Connect with us

বিবিধ

সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার : কোনোদিন লিখবো বা সাহিত্যিক হবো, কখনও ভাবিনি

Published

on

সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার : কোনোদিন লিখবো বা সাহিত্যিক হবো, কখনও ভাবিনি

কল্পবিজ্ঞান বিষয়ে সত্যজিৎ রায় বরাবরই গভীর আগ্রহী ছিলেন। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি ও অন্যান্য লেখালিখির মধ্যে তার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। এই বেতার সাক্ষাৎকারে কল্পবিজ্ঞানের মত অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত একটি বিষয় নিয়ে সত্যজিৎ নিজের ভাবনাচিন্তা অকপটে প্রকাশ করেছেন। সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৮২ সালে। আকাশবাণীর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ডঃ অমিত চক্রবর্তী ও সাহিত্যিক সঙ্কর্ষণ রায়। তারই অংশবিশেষ নিউইয়র্ক সময় পাঠকদের জন্য পত্রস্থ হলো।

সঙ্কর্ষণ: সাহিত্যে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য… এই নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, এবং আজকাল একটা বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা বা science fiction এসবও বিশেষভাবে লেখা হচ্ছে। কিন্তু আমার নিজের একটা ধারণা যে সাহিত্য বিজ্ঞানভিত্তিক না হলে সেটা সার্থক হয়না। আচ্ছা সত্যজিৎবাবু, এ বিষয়ে আপনার কী মনে হয়?
সত্যজিৎ: হ্যাঁ, মানে একটা তো গেল যাকে কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলা হয়। যেটা science fiction-ই বলুন বা science fantasy-ই বলুন, সেটা তো আলাদা একটা জাতের মধ্যেই

পড়ে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, সাধারণ গল্পে আপনি যদি মানুষদের নিয়ে, মানুষদের কথা লেখেন, সেখানেও একটা বিজ্ঞানের দিক তো সবসময়েই এসে যাচ্ছে যেটা মনস্তত্ব বলা যেতে পারে। যে মানুষের মন, বিশেষ করে আমার ছবি-টবিতে, আমার গল্প-টল্পতে সবসময় মানুষের মন একটা বড় ভূমিকা গ্রহণ করে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক, তাদের ব্যবহারের কথাবার্তা…সবকিছুর মধ্যে যে একটা সত্য যেটাকে বলে, বা যে truth টার দিকে আমরা যেতে চেষ্টা করি..
সঙ্কর্ষণ: আপনি এই যে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা বা কল্পবিজ্ঞানমূলক যে কাহিনি বা উপন্যাস যা লিখছেন, এই লেখার মধ্যে কী করে এলেন?
সত্যজিৎ: এলাম মানে, আমার তো লেখার কোনো প্রশ্নই ছিল না। কোনোদিন যে লিখবো, বা সাহিত্যিক হবো, বা আমাকে একদিন গপ্পো ভাবতে হবে বসে, লিখতে হবে, এ আমি কোনোদিন ভাবিনি। আমি বিজ্ঞাপনের আপিসে কাজ করতাম, তারপর সেটা ছেড়ে ফিল্মে ঢুকলাম। ফিল্মের কাজ করছি, তখন একদিন আমার বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় হঠাৎ বললেন যে সন্দেশ-টাকে আবার বের করলে কেমন হয়। মনে ধরল ব্যাপারটা, এবং তার ৬ মাসের মধ্যেই ১৯৬১ তে সন্দেশ আমরা আবার নতুন করে বার করি। সুভাষ এবং আমি সম্পাদক ছিলাম, এবং সন্দেশ বেরোনোর পর, স্বভাবতই আমার মনে হলো যে এবার একটু লিখতেই হয়ত হবে.. আর কিছু না হোক সন্দেশ-কে feed করার জন্যে। তা আমার প্রথম গল্পই বলতে পারেন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, যদিও সেটা প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প না, সেটা হচ্ছে ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’। এটা আমার জীবনে প্রথম বাংলা গল্প। এবং পরে এই গপ্পোটা.. পরে যদি সেটার প্রসঙ্গে আসা যায় আসা যাবে, সেটা হচ্ছে এই গপ্পোই ভিত্তি ছিল পরে যখন আমি ফিল্মের চিত্রনাট্য করি। যাই হোক, বঙ্কুবাবুর বন্ধু লেখার পর আমি দু একটা ভুতের গল্প এ গল্প সে গল্প লিখে, তারপর আমার মনে হলো যে এই শঙ্কু ধরনের একটা চরিত্র… ডায়েরি form-টার কথা মনে হলো যে এটা হতে পারে… এবং এটা বোধহয় subconsciously আমার খানিকটা কাজ করেছিল হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি… আমার বাবার লেখা, সেটা আমার ভয়ানক একটি প্রিয় লেখা… সেটাতেই উনি Conan Doyle এর Lost World বা অজ্ঞাত জগতকে নিয়ে একটু ঠাট্টা করেছিলেন। সেখানে বাবা যেগুলো তৈরি করেছিলেন একেবারেই কাল্পনিক কিছু প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ার, তাদের নাম ধাম স্বভাব চরিত্র সবই তার সঙ্গে এমনি কোনো বই খুলে সেসব জানোয়ারকে পাওয়া যাবে না।

অমিত: যেন পুরোটাই মজা করার জন্যে…..
সত্যজিৎ: পুরোটাই মজা করার জন্য, পুরোটাই ঠাট্টা করার জন্যে, leg pull করার জন্যে। বলা যেতে পারে, ওটা নিয়ে একটা রঙ্গ রসিকতা। তা আমারও প্রথম যেটা শঙ্কু, যেটা ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’, তার মধ্যে এই মেজাজটা বর্তমান। শঙ্কু যদিও ডায়রি লিখছে এবং আপাত দৃষ্টিতে তাকে সিরিয়াস বলে মনে হবে, কিন্তু তার প্রথম যে invention, যে নস্যাস্ত্র.. snuff gun… নস্যির বন্দুক, সেটা মারলে মানুষকে ছাপান্নবার হাঁচতে হবে… এই ধরনের কতকগুলো ব্যাপার ছিল। তা সেইটা লেখার পরে কিন্তু ক্রমে ক্রমে শঙ্কু সিরিয়াস হয়ে গেছে। শঙ্কু সিরিয়াস হয়ে গেছে, কেননা ওইটা লেখার পরে আমি ভীষণভাবে বিজ্ঞান সংক্রান্ত কাগজ, বইপত্র পড়তে আরম্ভ করলাম। এবং আরও অন্যান্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা… তখন একটা ভীষণ নেশা চাপল, Asimov বলুন, Arther Clarke বলুন, Bradbury, তারপর Theodore Sturgeon ইত্যাদি বিদেশের যারা নামকরা লেখক তাদের লেখাও ভীষণ পড়তে আরম্ভ করলাম। এবং তারপরে কতকগুলো science fiction এর একেবারে প্রধান কতকগুলো বিষয়বস্তু বা থিমগুলো একটার পর একটা ধরে ধরে আমি শঙ্কুর মধ্যে দিয়ে সেগুলো ব্যবহার করতে লাগলাম। সে invisibility-ই বলুন, বা longevity-র ব্যাপার বলুন, brain-এর ব্যাপার বলুন, বাইরের থেকে প্রাণী আসার ব্যাপার বলুন, বা এখান থেকে বাইরের কোনো গ্রহে যাওয়ার ব্যাপার বলুন; কতকগুলো মূল ব্যাপাট রয়েছে যেগুলো প্রত্যেক science fiction লেখক-ই একবার না একবার ব্যবহার করেছেন। সেই থিমগুলো নিয়ে নিয়ে.. আর কতকগুলো জায়গা সম্বন্ধে তো আমাদের ভয়ানক fascination থাকে… নিশ্চয় আপনারও আছে সঙ্কর্ষণবাবুর নিজের… যেমন ইজিপ্ট আফ্রিকার কিছু অংশ, মরু অঞ্চল বা এই ধরণের কতকগুলো প্রাচীন সভ্যতা। কিন্তু তার মধ্যেও যে কতকগুলো অদ্ভুত, বা আজকের দিনেও আমাদের কাছে যেগুলো খুব অবাক বলে… এমনকি পিরামিড তৈরির ব্যাপারটাই এত অদ্ভুত! এইসবগুলো প্রাচীন সভ্যতার প্রতি আমার ভয়ানক একটা টান রয়েছে..।
অমিত: আধুনিক বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যায় না এরকম অনেক জিনিস আছে..
সত্যজিৎ: অনেক, অনেক জিনিস আছে। আজকাল তো ক্রমে ক্রমে আরো কত বেরোচ্ছে। আমি নিজে সম্প্রতি সন্দেশ-এ একটা লিখেছি, সেই Nazka-র লাইন সম্বন্ধে। আপনারা জানেন কিনা জানি না, দক্ষিণ আমেরিকায় Nazka বলে একটি ছোট্ট জায়গা আছে, পেরুর ওইদিকে, যেখানে বোধহয় বছর চল্লিশেক আগে এরোপ্লেন থেকে ওর ওপর দিয়ে যেতে যেতে দেখা গেল জমিতে বিশাল বিস্তৃত সমস্ত জিওমেট্রিক নকশা, পাখি, মাকড়সা, জানোয়ার। এত বড়, যে আপনি জমিতে বসে সেগুলো বুঝতেই পারবেন না। শুধু ওপর থেকে, একটা elevation থেকে, অন্তত পাঁচ-ছশো বা হাজার ফুট উঠে গেলে দেখা যাবে।
সঙ্কর্ষণ: লোকের মনে একটা বিজ্ঞানের আগ্রহ জন্মানো, একটা চেতনা, এই বিজ্ঞান কাহিনীর মধ্যে দিয়ে এটা কি সম্ভব? কতখানি সম্ভব?

সত্যজিৎ: সম্ভব মানে কি, ধরুন আমার গল্প যদি লোকের ভালো না লাগতো, বা যাদের জন্য লেখা, সেই কিশোর-কিশোরীদের যদি ভালো না লাগতো, তাহলে হয়তো আমি ওটা নিয়ে আর লেখার উৎসাহ পেতাম না।

সঙ্কর্ষণ: এরকম কি জানতে পেরেছেন যে আপনার এই লেখার প্রেরণায় সে হয়তো বিজ্ঞান চর্চায় নেমেছে, এরকমও তো হতে পারে?
সত্যজিৎ: দেখুন, science fiction পড়ে আমি অন্তত science fiction লেখায় নেমেছি (হাসি)। আমার একটা তো উপকার হয়েছে। সে প্রেরণাটা তো আমি পেয়েছি, এবং সেটা লিখছি এবং তার ফলে আরো পাঁচজন যে সেরকম কোনও প্রেরণা পাবেনা, সেটা যে সবসময় লেখার বা সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পাবে, সেটা নাও হতে পারে। সে নিজে সে career হিসেবে বেছে নিতে পারে। তার যদি জিনিসটা সম্বন্ধে একটা যথেষ্ট আগ্রহ জাগে, তাহলে সেটা নিয়ে সে আরো চর্চা করতে চাইবেনা কেন? সেতো শুধু আমার গল্প পড়ে সব জানবে না। সেটা তেমনই যদি কৌতুহল বা আগ্রহ হয়, তাহলে তাকে নিজে থেকে চাড় করে আরো পাঁচরকম জিনিস পড়তে হবে। শেষকালে সেটাকে সে academic discipline-এর মধ্যে নিয়ে নিতে পারে। কেননা text বই হয়তো কিশোর কিশোরীদের পড়বার আগ্রহ ততো নাও থাকতে পারে। কিন্তু তারা প্রথম জানছে গল্পের মধ্য দিয়ে। এবং সেখানে গপ্পোটা খুব বড়ো জিনিস। গপ্পের প্লট অত্যন্ত বড়ো জিনিস, এবং তার সাথে সেটা তথ্য ভারাক্রান্ত না হয়ে পড়ে… কখনো মনে হবে না যে আমি এইসব তথ্যগুলো পরিবেশন করবার জন্য গপ্পোটা লিখছি। প্রধান হচ্ছে গপ্পো, গপ্পের রস। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে তার মারফত সে কতকগুলো জিনিস জেনে যাচ্ছে, কতকগুলো দিকে তার উৎসাহ জাগ্রত হচ্ছে। তারপর সেটা সে পরে কাজে লাগাতে পারে।
অমিত: যাক সত্যজিৎবাবু আজকে অনেকক্ষণ সময় দিয়েছেন আমাদের। সঙ্কর্ষণবাবু আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending