়সী সুদর্শন ও সপ্রতিভ সংগীত সমালোচক এক স্বামী এবং দুই ছেলেমেয়ে থাকার পরও মায়ের কবর দেখতে দ্বীপে গিয়ে প্রতি বছরই নতুন অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গে রাত্রিবাস করে আসে।
মার্কেজের অনেক গল্প বা উপন্যাসের মতো আনা ম্যাগডালেনা চরিত্রটিও জটিল মনস্তাত্ত্বিকতা, অস্বাভাবিক প্রেম, ঈর্ষা ইত্যাদিতে পূর্ণ। সে দ্বীপ থেকে ফিরে অনুভব করে, যেন তার জীবন আর আগের মতো নেই।
বইটিতে নৈতিকতা, অবিশ্বস্ততা এবং বিশ্বাসঘাতকতার মতো নানা মানবিক দিকের প্রকাশ রয়েছে। প্রতিবার দ্বীপ থেকে বাড়ি ফেরার সময় আনার উদ্বেগ পাঠককে তার ইচ্ছা ও মানসিক অবস্থার সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত করে তুলতে পারে। আর অবধারিতভাবে মার্কেজের শব্দের চমক তো রয়েছেই। তবে উপন্যাসের নানা জায়গায় অসংলগ্নতার ছাপ থাকা সত্ত্বেও মার্কেজের লেখক জীবনের পরম্পরাগত বাস্তবতা বুঝতে এ উপন্যাসটিও সাহিত্যজগতে নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখবে। হোক না সেটা সমস্ত জীবন চমকপ্রদ সাহিত্যপ্রসাদ দিয়ে যাওয়া লেখকের অসন্তুষ্ট এক পরিসমাপ্তি।