Connect with us

বিবিধ

হরিশংকর জলদাসের সাক্ষাৎকার : আমি এখানে গল্প শোনাতে এসেছি

Published

on

হরিশংকর জলদাস
হরিশংকর জলদাস বাংলা কথাসাহিত্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠা এক নাম। আত্মপ্রকাশের পর মূলত মাত্র গত দেড় দশকে একের পর এক উপন্যাস ও গল্পে সুপরিচিত হয়েছেন সমুদ্রপাড়ের জেলেসমাজের প্রতিনিধি এ কথাশিল্পী। সম্প্রতি এক সাক্ষাতে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার জীবন ও সাহিত্যচেতনার নানান অবয়ব। হরিশংকর জলদাসের সঙ্গে কথোপকথনের বিশেষ অংশ এখানে পত্রস্থ হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সঞ্জয় ঘোষ
কেমন আছেন, কেমন কাটছে দিনকাল?
ঘরের মধ্যে তো আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই এখন। আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, মেয়ে একটা কলেজে পড়ায়। ছেলে বিয়ে করেছে, সে ডাক্তারি করে। সে তার কর্মব্যপদেশে ঢাকায় থাকে। ফলে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই শুধু ঘরে। স্রষ্টার একটা আশীর্বাদ হলো, এই বাহাত্তর বছরে পৌঁছে নানা রকমের রোগে জর্জরিত হয় মানুষ। কিন্তু আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই তেমন কোনো বড় রোগের রোগী নই। আমার স্ত্রীকে এখন পর্যন্ত কোনোদিন কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়নি। আমাদের ৪৩ বছরের বৈবাহিক জীবন। সকালে উঠে আমরা দুজন হাঁটতে যাই। হেঁটে এসে, বাড়ির পাশে একটা বাজার বসে সেখান থেকে নিত্যদিনের বাজারটা নিয়ে আসি। বাড়িতে ফিরে চা-টা খেয়ে দুজনের মধ্যে নানারকম সাংসারিক আলাপ চলে। এরপর আমি একটু লিখতে বসি। বিকেলে সামান্য ঘুমানো, সন্ধ্যার পর আমি আবার লিখতে বসি। এই হলো আমার দৈনন্দিন জীবনের অবস্থা। আর লেখালেখির বিষয়ে আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন যে, আপনি লিখতে বসেছেন ৫৫ বছর বয়সে। লেখার বয়স মাত্র ১৫-১৭ বছর। এতগুলো বই লিখলেন কী করে? আমি মশকরা করে উত্তর দিই—‘দেখেন আমার করার কিছুই নেই।’ কলেজের মধ্যে সরকারি কলেজের প্রিন্সিপালরা বিশেষ করে চাকরি থেকে অবসরের পর তারা কোনো স্কুলে কিংবা প্রাইভেট কলেজে প্রিন্সিপালগিরি বা হেডমাস্টারি করে। কেন করে, এটা তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, সময় কাটে না। তা ছাড়া অর্থলোভ আছে বলেই তারা যায়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সরকারি যে বেতন স্কেল আছে, সেটা কিন্তু চাকরি করার জন্য নয়। একজন ফুল প্রফেসর হওয়ার পর একজন প্রায় কোটি টাকার মতো পায়। এই কোটি টাকা ব্যাংকে রেখে সচ্ছন্দে জীবনযাপন করা যায়। সে প্রশ্নটা আমাকেও করে—আমি বলি যে, ষাট বছর ধরে শুধু দু’মুঠো ভাত জোগাড় করার জন্য দৌড়েছি। এমন দিনও গেছে যে, আমি ভাত না খেয়ে শুধু শাক খেয়ে থেকেছি। অভাবের সময়। একেবারে প্রান্তসমাজে জন্ম, বারো-চৌদ্দজন মানুষের সংসার। চাল জোগাড় হচ্ছে হয়তো এক সের মাত্র। সবার ভাগে সমান পড়ত না। কিন্তু আমি যখন স্বস্তিতে আসলাম, অন্তত ওই দুঃখটাকে বোধ করার জন্য এই বয়সে আর চাকরি করিনি। যা পেয়েছি তা দিয়ে জীবন ভালোভাবেই চলছে। এই অবসর সময়টুকু কাটাবার জন্য একটা অবলম্বন দরকার আছে। কেউ গান শোনে, কেউ দেশ ভ্রমণ করতে যায়। আবার কেউ বউয়ের সঙ্গে ঝগড়াও করে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা। আমার সময়টা আমি ব্যয় করছি লেখার টেবিলে।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের কথা বলছিলেন—
বলছিলাম সাহিত্য রচনা মানে তো দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করে বই লেখাই শুধু নয়, সে সাহিত্যকে বিষয়িত হতে হবে। যেমন আমি উপন্যাস লিখি, উপন্যাসের কথাই বলি। আমাদের দেশে উপন্যাসের যে বিষয়গুলো এখন লিখিত হচ্ছে—খুব বেশি আহামরি কী বিষয় সেখানে আছে! এই যে প্রেম-ভালোবাসা কিংবা এমন আর দুয়েকটা বিষয়ের বদলে তেমন কিছু নিয়ে তো কেউ লিখছেন না। এখন আমাদের সমাজে সবচেয়ে ক্রাইসিস যাচ্ছে বৃদ্ধ মা-বাবাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। আপনারা যারা তরুণ আছেন, তারা বুঝতে পারবে না।
তা ঠিক নয়, এ নিয়ে আমাদের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের ক্রাইসিস চলছে।
তবু আমি ধরে নিচ্ছি তারুণ্যের কারণে বুঝতে পারবেন না। কিন্তু এটি বিশাল একটি ক্রাইসিস হয়ে দেখা দিয়েছে এখন। এই বাবা-মা ছেলেমেয়েদের মানুষ করল—অন্তত ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে এই আবেগ ধুয়েমুছে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের লেখাতে এসব বিষয় আসছে না। যদি আপনি একেবারেই শহুরে জীবন নিয়ে লিখতে চান, তবে এসব নিয়ে লেখা উচিত। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের গল্পে কিংবা উপন্যাসে গ্রাম কোথায়? আপনি কি বলবেন যে বাংলাদেশ শহর হয়ে গেছে!
না, কিন্তু অনেকেই তো লিখছেন গ্রাম নিয়ে!
কই, সেই গ্রাম তো আমি পাচ্ছি না!
তবে এটা ঠিক, এখনকার গ্রাম এখনকার মতো আসে না, যেটা আসে তার অধিকাংশই দেখা যায় আমাদের স্মৃতির গ্রাম। পাঁচ-ছয় দশক আগে দেখা কিংবা অন্যান্য লেখকের লেখায় যে গ্রামকে আমরা দেখেছি, সেই গ্রামই শুধু আসে। অর্থাৎ, অন্য গল্পকার বা ঔপন্যাসিকদের কাছ থেকে যা পেয়েছি, সেটাই ভাঙিয়ে খাওয়া হচ্ছে।
এখন আমি গ্রামকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওই যে ইন্ডিয়ান সিরিয়ালগুলোতে যেগুলো করে, গ্রামে শুরু করে এক-দুই এপিসড গ্রামে করে তারপর কলকাতা শহরে নিয়ে আসে। আমাদের উপন্যাসেও গ্রাম দিয়ে শুরু হয়, কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে লেখক তার নিজের অভিজ্ঞতার জায়গাগুলোতেই নিয়ে আসে। তার মানে শহরই কি বাংলাদেশ, ঢাকাই কি বাংলাদেশ, শহরই কি বাংলাদেশের সংস্কার, সংস্কৃতি, অর্থনীতি? এখনো পর্যন্ত তো বাংলাদেশ পড়ে আছে গ্রামের রাস্তায়, গ্রামের মাঠে। আমরা এই যে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, তার সঙ্গে আমি অবশ্য আরেকটা বাক্য যুক্ত করেছি, ‘গলা ভরা গান’। এখনো সেই গ্রাম আছে। এখনো গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটলে সেই গ্রামকে ছোঁয়া যায়, কিন্তু আমরা আমাদের সাহিত্যে তাকে ছুঁতে পারছি না। তাহলে গ্রাম কি সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল?
এবং গত কয়েক দশকে গ্রামে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে এবং তার যে অভিঘাত—সেগুলোও তো আসতে পারে।
অবশ্যই। তার জন্য গ্রামকে গভীরভাবে দেখার মনটা থাকা দরকার। তারপর আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক উপন্যাসগুলো হচ্ছে, সেগুলো একপেশে। হয়তো ধরেন কমিউনিস্ট পার্টিকে খুব শ্রেষ্ঠ করে তুলে ধরা হচ্ছে, না হয় আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে শ্রেষ্ঠ করে তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু সার্বিক যে রাজনৈতিক অগ্রগমনের বিষয়গুলো, সেগুলো তো আসছে না। কলকাতায় যেমন নকশাল আন্দোলন হয়েছে আপনি জানেন। সেই নকশাল আন্দোলন নিয়ে কত বিখ্যাত বিখ্যাত উপন্যাস হয়েছে।
লেখার ক্ষেত্রে বিষয়হীনভাবে লেখা যায়, বিষয় নিয়েও লেখা যায়। আমি এর ঘোর বিরোধী নই যে, শহুরেপনা নিয়ে উপন্যাস লেখা যাবে না, গল্প লেখা যাবে না, কিন্তু আমরা আমাদের শিকড়টাকে ভুলে যাচ্ছি। শিকড় ভুলে গিয়ে কতদূর যাওয়া যাবে বলেন?
এটা কি তাহলে অভিজ্ঞতার সংকট, নাকি দেখার সংকট নাকি আসলে মেধা বা ক্ষমতারই সংকট? আমরা কি পারছি না?
অভিজ্ঞতার সংকট তো আছেই। তবে না দেখেও অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। সবাই দেখেনি, হয়তো পড়েছে। না হয় যারা দেখেছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আরেকটা হলো যে, আগ্রহের একটা ব্যাপার আছে। অনেকে হয়তো ভাবছে আমি একটা প্রেমের উপন্যাস লিখে যদি বাজার পেয়ে যাই কিংবা একটা প্রকাশনা সংস্থা পেয়ে যাই।
আপনি বলছেন গল্প-উপন্যাসে বা লেখালেখির ক্ষেত্রে আমাদের অনেক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে—কিন্তু আমাদের বইয়ের তো কমতি নেই, দিনকে দিন বই বাড়ছেই। প্রতি বইমেলায় তার নমুনা আমরা দেখছি।
আমি নিজেও লিখছি। লিখতে হয়; নানান চাপে পড়ে এর-ওর অনুরোধে। কিন্তু সেই বইটা যদি বুকের কাছে তুলে ধরা না যায়, তাহলে তার সার্থকতা কোথায়! বই আর বুক দুইটাই কিন্তু একই বর্ণ দিয়ে শুরু। আপনি বইটা যদি বুকের কাছে নিতে না পারেন—বুকের কাছে বইটাকে নেবেন কখন? আপনি বইটা পড়ে যদি আপনার বোধ বুদ্ধিকে ঋদ্ধ করতে পারেন, সেখানে সমাজ সংস্কৃতির ক্রাইসিসগুলো, আত্মীয়তার সাংঘর্ষিক যে বিষয়গুলো খুঁজে পান, তখন এ বই আপনাকে তৃপ্তি দেবে। যে বস্তুটা তৃপ্তি দেয় তাকে আমরা বুকের কাছে রাখি। ঈদের সময় একে অন্যকে বুকে জড়ায়—গোটা বছরের হাহাকারটাকে মুছে ফেলতে চায়। সন্তানকে মা জড়িয়ে ধরে। একটা বই যে আমি বুকের কাছে নেব, সেই বইটাকে তো সেরকম হতে হবে।
তা না হলে তো সেটা কেবল একগুচ্ছ কাগজ ছাড়া আর কিছু না।
হ্যাঁ। এখন বই প্রকাশের বিষয়টা টাকার ওপর চলে গেছে। আমি আপনাকে টাকা দিচ্ছি, তাই আমি যাই লিখেছি তা নিয়েই বলেছি, ভাই বইটা বের করে দেন। যারা প্রকাশ করছে তারা টাকার বিনিময়ে বইটা বের করে দিচ্ছে।
প্রকাশনার ধারণাই কি বদলে গেল? নাকি আমাদের সামাজিক বিশ্বাস বা অনুরণন যে ধ্বংস হয়ে গেছে, এটা তারই লক্ষণ?
পুরো একটা ক্রাইসি। যদি আমি ভুল না করে থাকি, তারা করে কি এখন, বইগুলো ছাপিয়ে দেবে, কিন্তু একটা বইও আপনি তার ওখানে রাখতে পারবেন না, সব লেখক নিয়ে যাবে, বিপণনের কাজটাও লেখকের।
আবার বইয়ের মানও ঠিক নেই। বানানই দেখা হয়নি এমন বই বাজারে চলে আসে।
এজন্য আমি অনেককে দুঃখ করে বলি—নিজেকে জাহির করার জন্য নয় যে, ভাই তুমি আমাকে বইমেলায় প্রকাশিত পাঁচটা বইয়ের নাম বলো, যে পাঁচটা বই পড়ে আমি তৃপ্তি পাব। যারা কেনে, সবাই তো আমাদের গালাগালি করে। ঢোল পিটিয়ে, চাকচিক্য দেখিয়ে বই বের করছি। প্রকাশিতব্য বইগুলোকে যাচাই করার একটা পদ্ধতি আমাদের দেশে করা যায় কি না, ভেবে দেখা দরকার। লন্ডন বা ইউরোপের প্রকাশনী সংস্থাগুলোর যেমন সম্পাদনা পরিষদ থাকে। এখন আপনি বলতে পারেন, সবার তো তেমন অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই। কিন্তু বড় প্রকাশনী যাদের সে সামর্থ্য আছে তারা তো সেটা করতে পারে। তা না হলে আমাদের এই বই প্রকাশের প্রবাহটা শেষ পর্যন্ত আবর্জনাতেই পর্যবসিত হবে।
আপনার উত্থান পর্বের কথা ও জীবনের কথা আরও কিছু জানতে চাই।
আনন্দের ব্যাপার হলো আমার প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ মানুষের চোখে পড়েছে। আমি যে এটা খুব পরিকল্পনা করে লিখেছি এমন নয়। এখন আমি বলি কোথাও কোথাও—আগের যে জেলেজীবন নির্ভর উপন্যাসগুলো লেখা হয়েছে, সেগুলো সব নদীভিত্তিক জেলেদের নিয়ে লেখা। দুই বাংলায় আমিই একমাত্র সমুদ্রপাড়ের জেলেদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছি। পিএইচডি থিসিস করতে গিয়ে এই উপন্যাস লেখার কথা মাথায় এসেছে। এখন উপন্যাস কাকে নিয়ে লিখব? আমি আমার বাবাকে দেখেছি, ঠাকুরদাকে দেখেছি এবং মূলত বঙ্গোপসাগরকে দেখেছি। বঙ্গোপসাগরে ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমি নিজে মাছ ধরেছি। ফলে সেখানকার বর্ণনা যখন দিতে যাব, আমাকে তো আর বই পড়তে হবে না। সাগরের ঢেউয়ের বিবরণ যখন দিতে যাব, লটিয়া মাছের বিবরণ যখন দিতে যাব, ইলিশের লাফ দেওয়ার দৃশ্য যখন লিখতে যাব, আমার তার জন্য বই পড়তে হবে না। সেটাই লিখলাম এবং সৌভাগ্যবশত সেটা মানুষ গ্রহণ করল। এরপর ‘দহনকাল’, ‘কশবি’ বলে একটা উপন্যাস আপনার সঙ্গে যেটা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে—এগুলো মানুষ গ্রহণ করল। কিন্তু আমার বোধহয় নিজের অজান্তেই একটা ব্যাপার ঘটেছে—একেবারে প্রান্তের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছি বলে হয়তো আমার এক ধরনের সমর্থন ছিল, পক্ষপাতিত্ব ছিল ওই তথাকথিত ছোটলোকদের প্রতি। ছোটলোক কারা? মেথর, মুচি। তাদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছি। ‘পতিতা’দের নিয়ে উপন্যাস লিখেছি। এরা অর্থনৈতিকভাবে তো বিধ্বস্তই। সামাজিক শ্রেণিগতভাবেও বিধ্বস্ত। তারপর ঘৃণা অর্থে বর্ণগতভাবেও এরা অবহেলিত। আমি যখন লিখতে বসেছি, বারবার আমার কলম ওইদিকেই গেছে। হয়তো ওই মাঠটা ফাঁকা ছিল বাংলাদেশে। মানুষ তাই গ্রহণ করেছে।
তো আপনি যেমন আপনার সেই জেলেসমাজে প্রথম হাই স্কুল পাস মানুষ, সেখান থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু আপনার পরের চিত্রটা কেমন?
আমি যদি সত্যি কথা বলতে যাই—পরের চিত্রটা অত্যন্ত ভয়াবহ।
এ পর্যন্ত পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কেমন পেয়েছেন?
এটা আমার বিশাল সৌভাগ্য, তা ছাড়া জীবনে তো অনেক লাঞ্ছনা পেয়েছি, অনেক লাথি-চড় খেয়েছি। একজন শাব্দিক অর্থেই লাথি-চড় খাওয়া মানুষ আমি। আমার সামনে আমার বাবাকে মাছের দাম কমবেশি বলার কারণে ছাতা দিয়ে পেটাতে পেটাতে কাদার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে, সেটা আমি দেখেছি। মার খাওয়া, পোড় খাওয়া মানুষ আমি এবং গোটা জীবনটাই আমার লাঞ্ছনার। বিভাগে পড়াতে এসে, কলেজে বিসিএস দিয়ে চাকরি করতে এসে দেখেছি, সেখানে আমাকে নাম ধরে না ডেকে বলা হচ্ছে জাইল্লার পোলা আসছে। এই লাঞ্ছনা প্রায় সমস্ত জীবনই ছিল। জেলেসমাজের মানুষ বলে আমাকে বাসা ভাড়া দেয় না, বড় কলেজে পড়াচ্ছি তবুও বাড়ির মালিক বলেছে এই বিল্ডিংটা জেলেদের জন্য বানানো হয়নি। এরকম নিগৃহীত হতে হয়েছে প্রায় সারা জীবন। কিন্তু ঈশ্বর সেটাকে পুষিয়ে দিয়েছেন, আমি যখন লিখতে আসলাম। আমাকে পাণ্ডুলিপি নিয়ে কোথাও কারও কাছে ধরনা দিতে হয়নি। জলপুত্র উপন্যাসটা যুগান্তরের প্রতিযোগিতায় ৬৫টি উপন্যাসের মধ্যে প্রথম হয়েছিল। কেন আমার লেখা পড়ছে সেটা পাঠক বলবে। কিন্তু আমি পাঠকনন্দিত হতে পেরেছি। কথা আছে যে, জনপ্রিয় লেখকদের রচনা সাহিত্যবোধসম্পন্ন হয় না। কিন্তু আমি এজন্য গর্বিত যে, আমার লেখাকে জনপ্রিয় বলা যায়, কারণ অনেকেই পড়েন। এক বইমেলাতেই একটা বই যদি চারটি সংস্করণ হয়, তাহলে হয়তো বোঝা যায় যে, মানুষরা বই কিনছে। এই প্রতিক্রিয়াটা আমি পেয়েছি। আবার সেই জনপ্রিয় লেখাটা সাহিত্যগুণসম্পন্ন হয়েছে কি না, আমি এর উত্তর সরাসরি না দিয়ে এটা বলতে পারি যে, আমাকে নিয়ে পিএইচডি হচ্ছে এখন। বাংলাদেশে হয়েছে, ভারতেরও বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে ছয়-সাতটা পিএইচডি। এখন কথা হচ্ছে, জনপ্রিয় সাহিত্য যদি সস্তা সাহিত্য হয়, তাহলে সেদিক দিয়েও আমি অনেকটা মুক্ত যে, আমার লেখা পাঠকরা পড়ছেন, আবার সেই লেখা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পণ্ডিতসমাজে আলোচনা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে। তবে আরেকটা কথা আমি আপনার মাধ্যমে জানিয়ে দিতে চাই যে, যেদিন আমি বুঝতে পারব আমার লেখা থেকে মানুষ আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, সেদিন আমি কলম থামিয়ে দেব। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
গল্প লেখার ক্ষেত্রে আপনার বাক্য সবসময়ই সরল। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
আমি সবসময় ছোট বাক্য নির্মাণের চেষ্টা করেছি। দুটো শব্দ দিয়ে, একটা শব্দ দিয়েও আমি অনেক বাক্য লিখি। আমার প্রবণতা হলো যে, কম শব্দ দিয়ে বাক্য নির্মাণ। আরেকটা প্রবণতা হলো পৌরাণিক উপন্যাসগুলো ছাড়া আমি লেখার সময় তৎসম শব্দগুলোকে এড়িয়ে চলি। খিদা লেগেছে, এ কথাটাকে আমি খিদা লেগেছেই বলতে চাই। আমি সেখানে তৎসম শব্দ ব্যবহার করে আরও কঠিন করে বাক্য নির্মাণ করি না। অনেকেই তাদের লেখার ভাষা আর মুখের ভাষাকে আলাদা করে ফেলেন। আমি মুখের ভাষাটাকেই লেখার ভাষা করতে চাই। এ কথাটা অনেকেই আমার সম্পর্কে বলেন যে, হরিশংকরের ভাষা অত্যন্ত সরল। আমি তো সরল রাখতেই চেয়েছি এবং এখনো রাখছি; ইচ্ছে করেই রাখছি। আমার কথা হয়তো অনেকে মানবেন না। হয়তো শহিদুল জহির যারা পড়ছেন, মামুন হুসাইন, কমলকুমার মজুমদার পড়ছেন তারা তো আমার কথা মানবেন না।
কিন্তু গল্পের ভাষায় নিজের একটা স্বাতন্ত্র্য তৈরি হবে না বা সেটা আদৌ জরুরি কি না?
সেটা কমলকুমার মজুমদার করেছেন। তবে আদৌ জরুরি কি না, তার উত্তরে বলতে পারি, হয়তো জরুরি, যেটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তৈরি করেছেন। সংবাদপত্রের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষার মধ্যে পার্থক্য আছে। সুনীল যে কাজটা প্রথমত করেছেন, তা হলো সাহিত্যের ভাষাকে সংবাদপত্রের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। ফলে তার উপন্যাস পড়তে গিয়ে মানুষকে আর অভিধান পাশে রাখতে হয়নি। আমি নিজে বলি যে, আমি ভাই এখানে গল্প শোনাতে এসেছি—গল্প ঠাকুরমা বা দিদিমা যখন তার নাতি-নাতনিকে শোনায়, সে গল্পটাই শোনায়। আমার মূল উদ্দেশ্য হলো গল্প শোনানো, ভাষা শিখতে চাও—অধ্যাপকদের বড় বড় প্রবন্ধ পড়ো, ব্যাকরণ পড়ো।
মানে গল্পটা ঠিকমতো বলতে পারলেই হলো?
গল্পটা ঠিকমতো বলতে পারার মধ্যেও তো একটা কায়দা থাকে। শুধু সহজ ভাষায় বলাই নয়, তার মধ্যে তো একটা মাধুর্য থাকা দরকার। ভাষার মূল কাজ হলো তার স্নিগ্ধতা, তার মাধুর্য।
বাঙালির সাহিত্যের হাজার বছরের ধারায় আমাদের বর্তমানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বিষয়ের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ করে আমি যেহেতু কথাসাহিত্য করি, বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের গদ্যের যে ধার বা ধারাটা কখনো অপ্রশংসার নয়, কিন্তু গদ্য পড়ার জন্য তো কেউ উপন্যাস কেনে না! তার ভেতরের বিষয়কে বোঝার জন্য উপন্যাস কেনে। যেমন আমাকে অনেকে বলেন যে, এ বছর কী লিখছেন? বলি যে, একটা উপন্যাস লিখেছি। দ্বিতীয় প্রশ্ন যেটা করে, সেটা হলো, বিষয় কী?
পশ্চিমবঙ্গে ওরা বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখছে এবং সে বিষয়গুলো চমকে দেওয়ার মতো। সেই বিষয়গুলো আমাদের দেশেও আছে। কিন্তু আমরা যারা লিখছি, তারা অল্পতেই বহু প্রাপ্তির পেছনে ঘুরছি বলেই ওই কষ্টটা আর করছি না এবং আমি মনে করি না যে এটা বদল হওয়ার নয়। মানুষের হার্টবিট যেমন ওঠানামা করে, সাগরের ঢেউ যেমন ওঠানামা করে, আমাদের সাহিত্যের কোনো কোনো শাখা হয়তো নিম্নমুখী। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, এটা একদম পাতাল পর্যন্ত চলে যাবে। যেহেতু এরা জলে ভাসছে, আবেগের অন্য নাম যদি জল হয়, আমাদের কবিতা, গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক এগুলো তো আবেগের ওপরে ভাসছে। জলের ঢেউ যেমন কখনো নিম্নমুখী, কখনো ঊর্ধ্বমুখী—যেটা নিম্নমুখী একদিন সেটা ওপরে উঠবে, যেটা ঊর্ধ্বমুখী সেট নিচে নামবে।
আমাদের দেশে জীবনভিত্তিক উপন্যাস রচিত খুব কমই হচ্ছে। আমি হাসনাত আবদুল হাইয়ের কথা মনে রেখেও বলছি। কিন্তু কলকাতায় খুবই জীবনভিত্তিক উপন্যাস রচিত হচ্ছে। আমাদের এখানে লেখকদের সবচেয়ে বড় অভাব হলো বিষয় নির্বাচনের আগ্রহহীনতা। তারপর একটা উপন্যাস লেখার জন্য যে সময়টা দরকার, সেই সময়টা অনেকেই ব্যয় করতে চায় না। শ্রমের এবং ঘামের গন্ধটা যদি আমার উপন্যাসে না পাই, তাহলে সেটা তো জীবনঘেঁষা উপন্যাস হবে না। আর সর্বোপরি বলতে হয়, বর্তমানকে যদি অস্বীকার করি যে, বর্তমানে কিচ্ছু হচ্ছে না, তাহলে নিজেকেই তো অস্বীকার করা হবে।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending