Connect with us

বিবিধ

ঢাকায় কার্টুনে কার্টুনে জুলাই বিদ্রোহ

Published

on

ঢাকায় কার্টুনে কার্টুনে জুলাই বিদ্রোহ

ক্যালেন্ডার বলছে ভাদ্র। আকাশও বলছে তাই। এই মেঘ, এই আবার রোদ্দুর। কে জানে কখন বৃষ্টি হয়! অগত্যা ইলশেগুঁড়ির ভয় নিয়েই পৌঁছে গেলাম পান্থপথ। যেতে হবে দৃকপাঠ ভবন। ভবনটি শহরে বেশি পরিচিত দৃক গ্যালারি নামে। সেখানে চলছে বিশেষ এক প্রদর্শনী। সেটি দেখতেই হাজারও উৎসুকের মত আমারও যাওয়া।
আয়োজনের পোস্টার ক’দিন আগে থেকেই ঘুরছিল ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে। ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’। নাম শুনেই বুঝে নেয়া যায় সব। ১৬ থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট নেটওয়ার্ক, দৃক এবং ই-আরকির সম্মিলিত এই আয়োজন। প্রথম দিনের প্রথম মুহূর্ত থেকেই দৃকপাঠ ভবনের ৮ম তলা ভরে উঠেছিল দর্শনার্থীতে!
কার্টুনের মাধ্যমে বিদ্রোহ পুরনো বিষয়। মতপ্রকাশের নিদারুণ সংকোচ যখন ছিল, তখনও কোন কোন কার্টুনিস্ট ঝুঁকি নিয়ে এঁকেছিলেন বিদ্রোহের কার্টুন। তবে তা ছিল হাতেগোনা। এরপর ঘটে অভূতপূর্ব এক ঘটনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে জেগে ওঠে পুরো দেশ। এই আন্দোলনের শুরুর দিনগুলো থেকেই কার্টুনিস্টরা তাদের হাতে তুলে নেন রংপেন্সিল আর তুলি। আঁকেন একের পর এক জ্বালাময়ী কার্টুন। তখন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা জুগিয়েছিল তাদের আঁকা এসব ব্যঙ্গচিত্র। আন্দোলনে ব্যবহৃত সেই কার্টুনগুলো নিয়েই এই ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’ প্রদর্শনী।
বিকেল তিনটে। দৃকপাঠ ভবনে পৌঁছতেই লিফটের সামনে বিশাল লাইন। আট তলায় গিয়ে আবারও ধাক্কা। শুরু হতে না হতেই তিল ধারণের ঠাঁই নেই গ্যালারিতে! একজায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে গেলে রীতিমতো ধাক্কাই খেতে হচ্ছে। জেন-জিরাই সংখ্যায় বেশি, অন্য জেনারেশনের মানুষজনও কম নেই। ছোট থেকে বড়, সবাই এসেছেন কালের সাক্ষী হতে।
চারদিকে দেয়ালে প্রিন্ট করা সারি সারি কার্টুন। ওপরে লম্বাকৃতির ফেস্টুন। সেখানেও জ্বালাময়ী সব ব্যঙ্গচিত্র। ঢুকতেই ডানপাশে বড় অনুষ্ঠানের পোস্টারটি ঝোলানো। শুধু কার্টুনই নয়, জুলাই বিপ্লবের স্মৃতিচারণে প্রদর্শনীতে রয়েছে বেশ কিছু আয়োজন। ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’, হিরোক রাজার দেশে চলচ্চিত্রের বিখ্যাত এই সংলাপটি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। সেটিকে ফুটিয়ে তুলতেই স্বৈরাচারের ম্যুরালে দড়ি লাগিয়ে হাজির করা হয়েছে প্রদর্শনীতে। দর্শনার্থীরা চাইলে সে দড়ি টেনে ধরে ছবি তুলতে পারছেন।
হোসনে আরা রাখি ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছেন প্রদর্শনী দেখতে। পুরো আয়োজন দেখে বেশ অভিভূত তিনি। বললেন, এই কার্টুনগুলোর কিছু কিছু একসময় শেয়ার করেছেন নিজের ফেসবুকে। সবগুলো একসাথে দেখতেই পেরে দারুণ লাগছে তার। “একসাথে সবগুলো কার্টুন, এই পুরো আইডিয়াটাই আমার খুবই ভালো লেগেছে। আন্দোলনের বড় একটা হাতিয়ার ছিল এইগুলো,” বললেন রাখি।

প্রদর্শনীর একপাশে সুতোয় ঝুলছিলো কিছু পানির বোতল। তাতে একটা শব্দই লেখা। মুগ্ধ। ১৮ জুলাই আন্দোলনের মিছিলে সবাইকে পানি খাওয়াচ্ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রেফেশনালস এর শিক্ষার্থী মীর মুগ্ধ। সে মিছিলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ‘ভাই পানি লাগবে কারও, পানি’, তার বলা এই কথাগুলো কাঁদিয়েছে সারা বাংলাদেশকে। তাকে স্মরণেই রাখা হয়ছে বোতলগুলো।
প্রদর্শনীতে কোনো করুণ আবহসংগীত নয়, সারাক্ষণ বেজে চলেছে আন্দোলনের দিনগুলোতে তৈরি জ্বালাময়ী সব র্যাপ গান। অন্যপাশে টেলিভিশনে সারাক্ষণ চলছিল জুলাই বিপ্লবের প্রতিটি দিনের সংবাদ। দু’পাশে দুইটি আলাদা ক্যানভাস রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য, সেখানে নিজের ইচ্ছেমতো স্লোগান লিখছেন তারা।
রাফসান রুদ্র তার কলেজের বন্ধুদের সাথে এসেছেন। কিছু একটা লিখতে ক্যানভাসের দিকে গেলেন তিনি। কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি লিখেছেন, ‘Patria o Muerte’, যার অর্থ মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু। লাতিন বিপ্লবী চে গেভারা জাতিসংঘে দেয়া এক বক্তৃতায় বলেছিলেন এ কথা। জুলাই আন্দোলনে এটিও বহুল ব্যবহৃত হয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে।
কথা হলো আয়োজনের কিউরেটর এ এস এম রেজাউর রহমানের সাথে। জানালেন, আন্দোলনের সময় আঁকা কার্টুনগুলোর থেকে বাছাই করে প্রায় দেড় শতাধিক কার্টুন নিয়ে এই আয়োজন করেছেন তারা। বললেন, পুরো আন্দোলনের সময় প্রকাশিত সবগুলো কার্টুন তুলে আনা সম্ভব হয়নি। তবে যে কার্টুনগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে, তা আমাদের ছাত্র আন্দোলনের জ্বলজ্বলে সময়টায় নিয়ে যাবে।
“পুরো আয়োজনটাই তারুণ্য নির্ভর। যে কার্টুনগুলো এঁকেছে তরুণেরা, সেগুলো গণমানুষকে উজ্জীবিত করেছে। আন্দোলন যখন শেষ হলো, এই কার্টুন প্রদর্শন এক অর্থে সেলিব্রেশন,” বললেন রেজাউর রহমান। জানালেন, ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’ দৃক গ্যালারিতে সবচেয়ে দর্শকনন্দিত প্রদর্শনী। “কার্টুন মাধ্যমটা মানুষের দারুণ আগ্রহের জায়গা। গণমানুষের সাথে এর যোগাযোগ খুব দ্রুত হয়। মানুষ আসছে, মজা পাচ্ছে, তারা এক অর্থে আন্দোলনের স্মৃতিচারণও করছে। প্রতিদিন শতশত মানুষ আসছেন। আমাদের এই গ্যালারিতে যতগুলো প্রদর্শনী হয়েছে তার মধ্যে সবথেকে বেশি দর্শক হয়েছে এই প্রদর্শনীতে।”
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক কার্টুন বলতেই যার নাম প্রথম দিকে আসে, তিনি মেহেদী হক। স্বৈরাচারী সরকারের কারণে রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র আঁকায় যে অচলায়তন এতদিন ছিল, তা ভেঙ্গ গেছে বলে মনে করেন এই কার্টুন শিল্পী। এক্ষেত্রে তরুণ কার্টুনিস্টদের এগিয়ে আসাকে সবচেয়ে ইতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখছেন তিনি। বললেন, “এইবারে যা হলো (কার্টুন নিয়ে) তা অভূতপূর্ব, বিরাট ব্যাপার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো তরুণদের অংশগ্রহণ এখানে বেশি। এটা খুবই পজিটিভ বিষয়। আমার ধারণা এই বিষয়টি অব্যাহত থাকবে।”
নানাবিধ কারণে এতদিন যারা রাজনৈতিক কার্টুন আঁকেন নি, তারা আঁকবেন, পত্রিকাগুলোও কার্টুনকে আবারও গুরুত্ব দেবে বলে মনে করেন মেহেদী হক। “আমার ভয় ছিল যে, তরুণেরা কি আর আঁকবে না? এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেই শঙ্কা দূর হয়েছে। আরেকটা ব্যাপার হলো, যে পরিমাণ দর্শক এখানে আসছে সেটিও অভূতপূর্ব,” বললেন তিনি।
এর মাধ্যমে পলিটিক্যাল কার্টুন এর নতুন যুগের সূচনা হলো বলেও তার মত। তবে সেক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে পত্রিকাগুলোকে।
‘কার্টুনে বিদ্রোহ’তে দশোধিক কার্টুন প্রদর্শিত হচ্ছে জনপ্রিয়, তরুণ কার্টুনিস্ট মাহতাব রশীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এই শিক্ষার্থী জানালেন, গত বছরগুলোতে অনেকেই কার্টুন এঁকেছেন, তবে ভয় ছিল। সেলফ সেন্সরশিপ নিয়ে আঁকতে হয়েছে। যখন একটা ক্রান্তিকাল এলো, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে গেলো মানুষের, দেখলেন রাস্তায় মানুষ মারা যাচ্ছে তখন আর এই সেন্সরশিপ কাজ করেনি। কেউ আর আঁকতে গিয়ে ভয়ও পায় নি।

“যারা কার্টুন আঁকেন না, অন্য কোনো শিল্প বা দৃশ্য মাধ্যমে কাজ করেন, তারাও এবার কার্টুনের প্রতি উদ্ভুদ্ধ হয়েছেন। প্রদর্শনীতে মানুষের অংশগ্রহণ খুবই বেশি। শুক্র-শনিবার তো ঢোকার জায়গাই ছিল না। এত ভিড় দৃক বা আমরা, কেউ-ই আশা করি নি! গতকাল কর্মদিবসেও অনেক ভিড় ছিল। এটা একই সাথে আনন্দ দেয়, আগ্রহ জাগায়,” বললেন মাহতাব।
প্রদর্শনীতে ঢোকার মুখে দেখা মিলবে একটি ছোট স্টলের। এখানে বিক্রি হচ্ছে নানান জিনিস। সবই প্রদর্শনীর সাথে সম্পর্কিত। ই-আরকির তত্ত্বাবধানে এখানে বিক্রি হচ্ছে কার্টুন সম্বলিত টি-শার্ট, নোটবুক, টোট ব্যাগ এবং পোস্টার। পোস্টারের স্মারক মূল্য ১০ টাকা। টি-শার্ট ৪৫০, নোটবুক ৩৫০ এবং টোটব্যাগও পাওয়া যাচ্ছে ৩৫০ টাকায়। এছাড়া তিনটি একত্রে নেয়া যাচ্ছে ৭৯৯ টাকায়।
স্টলের স্বেচ্ছাসেবক হাসান মাহমুদ জানালেন, “এত পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে যে অনেকে ভিড় ঠেলে কিনতেই পারেন নি। প্রথম দুইদিনেই পোস্টার শেষ হয়ে গিয়েছে। তবে সামনে নতুন পোস্টার আসবে।”
ফারুক হাসান একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। পুরো আয়োজন দেখে এসে জানালেন, তিনি অভিভূত। বললেন, “এমন সময় গেছে, যখন আমরা অনেকেই কিছু লিখতে পারতাম না। তখন এই একেকটা কার্টুন হাজারও কথার সমান কাজ করেছে। এগুলো যদিও শেয়ার করতে পারতাম না, তবে দেখতাম ছেলেমেয়েরা করছে। তাতে অনেক অব্যক্ত কথাই বলা হয়ে যেত।”
সম্পূর্ণ আয়োজন সম্পর্কে ই-আরকি’র কর্ণধার সিমু নাসের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, প্রদর্শনীতে জুলাই বিপ্লবের সময় ৮২ জন কার্টুনিস্টের আঁকা ১৭৫টি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। আয়োজকদের হাতে সাড়ে পাঁচশোর মত কার্টুন রয়েছে। শীঘ্রই ই-আরকি থেকে একটি সংকলন বের করবেন তারা।
‘কার্টুনে বিদ্রোহ’ প্রদর্শনীতে কেউ যদি যান, গ্যালারিতে লাল রঙের আধিক্য আপনাকে মনে করিয়ে দেবে সেইসব রক্তমাখা দিনগুলোর কথা। যখন চারদিকে মিলেমিশে গিয়েছিল হাহাকার আর প্রতিবাদের সুর। তরুণের বুকের রক্ত দিয়ে আদায় করেছিলো অধিকার, বিদায় নিতে হয়েছিল স্বৈরাচারকে।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending