বিবিধ
প্র ব ন্ধ | উত্তর-আধুনিক উপন্যাস ও তার বর্ণনাকারীর ঐতিহ্য
Published
10 months agoon

উপন্যাসে বর্ণনাকারীর ভূমিকাটি অবধারিতভাবে কেন্দ্রীয় । এই বর্ণনাকারী সর্বজ্ঞ এবং অন্তর্যামী হতে পারে, উত্তমপুরুষ হতে পারে; কিন্তু কাহিনির চলিষ্ণুতা নিশ্চিত করে তার আখ্যান। ঔপন্যাসিক নিজে অধিকার করে নিতে পারেন অন্তর্যামীর স্থানটি; অথবা সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর যেটুকু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অর্থাৎ আখ্যানের ঘটনাবহির্ভূত reflective অংশটুকু, ঔপন্যাসিক নিজের কর্তৃত্বে রেখে দিতে পারেন। তবে হয়তাে এমন চোরাগােপ্তা উপায়ে যে, পাঠক সন্দেহ করবে না ঔপন্যাসিক সশরীরে কোথাও আছেন বরং আখ্যানের বৈচিত্র্যে এবং ব্যাপ্তিতে তার এমন ধারণা হতে পারে যেন ঘটনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত কিছু অতিরিক্ত বিষয় ওই ঘটনার প্রয়ােজনেই তাকে দেখতে হচ্ছে, অনুভব করতে হচ্ছে, অনুধাবন করতে হচ্ছে। বাস্তববাদী উপন্যাসে, যা আঠারাে শতকে ইংরেজি উপন্যাসের সূচনালগ্নেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নেয়, সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীকে একদিকে কাহিনির ধারাবর্ণনা দিতে দেখা যায়, অন্যদিকে লেখকের নানা ভাবনাচিন্তা, এমনকি মতবাদকেও নিজের আখ্যানে স্থান দিয়ে একটি জমজমাট গল্পের অবতারণা করতে দেখা যায়। বর্ণনাকারী বাস্তবের মাপজোক, তার মাত্রা ও অনুপাত কোনাে বৈকল্য ছাড়াই তুলে আনেন : সামাজিক সত্যগুলিকে নিরাভরণ প্রকাশ করেন এবং চরিত্রগুলিকে জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তবানুগ করে উপস্থাপন করেন। তাতে পাঠকের এই আশ্বাস জন্মে যে, যে কাহিনি তার সামনে উন্মােচিত হচ্ছে, তা সত্য না হলেও সত্যের অনুরূপ হয়ে উঠছে, এবং যে চরিত্রদের সে দেখতে পাচ্ছে, তারা অপরিচিত নয় এবং যে সত্য তার সামনে ধরা দিচ্ছে, তা অভিজ্ঞতার অতিরিক্ত কিছু নয়। সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী তার ফিকশনকে বৈধতা দেন পাঠকের সামনে একটি বিকল্প কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, অর্থাৎ পাঠক যা অনুভব করে, যাকে সত্য অথবা সম্ভাব্য বলে ভাবে – অথচ যা কোনাে একক ব্যক্তি একত্রে অথবা সামূহিকভাবে নিজের অভিজ্ঞতায় ধারণ করতে অপারগ, অর্থাৎ যা বহু মানুষের অভিজ্ঞতায় স্থাপিত, তা যখন একজন। বর্ণনাকারীর আখ্যানে কেন্দ্রিকতা পায়, সেই কেন্দ্রীয় উপস্থিতিকে সে তখন বৈধ কর্তৃত্ব বলে মেনে নেয়। উপন্যাসের শুরুতে এই যে সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর উত্থান, তার সঙ্গে কাহিনি বা গল্প কাঠামাের প্রয়ােজন ছাড়াও আরাে দুটো বিষয় জড়িত। প্রথমত, সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী ওই কর্তৃত্বের আভাস দেন, যা জীবনে মানুষ কামনা করে অথচ যার দেখা পাওয়া যায় না, মিশেল ফুকো যাকে বলেছেন সাধারণের ক্ষমতা-মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতার একটি প্রকাশ এখানে দেখা যায়, যা ভিন্ন ভিন্ন অথবা খণ্ডিত জিনিসগুলিকে একত্র করবে, একটা আকৃতি দিয়ে একটা কেন্দ্রিকতা দেবে। সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর বয়ানে সেই কর্তৃত্বের প্রকাশ দেখা যায় যা ঈশ্বরতুল্য : এবং কে না জানে মানুষ অন্তর্যামীর উৎপ্রেক্ষাকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে জীবনে – এতটা যে, অন্তর্যামীকে কখনাে মানুষকে খুঁজে নিতে হয় না, মানুষই তাকে বরাবর খুঁজে নিয়েছে। ফ্রয়েড বলেন, মানুষের সকল গােপন কামনা ও কামনার পেছনে থাকে একটি উদগ্র আকাক্ষা – কেউ যাতে তা দেখতে পায়, তার আকাঙ্ক্ষা। অন্তর্যামীর চোখের জন্য তােলা থাকে মানুষের কামনা-বাসনার অন্তঃপুর । দ্বিতীয়ত, সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী একটি বাস্তবসম্মত চিত্র দিতে পারে মানুষের ঘটনাবহুল জীবনের। কোনটা রাখা হবে, কোনটা ফেলা যাবে : বস্তুর ডিমেনশন, তার অনুপাত এসব প্রশ্নাতীতভাবে নিষ্পন্ন করতে পারেন ওই বর্ণনাকারী। আমরা লক্ষ করি, একটি অবাস্তব পদ্ধতিকে আঁকড়ে ধরে বাস্তববাদী উপন্যাস অগ্রসর হয়েছে। সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী আসলেই যে অবাস্তব একটি প্রতিপাদ্য, তার ঈশ্বরসদৃশ ক্ষমতা যে নিতান্ত আরােপিত/কল্পিত, এটি বুঝতে কারাে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অথচ, ওই অবাস্তব উপায়টির মধ্য দিয়েই বাস্তববাদী উপন্যাস সৃষ্টি করেছে অভিজ্ঞতা স্বীকৃত ঘটনা, চরিত্র, বিষয়-আশয় ।
উত্তমপুরুষ বর্ণনা সে তুলনায় একটু সীমিত– উত্তমপুরুষের চারণক্ষেত্র ব্যক্তির নিজস্ব গণ্ডিতে। উত্তমপুরুষের পক্ষে দ্বিতীয় কোনাে চরিত্রের মনােজগতে প্রবেশ সম্ভব নয়, অথচ একক কোনাে চরিত্রের একান্ত জগতে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখলে শুধু ওই চরিত্রই পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, বৈধতা পায়, কিন্তু অন্য কোনাে চরিত্র সেরকম নানাবিধ মাত্রায় বিকশিত হতে পারে না, অর্থাৎ হওয়ার সম্ভাবনাটি সামান্য। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, উত্তমপুরুষ বর্ণনাতেও ভিন্ন চরিত্রের উপস্থাপনা একটি হেত্বাভাসকে ভিত্তি করে হতে থাকে। হেত্বাভাসটি, সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী উপন্যাসের হেত্বাভাসের মতােই, জটিল। যদি বর্ণনাকারী উত্তমপুরুষ হয় তবে তার আখ্যান শুধু তার নিজের মনােজগতের নানা অলিগলির সন্ধান দিতে পারে, অন্যের মানসে তার প্রবেশাধিকার থাকার কথা নয়। অথচ এরকম উপন্যাসের একটি অতিব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে অন্য চরিত্রের মনােলােকে নানা উপায়ে প্রবেশ করে, তার রূপটি উন্মােচিত করা। হয়তাে দ্বিতীয় চরিত্রটি, কিছু সময়ের জন্য, উত্তমপুরুষে পরিণত হয়, হয়তাে উত্তমপুরুষ অনুমানভিত্তিক বর্ণনা দিতে যাবে দ্বিতীয় চরিত্রের : কিন্তু প্রায়শ দেখা যায়, উত্তমপুরুষ বর্ণনাকারী, নিজের অজান্তে, দ্বিতীয় চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে; এবং শুধু অনুমানভিত্তিক নয়, একেবারে প্রকৃত বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে তার একান্ত চিন্তাভাবনার। এই হেত্বাভাসকে বলা হয় Extension Fallacy অর্থাৎ প্রথমজন দ্বিতীয়জনের ভেতরে প্রলম্বিত হচ্ছে, প্রবিষ্ট হচ্ছে, যদিও এটি ঘটলে প্রথমজনের অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের সন্দেহ হয়, মনে হয়, হয়তাে সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীরই কোনাে খণ্ডিত রূপ সে। সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী অবশ্য অনেক সময় অনেকগুলি চরিত্রকে আলাদা আলাদা উত্তমপুরুষের বর্ণনায় নিয়ে আসতে পারেন। অথবা এ কাজটি সরাসরি ঔপন্যাসিক করতে পারেন। যেভাবেই হােক, শুদ্ধ উত্তমপুরুষের বর্ণনা বিরল । উত্তমপুরুষের সঙ্গে মিশে গেলে ঔপন্যাসিক এক অশুদ্ধতার, অর্থাৎ উপর্যুক্ত হেত্বাভাসের শিকার হন। সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর রেওয়াজটি সে জন্য কাটিয়ে ওঠা মুশকিল, যদিও এ পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধাজনক।
যেভাবেই কাহিনি বর্ণিত হােক উপন্যাসে-ছােটগল্পে, অনেকগুলি অসংগতি/হেত্বাভাস/বিরােধ তাতে উৎপাদিত হয় অনিবার্যভাবে। মােটা দাগে, তাদের আমরা শনাক্ত করতে পারি নিচের শ্রেণিবিভাগে :
ক. প্রধান অসংগতিটি আসে সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী থেকে। কে ওই বর্ণনাকারী? তিনি কি ঈশ্বর? যদি প্রতিটি চরিত্রের মনের খবর তার জানা থাকে, তাহলে তার বর্ণনারই বা কী প্রয়ােজন — পরিণতি তাে তার জানা।
খ. যদি লেখক হন সেই বর্ণনাকারী — কারণ লেখক এক্ষেত্রে স্রষ্টা, এবং অন্তর্যামী – তাহলে একটি নিতান্ত সংকীর্ণ অনুবিশ্বেই উপন্যাসটি স্থাপিত হয়, কারণ সেখানে অন্তর্যামী একজন সামাজিক মানুষ। যদি তাই হয়, তাহলে উপন্যাসটি বাস্তবানুগ হয় কীভাবে? মানুষ কি অন্তর্যামীর স্থান নিতে পারে?
গ. উত্তমপুরুষ বর্ণনায় এই বিরােধটির কোনাে সুরাহা হয় না। যদি আখ্যান একজন মানুষেরই হবে সেখানে ভিন্ন মানুষের একান্ত চিন্তাভাবনাগুলি কীভাবে দেখানাে যায়? যদি ভিন্ন মানুষের অন্তর্লোক উদ্ভাসিতই হয়, তাহলে উত্তমপুরুষ বর্ণনাকারী তাে পরিণত হন নিম-সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীতে। আর যদি ভিন্ন মানুষের প্রসঙ্গ শুধু referent হিসেবে আসে তাহলে কাহিনি শিগগিরই থমকে দাড়ায়, যদি না প্রচণ্ড তীব্রতা নিয়ে ওই কাহিনিকে বর্ণনা করতে পারেন ঔপন্যাসিক তাঁর নির্বাচিত ‘আমি’র বয়ানে।।
ঘ. যেহেতু উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনায় গ্রহণ-বর্জনের একটি ব্যাপার আছে, বিন্যাসের একটি প্রয়ােজন আছে, সেহেতু কোনাে উপন্যাসই আসলে বাস্তবানুগ বা বাস্তববাদী বলে নিজেকে দাবি করতে পারে না। উপন্যাসে বড়জোর বাস্তবের একটি বিভ্রম সৃষ্টি করা যায়, কিন্তু সেটি অতিশয় নিয়ন্ত্রিত বাস্তব।
ঙ. উপন্যাসে ওই বিষয়টি অবহেলা করা হয়েছে, অন্তত বাস্তববাদী উপন্যাসে, এবং চেতনাপ্রবাহের উপন্যাসের উদ্ভবের আগে, যে, মানুষের অন্তর্লোকে সময়ের অনুভবটি কিছুতেই ঘড়ির কাঁটাকে নির্ভর করে হয় না : সেখানে সময় নিতান্তই আপেক্ষিক, স্থিতিস্থাপক। যেখানে এরকম একটি মৌলিক বিষয়ে অবহেলা পরিলক্ষিত হয়, সেখানে বাস্তবানুগ কথাটি বিশ্বস্ততা হারায়।
চ. সর্বোপরি, উপন্যাসের ভাষা যদি নিজস্ব সাংকেতিক সম্ভাবনা– যাকে উমবার্তো ইকো বলেন semantic possibilities – তৈরি করতে চায়, যা প্রতিটি উপন্যাসে একটি অঘােষিত উদ্দেশ্যরূপে থেকেই যায়, তাহলে বর্ণনাকারীর সীমাবদ্ধ ফ্রেমে ভাষাকে আটকে দিলে তার সম্ভাবনা অনেকটাই তিরােহিত হয়। বর্ণনাকারীর নির্দিষ্ট আখ্যানটি যে সংকেত সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে, তাতে একটি গন্তব্যেই তাকে ধাবিত করা যাবে : একাধিক গন্তব্যের জন্য একাধিক ভাষা-তল প্রয়ােজন, একাধিক কণ্ঠস্বর প্রয়ােজন। অথচ উপন্যাসকে এই সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই সংকেত-বিশ্ব নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছে।

নির্বাচন ও গণতন্ত্র

এরা কথা বলতে পারে না

চ্যাটজিপিটিতে নতুন সুবিধা

হোয়াটসঅ্যাপের আতঙ্ক ভিডিও প্রতারণা

যাঁরা খেজুর খেতে চান না, তাঁদের জন্য কিছু তথ্য

যে কারণে ড. ইউনূসকে ৫ বছরের জন্য চাচ্ছেন সাধারণ মানুষ

সফল বিনিয়োগ সম্মেলন: অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে পৃথিবী

গ্রীন কার্ডধারীকে এয়ারপোর্টে আটক, নগ্ন করে জিজ্ঞাসাবাদ এবং গ্রীন কার্ড বাতিলের চেষ্টা

হাসনাতের ফেসবুক পোস্টে তোলপাড়

সেনাপ্রধান বুকে পাথরচাপা দিয়ে ড. ইউনূসকে মেনে নিয়েছিলেন: আসিফ
Trending
-
বাংলাদেশ2 weeks ago
যে কারণে ড. ইউনূসকে ৫ বছরের জন্য চাচ্ছেন সাধারণ মানুষ
-
বাংলাদেশ1 week ago
সফল বিনিয়োগ সম্মেলন: অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে পৃথিবী
-
কমিউনিটি সংবাদ1 week ago
নিউইয়র্কে ‘অবৈধ অভিবাসীদের বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনার
-
বাংলাদেশ10 hours ago
বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান সখ্য: কৌশলগত চ্যালেঞ্জে ভারত