Connect with us

বিবিধ

ইতিহাস: বাংলাকে অখণ্ড রাখার ব্যর্থতা

Published

on

ইতিহাস: বাংলাকে অখণ্ড রাখার ব্যর্থতা

ইলিয়াস শাহকে ঐতিহাসিকরা ভূষিত করেন শাহ-ই-বাঙ্গালাহ ও সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ অভিধায়। তিনিই প্রথমবারের মতো সাতগাঁও, সোনারগাঁ ও লক্ষ্ণৌকে একত্র করে বাংলাকে ‘অখণ্ড অস্তিত্ব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার সময়েই নিয়ন্ত্রণে আসে বিহার ও ওড়িশাও। ইলিয়াস শাহ মারা যান ১৩৫৮ সালে। তারপর নানা সময়ে বাংলার পরিসীমা বিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ বলে আজকে যে ভূখণ্ডটিকে বোঝানো হয়; ঐতিহাসিকভাবে গত কয়েকশ বছরে কখনই সেটা এত ছোট ছিল না। যেহেতু ১৯৪৭ সালের সিদ্ধান্তই বাংলার বর্তমান ভৌগোলিক পরিচয়কে নির্ধারণ করেছে; ফলে বাংলার পরিসীমার প্রসঙ্গ উঠলেই সঙ্গে চলে আসে সাতচল্লিশের কথা, বাংলাকে অখণ্ড রাখতে ব্যর্থতার কথা। যেহেতু সে সময়ে বাংলার ভাগ্য নিয়ন্তাদের তালিকায় গোড়ার দিকেই ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্বাভাবিকভাবেই তিনিও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন আলোচনার মজলিসে।
১৯৪৬ সালে বাংলায় গঠন হয় পার্টিশন কাউন্সিল। সমানসংখ্যক হিন্দু ও মুসলিম সদস্য নিয়ে। কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক বারোজ। সেখানে মুসলিম লীগ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বেশ জোরের সঙ্গেই তিনি দাবি করেন, কলকাতার মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলনে প্রথম সারিতে ছিল এবং তাদের ত্যাগের পরিমাণও বেশি। এমনকি কলকাতা তৈরিই হয়েছে পূর্ব বাংলার মানুষের পাট চাষ থেকে প্রাপ্ত সম্পদে। ফলে কলকাতা বাংলার অংশ। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে তিনি পূর্ব বাংলাকেই বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ এবং প্রধান বাংলা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

 

তার দাবি, প্রথমত, পূর্ববাংলা কোনোভাবেই কলকাতা থেকে শাসিত হবে না; দ্বিতীয়ত, ক্ষতিপূরণ হিসেবে দ্বিতীয় একটি রাজধানী স্থাপন করতে হবে। সোহরাওয়ার্দীর চিন্তা যেমনই থাক, গভর্নর বারোজ তার যুক্তিতে যেন নতুন পাটাতন খুঁজে পেলেন। বাংলারই একজন মুসলিম রাজনীতিক কলকাতাকে পশ্চিম বাংলায় ছেড়ে আসার পক্ষে ভোট দিচ্ছেন, এটা যথেষ্ট চমৎকৃত হওয়ার ঘটনা।
বাংলার মুসলিম রাজনীতিকদের বড় একটা অংশ কলকাতাকে পূর্ব বাংলায় রাখতে না পারা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আসলে সিদ্ধান্তটি খোদ সোহরাওয়ার্দীর জন্যই ধ্বংসাত্মক ছিল। কারণ কলকাতা ছিল সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির শক্তিশালী ঘাঁটি। এ ঘটনার পরে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অপমৃত্যু ঘটতে শুরু করে। কলকাতা পরিণত হতে থাকে পরিত্যক্ত নগরীতে। চট্টগ্রাম পেতে থাকে গুরুত্ব। মুসলিম নেতারাও ক্রমে চলে আসতে থাকলেন ঢাকার দিকে। কিন্তু গল্পের বড় অংশটা সামনে আসে সিলেটের গণভোটের পর। সে সময় অন্তত ১৭ জন সংসদ সদস্য যোগ দেন মুসলিম লীগে। সোহরাওয়ার্দীর সামনে তাদের প্রস্তাব ছিল, তিনি যেন তাদের মধ্য থেকে তিনজন মন্ত্রী ও তিনজন সচিব বানানোর ওয়াদা দেন। সেটা করলে তারা সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন দেবেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী নির্বাচনের আগে কোনো প্রকার ওয়াদা দিতে নারাজ ছিলেন। হতাশ হয়ে তারা খাজা নাজিমুদ্দিন ও অন্যান্য প্রার্থীকে একই প্রস্তাব দেন। সে নেতারা এমন সুযোগ সামনে পেয়ে লুফে নিলেন। আসলে সোহরাওয়ার্দীকে খোদ মুহম্মদ আলি জিন্নাহ আশ্বস্ত করেছিলেন, পূর্ব বাংলায় সংসদীয় নেতৃত্ব নিয়ে আপাতত কোনো নির্বাচন হবে না। সোহরাওয়ার্দীও ব্যস্ত ছিলেন বাউন্ডারি কমিশনে মুসলিম লীগের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে। কিন্তু জিন্নাহর বক্তব্যের বাইরে গিয়ে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলি খানের সহায়তায় সোহরাওয়ার্দীকে সরানোর পরিকল্পনা হচ্ছিল। লিয়াকত আলি খান সোহরাওয়ার্দীকে অপছন্দ করতেন ও তার প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিলেন। তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনকে সমর্থন দিলেন। স্বাভাবিকভাবেই হেরে গেলেন সোহরাওয়ার্দী। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন আর ঢাকা হলো রাজধানী। সোহরাওয়ার্দীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কলকাতা ছেড়ে আসার বিনিময়ে যে ক্ষতিপূরণের তোড়জোড় চলছিল, সেটাও হারিয়ে গেল। সোহরাওয়ার্দী ১৩ আগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারপর তিনি দুই প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

বাংলাকে অখণ্ড রাখার জন্য সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টা কম ছিল না। এমনকি খোদ মুসলিম নেতারাও চেষ্টা করেছেন বাংলাকে অখণ্ড রাখতে। কিন্তু বিষয়টি কংগ্রেসের কাছে মুসলিম লীগের চাতুর্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যখন বিভাজন পরিকল্পনা গৃহীত হয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা বিভাজনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার ঘোষণা ছিল ভারতের বিভাজন অনিবার্য, তবে বাংলাকে অবিভাজ্য রাখা জরুরি। জিন্নাহও দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন তিনি ‘ছিন্নভিন্ন, ক্ষতবিক্ষত পাকিস্তান’ কোনো অবস্থায়ই মেনে নেবেন না। তার পরও ব্রিটিশদের বাংলা বিভাজনের সিদ্ধান্ত মে মাসের মাঝামাঝি চূড়ান্ত হয় মাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বে। মাউন্টব্যাটেন তার দপ্তরের একমাত্র ভারতীয় কর্মকর্তা ভি পি মেনন এবং পণ্ডিত নেহরু ও সরদার প্যাটেলের মতো কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন বিষয়টি নিয়ে। অবশ্য পরিকল্পনার কথা এপ্রিলের মধ্যেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের জানা ছিল। প্রাথমিকভাবে বাংলার মুসলিম লীগ বাংলা বিভাগের পরিকল্পনা মানতে অস্বীকার করে। মুহম্মদ আলি জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার জন্য কাজ করতে বলেন। ওপর থেকে সম্মতি পেয়ে সোহরাওয়ার্দী বাংলার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, যাতে বিভাজন থেকে রক্ষা পেতে একটি পারস্পরিক সম্মত স্কিম তৈরি করা যায়। সে সময় সামনে তিনটা প্রস্তাব ছিল। রাগিব আহসানের প্রস্তাব ছিল বাংলা, আসাম, ঝাড়খণ্ড ও ছোটনাগপুর নিয়ে একটা কনফেডারেশন গঠন করা। ফজলুর রহমানের প্রস্তাব ছিল বাংলা ও আসামের সুরমা পর্যন্ত কার্জন লাইন ধরে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলকে একত্র করা। সবিশেষ হামিদুল হক চৌধুরীর প্রস্তাব ছিল যুক্ত বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত অঞ্চল। তিনটা প্রস্তাবই জিন্নাহর কাছে পাঠানো হয়। যদিও জিন্নাহর জবাব পরে আর জানা যায়নি। তবে বাংলা ও আসামকে একত্র করাটা ছিল অধিকাংশের প্রত্যাশা। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি আবুল হাশিম ও শরৎ চন্দ্র বসু বাংলাভাষী অঞ্চল নিয়ে একটা সার্বভৌম বাংলার নকশা সামনে আনেন, যার সীমানা হবে পূর্ণিয়া থেকে আসাম পর্যন্ত। তবে এর মধ্যে হিন্দু মহাসভা থেকেও বাংলা ভাগের দাবি ওঠে। সম্মতি দেন কংগ্রেসের সভাপতি আচার্য কৃপালিনী।

সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল খোলাখুলিভাবেই অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন দিল্লিতে। ২৮ এপ্রিল তিনি শরৎচন্দ্র বসু ও ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সেখানে খাজা নাজিমুদ্দিন, আবুল হাশিম ও ফজলুর রহমানও ছিলেন। গঠন করা হয় একটা সাব কমিটি। ১২ মে অখণ্ড বাংলা নিয়ে আলোচনা হয় গান্ধীর সঙ্গে। বাংলা থেকেও বিপুল জনসমর্থন তৈরি হয় যুক্ত বাংলার পক্ষে। সমালোচনা হয় হিন্দু মহাসভার বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে। ক্রমে বাড়তে থাকে সম্ভাবনা। ২০ মে একটা চুক্তি পর্যন্ত হয়ে যায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে বাংলাকে অখণ্ড রাখা নিয়ে। সোহরাওয়ার্দী সেটা জিন্নাহর কাছে আর শরৎচন্দ্র বসু গান্ধীর কাছে পাঠান। এ সময়েই ঘটে ইতিহাসের বাঁক। সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে ২৩ মে শরৎ বসুর চিঠির জবাবে গান্ধী বাংলাকে অখণ্ড রাখার প্রচেষ্টা থেকে দূরে থাকতে বলেন। বিভাজনের যে পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে, সেখানে কোনো বাধা দেয়া থেকে দূরে থাকতে বলেন শরৎ বসুকে। মূলত নেহরু ও প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনা করেই গান্ধী তার অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন সে সময়, যা বাংলার ভাগ্যকে নির্ধারণ করে দিয়েছে।

গান্ধীর থেকে আসা এমন নির্দেশনায় শরৎ বসু মর্মাহত হন। ঘোষণা করেন, ভারত ভাগ যদি পাপ হয়, তাহলে বাংলা ভাগ আরো বড় পাপ। কিন্তু তার পক্ষে সে অর্থে হিন্দু নেতাদের কোনো সমর্থন পেলেন না। শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রাও দেরাদুনে সরদার প্যাটেলের কাছেও প্রস্তাব উত্থাপন করেন; কিন্তু প্যাটেল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্যাটেলের দাবি ছিল, এটা সোহরাওয়ার্দীর চাতুরী। এটা করা হলে পশ্চিম বাংলাকে পাকিস্তানে যোগ দেয়ানো যাবে। সেটা হলে আসামও বাংলার সঙ্গে যুক্ত হবে। শেষমেশ প্যাটেল এ কথাও জানান, মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তার এ মর্মে গোপন সমঝোতা হয়েছে যে যদি ভারতকে ভাগ করতেই হয়, তাহলে বাংলাকেও ভাগ করতে হবে কলকাতাকে পশ্চিম বাংলার অংশে রেখে। ফলে বাংলার ভাগ্য তখন মূলত নির্ধারিত। যখন কংগ্রেস থেকে এভাবে প্রত্যাখ্যানের খবর এল, তখন জিন্নাহও বাংলার ভাগের ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করলেন। ফলে মাউন্টব্যাটেনের সিদ্ধান্তের আগ পর্যন্ত বাংলা ছিল বিশাল এক ভৌগোলিক পরিচিতি; কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর বিষয়টি সংকুচিত হলো। ঐতিহাসিকদের ভাষ্য, উনিশ শতকের শেষ দিকে যে হিন্দু রাষ্ট্র প্রকল্পের উত্থান ঘটে, তা বাংলায় জন্মলাভ করলেও একটা হিন্দু ভারত রাষ্ট্রের জন্য স্বপ্ন দেখেছে। সে হিন্দু ভারতের স্বপ্নে পৃথকভাবে বাংলা নিয়ে ভাবার সুযোগ অনেক নেতার হয়নি। ভাবেননি বাংলাকে ভাগ করার ব্যাপারটা। বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্তারাও হাতে রাখতে পারেননি পরিস্থিতির গতিপথ।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending