বিবিধ
মুক্তগদ্য | লেখকদের ঘরবাড়ি
Published
7 months agoon
তাদের মাথার ভেতরে বয়ে চলা ভাবনার স্রোতে কখনো কি বুদ্বুদের মতো জেগে উঠত ঘরবাড়ি শব্দটা? কখনো সাধারণ আসবাবপত্র আর নোনা ধরা মলিন দেয়াল দিয়ে সেলাই করা মেসবাড়ির ছোট্ট ঘর, কখনো চার দেয়ালে ঘেরা সুশৃঙ্খল ঘরের ধারণা তাদের মনের মধ্যে ছায়াছবির মতো ফুটে উঠত? স্বপ্ন দেখতেন তারা একটা বাড়ির? কিন্তু সে কোন বাড়ি? মনের মধ্যে দিয়ে তো আলগা মাটির অসাবধানী পথ চলে গেছে ঘরবাড়ির ধারণা ছাড়িয়ে বহুদূরে। সেই পথ কোথাও গিয়ে সত্যিকারের কোনো আশ্রয়ে শেষ হয়েছিল? শেষ হয় কখনো? ছায়াপথ ধরে মহাকালিক সময়ের দিকে চলে যাওয়া সেই পথের পাশে তো তাদের কলমের অবিশ্রান্ত প্রয়াসে ফুটে উঠতে দেখি অন্যসব ঘরবাড়ির ছবি, গৃহী অথবা ঘরহীন মানুষের গল্প।
লেখকদের ঘরবাড়ি কেমন হয়? উদগ্র লোভের আগুনে পোড়ানো টাকায় তাদের বাড়িঘর কখনো তৈরি হয়নি। ভীষণ বৈভবের ঝালরও সেখানে হাওয়ায় দুলে ওঠেনি কখনো। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসের এক রোববারে তার ডায়েরিতে লেখেন, “একটা বাড়ি চাই। এ মাসের মধ্যেই। ভোরে উঠেই বরানগর রওনা। শরীর ভালো না। শচীনবাবু মিনিট দশেক পরে এলেন। নিজের অংশ ভালো-ভাড়াটে অংশ যেমন তেমন। ভাড়া ৬০ টাকা। অগ্রীম ছয়’শ টাকা। তাই সই! পড়েছি ফাঁদে।” মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরির পৃষ্ঠায় একটা ভাড়াটে বাড়ির জন্য অস্থিরতা যখন শব্দে পরিণত হচ্ছে তার বছর পনেরো পর এই ঢাকা শহরের হাটখোলা অঞ্চলের কেএম দাস লেনে সন্ধ্যাবেলা একটা দোতলা বাড়ির সামনের রাস্তায় হাফহাতা গেঞ্জি আর পায়জামা পরে দাঁড়িয়ে হরদের গ্লাস কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন আরেক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তার পেছনেই একটা দোতলা বাড়ির একতলার ভাড়াটে তিনি। সেই বাড়িই কি তার আশ্রয় ছিল? বাড়ির কর্তা বাংলাদেশের আরেক কথাশিল্পী শওকত আলী। কেএম দাস লেনেই জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়ে গেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। শওকত আলীর বাড়ির ভাড়াটে হয়ে এসেছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই। সেই ভাড়াটে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অথবা কখনো বারান্দায় বসে জমে উঠত তার আড্ডা। নানান পেশার মানুষদের সঙ্গে গল্প করতেন। বাড়ির বাচ্চাদের শোনাতেন ভূতের গল্প। তখনো সেই বাড়িটার দেয়ালে ‘বিরতি ভিলা’ নামটা লাগেনি। তখন চারপাশটা বেশ খোলামেলাই ছিল। পরে বাড়িটার এ নামকরণ হয়। অন্য ঘরবাড়ির ভিড় গলা টিপে ধরেনি পাড়াটার। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পর বাড়ি বদলে যান আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। গলির শেষ মাথায় এক চিকিৎসকের গাছপালা ছাওয়া বাড়ির পেছন দিকে একটা লাল রং করা ছোট বাড়িতে ওঠেন নতুন ভাড়াটে হয়ে। ইংল্যান্ডের চেলসির টাটে অঞ্চলে এমনি একটা লাল রং করা বাড়িতে থাকতেন নাট্যকার, ঔপন্যাসিক অস্কার ওয়াইল্ড। উচ্ছৃঙ্খল অস্কার ওয়াইল্ড, সমকামী অস্কার ওয়াইল্ড। তার জীবন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। তার নিজের জীবন প্রদীপ কিন্তু নির্বাপিত হয়েছিল এক অখ্যাত হোটেলের ছোট্ট কামরায় দেয়ালে লাগানো ওয়াল পেপারের একঘেয়ে নকশা দেখতে দেখতে। মৃত্যুর আগে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘মনে হয় এই ওয়ালপেপারের ঘর থেকেই বিদায় নেব আমি।’ লাল রং করা সেই বাড়ির একতলার ঘরে বসেই তিনি লিখেছিলেন ‘পিকচার অব দ্য ডরিয়ান গ্রে’ উপন্যাস। সম্প্রতি নিলামে সেই বাড়িটা বিক্রির জন্য দর হাঁকা হয়েছে এক মিলিয়ন পাউন্ড।
পটার কাহিনি লিখে বিশ্বখ্যাত লেখক জে কে রাউলিংস স্কটল্যান্ডের এডিনবর্গে দুই মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে বাড়ি কিনেছেন। তার এ ঠিকানাকে বাড়ি বললে অপমানই করা হবে; বলা যেতে পারে প্রাসাদ। কিন্তু ফ্রাঞ্জ কাফকার শেষ বাড়ি কোথায় ছিল? অসুখে ক্ষতবিক্ষত কাফকার শেষ ঠাঁই হয়েছিল অস্ট্রিয়ার কোলস্ট্রেনবার্গ শহরের কেরলিংয়ের এক স্যানিটোরিয়ামে। সেটাই ছিল কাফকার ‘ডেথ হাউস’।
সাত বছর ধরে ভয়ংকর টিবি রোগ ছিন্নভিন্ন করেছিল কাফকাকে সেই তিনতলা বিষণ্ন স্যানিটোরিয়ামের একটা ঘরে। বাড়িটা এখন বদলে গেছে। যেরকম বদলে যায় লেখকদের ঘরবাড়ি। হয়তো অজানা বিপর্যয়ের শিকার হয়ে নিজের ভেতরেই উন্মূল হয়ে তারা ঘুরতে থাকেন একা। কাফকার স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ি চলে গেছে এখন ভাড়াটেদের দখলে। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, তাদের মধ্যে কেউ ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাস লেখায় সক্ষম নন। তবে অস্ট্রিয়ার সরকার সেই বাড়িতে কাফকার স্মৃতি ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছে। সেই ঘরটা অনন্য এই কথাসাহিত্যিকের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রেখেছে। ঘরের দরজায় স্মৃতি ফলকে লেখা আছে ‘দ্য ডেথ হাউস’। ঘরের লাগোয়া সামান্য পরিসরে একটা বারান্দা আছে। তখন এ ধরনের রোগীদের আলো-বাতাসে থাকার জন্য চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে লিখে দিতেন। সেই বারান্দায় ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসের রোদে খালি গায়ে কাফকাকে বসে থাকতে দেখেছিল কেরলিংয়ের বাসিন্দারা। সেই স্মৃতিঘরে সাজিয়ে রাখা আছে স্বজনদের কাছে লেখা কাফকার শেষ চিঠি, হাসপাতালের ডেথ সার্টিফিকেট আর কিছু লেখার ব্যবচ্ছেদ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা। একটা বাড়িতে গদ্যশিল্পী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বসবাস। শোনা যায় সত্তরের দশকে সেই অপরিসর আশ্রয়স্থলে লেখালেখি করার সুবিধা না থাকায় একবার পূজা সংখ্যার জন্য উপন্যাস লেখা শেষ করেছিলেন বাড়ির সিঁড়িতে বসে। ছায়াছবি, সব ছায়াছবির মতো। সব অস্পষ্ট মেঘের মতো ভেসে আসা গল্প। লেখকরা সেই ছায়াছবির অস্পষ্ট চরিত্র। আশির দশকের মাঝামাঝি ঢাকার পুরানা পল্টনে রবিন প্রিন্টার্সের গলিতে এক চিলেকোঠায় বসবাস করতেন কবি হেলাল হাফিজ। কাকের বাসা হয়তো। গাছের মাথায় অস্থিতিশীল দুই কামরার ঘর। সকালবেলা গিয়ে দেখেছি ঘর ঝাড় দিচ্ছেন কবি। চেয়ারের মাথায় ঝুলছে গত রাতের ক্লান্ত জামাকাপড়। পাশের ঘরের আরেক উন্মূল বাসিন্দা সাংবাদিক শফিকুল আজিজ মুকুল। দুজনই চিরকুমার। মুকুল ভাইয়ের সৌজন্যে চা জুটে যেত কোনো কোনো দিন। ঘরবাড়ির স্বপ্ন দেখেননি কোনো দিন হেলাল হাফিজ। মুখে বলতেন জাতীয় প্রেস ক্লাব তার সেকেন্ড হোম। ফার্স্ট হোম কোনো দিন ছিল এই আপাদমস্তক বোহেমিয়ান কবির? যেরকম কবি সাবদার সিদ্দিকির একদা সেকেন্ড হোম ছিল প্রেস ক্লাবের সামনে একটি গাছের ডালে। কিছুদিন সেই বৃক্ষের ডালকেই নিজের ঘর বলে বেছে নিয়েছিলেন ষাটের দশকের আপাদমস্তক ভবঘুরে সেই কবি।
লন্ডনের প্রিমরোজ হিলের ২৩ নম্বর ফিটজিরয় রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন কবি সিলভিয়া প্লাথ। ১৯৬২ সালে কবি টেড হিউজের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কের ইতি ঘোষণা করে বাড়ি খুঁজছেন তিনি। হঠাৎই জানতে পারলেন কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের ভাড়া করা এ বাড়িটি লিজ দেওয়া হবে। দেরি করেননি প্লাথ। পাঁচ বছরের চুক্তিতে সেই বাড়িতে উঠে আসেন তিনি। সেই বাড়িতে তার লেখাপড়া করার ঘরটা ছিল পুবমুখী। সকালবেলা আলো দম নিতে আসত সেই ঘরে। লাগোয়া বারান্দায় রোদ পড়ে থাকত অনেকটা সময়। প্রিয় বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থাকতেন সিলভিয়া প্লাথ। কিন্তু ১৯৬৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সেই বাড়িতেই স্টোভে মাথা ঢুকিয়ে নির্মম মৃত্যুকে ডেকে নেন তিনি। ‘শিশুটিও ছিল পাশে’ জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন কবিতায়। তিনি কি প্লাথের মৃত্যুদৃশ্য রচনা করেছিলেন নিজের কবিতায়? সন্তানদের একটা ঘরে আটকে রেখে দরজার নিচের ফাঁকা অংশ আটকে দেন টেপ দিয়ে। তারপর ধীরপায়ে হেঁটে চলে যান রান্নাঘরে। সেখানে স্টোভ চালু করে সব দরজা-জানালা বন্ধ করে শান্ত ভঙ্গিতে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দেন ভেতরে। মৃত্যু, যন্ত্রণাকাতর মৃত্যু নেমে এসেছিল তখন চারিধারে। তার নিঃশব্দ কান্নার সঙ্গে সেদিন মিশে গিয়েছিল ফিটজিরয় রোডের রান্নাঘরের বিষাক্ত বাতাস।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা তার কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ওরা আমাকে কোথাও খুঁজে
পেল না’। লোরকাকে কি এই পৃথিবীর বিষণ্ন আকাশ, হাওয়া অথবা সব নির্ঘুম শহর
কোথাও খুঁজে পেয়েছিল? তাকে পাওয়া না গেলেও তার বাড়িঘর পুরোটাই খুঁজে পাওয়া যায় স্পেনের গ্রাম আর শহরে। লোরকা বেড়ে উঠেছিলেন স্পেনের ভ্যাকারুস নামে গ্রামে। সবুজ দরজা-কপাটঘেরা সেই বাড়িতে কেটেছিল লোরকার শৈশব, কৈশোর। শহরে উঠে এসে বসবাস শুরু করেন ফিলডুরিবিও নামে এলাকায়। সেখানে বসেই তিনি লেখেন বিখ্যাত নাটক ‘হাউস অব বার্নাডা আলবা’। তবে যে ভোরে ঘাতকরা কবিকে নিয়ে যেতে এসেছিল বধ্যভূমির দিকে, সেদিন তিনি এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন।
সিলভিয়া প্লাথের মতো রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি স্টোভে মাথা ঢুকিয়ে দেননি। মস্কো শহরের কার্সেনিয়া পার্সেনিয়া স্ট্রিটের অনেক বাড়ির ভিড়ে শরীর ডুবিয়ে দেওয়া একটি ফ্ল্যাটে কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দিয়েছিলেন। সেই ফ্ল্যাটটি এখন জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে।
ওয়াজ–বয়ানের আদবকায়দা ও শিষ্টাচার
টিউলিপ যেভাবে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলেন
কেন এই বিএনপি-জামায়াত বিরোধ, শেষ কোথায়
সব দরজা বন্ধ হলেও ফিলিস্তিনিরা পথ খুঁজে নেয়
সংস্কারের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
নিউইয়র্কের মিলন ও সস্ত্রীক কল্লোল পেলেন বাংলাদেশ সরকারের সিআইপি অ্যাওয়ার্ড
শেখ পরিবারের সীমাহীন দুর্নীতি: অনুসন্ধানে ৫ কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে দুদক
স্মরণ | বাংলা সাহিত্যাকাশে অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র আবদুল মান্নান সৈয়দ
আ.লীগের মন্ত্রী-সাংসদদের বিরুদ্ধে এক ডজন মামলার প্রস্তুতি দুদকের
ভিসা নীতি শিথিল করলো যুক্তরাষ্ট্র
Trending
-
বাংলাদেশ10 hours ago
শেখ হাসিনা কি ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন?
-
বাংলাদেশ10 hours ago
বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম বদলের প্রস্তাব: বাদ যাবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা
-
নিউইয়র্ক10 hours ago
বারবার ঘড়ির সময় পরিবর্তনের বিপক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্প
-
নিউইয়র্ক10 hours ago
নিউইয়র্ক সিটিতে নথিপত্রবিহীন অভিবাসী ধরপাকড় শুরু