Connect with us

গল্প

গল্প | অশরীরী পিতা | কায়সার আহমদ

Published

on

গল্প | অশরীরী পিতা | কায়সার আহমদ

বসন্ত কাল। এমনই এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আমীনের সত্তরোর্ধ্ব বাবা রিকশা দুর্ঘটনার শিকার হলো। বয়সে তরুণ লম্বা ঢেঙ্গা রিকশাচালক ফাঁকা রাস্তা পেয়ে আমীনের পিতা বিপত্নীক আলীর অনুরোধ উপেক্ষা করে বেশ জোরে এই তিন চাকার যানটি চালাচ্ছিল। জনাব আলী খিলগাঁয়ে ব্যাংকের কাজ সেরে রামপুরা ওয়াপদা রোডে তার নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন। রিকশাটি ওয়াপদা রোডের কাছে এসে খুব দ্রুত গতিতে মোড় ঘুরতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে যায়। আর আলী সাহেব ছিটকে রাস্তায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। লোক জমায়েত হয়। এদের মধ্যে থেকে দুজন করিতকর্মা যুবক ধরাধরি করে আলী সাহেবকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং তার মোবাইল থেকে শেষ কলটি যে নাম্বার থেকে এসেছিল সে নাম্বারে ফোন করে। দেখা গেল সে নাম্বারটি আমীনের। সে ছুটে হাসপাতালে গেল এবং সেজো ও ছোট বোনকে খবর দিল। তারাও হাসপাতালে এল। বড় বোন থাকে আমেরিকায় এবং মেজো বোন কানাডায়। তাদের কাছেও খবর গেল।
আলী সাহেবের জ্ঞান ফেরাতে জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা ঘেমে গেলেন। তার জ্ঞান ফিরে এলে তাকে একটি নামকরা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে সেদিনই স্থানান্তরিত করা হলো। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেল তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে। ফলে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। দিন পনেরো হাসপাতালে থেকে তিনি বাসায় ফিরলেন। তার শীর্ণকায় দেহ আরো কৃশকায় হয়ে পড়ল। গলা ও পাঁজরের হাড় বের হয়ে গেল। গণ্ডদেশের অস্থি দৃশ্যমান হলো। চক্ষু কোটরের ভেতরে চলে গেল। অনেকদিন গোঁফ-দাড়ি না কামানোর ফলে শ্মশ্রুমণ্ডিত তার অস্থিচর্মসার মুখটি দেখলে যেকোনো শিশু ভয় পেয়ে কেঁদে উঠবে। বিছানায় পতিত আলী সাহেবের জন্য বেশ মোটা বেতনে একটি কাজের লোক ঠিক করা হলো যার কাজ হলো বৃদ্ধকে সময় মতো খাবার ও ওষুধ খাওয়ানো এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। আলী সাহেব শুধু খেতে পারেন কিন্তু কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যাল করে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। কোনো কথা বলেনও না বা কোনো কথার জবাবও দেন না। এভাবে তার দিন কাটতে লাগল।
তার পুত্র আমীন বুদ্ধিমান লোক। বাবার মৌচাকের বিশাল কাপড়ের দোকানের ব্যবসাটি এখন আমীনই চালায় তার প্রখর বিচক্ষণতা দিয়ে। আর যে ব্যক্তি চার বোনের একমাত্র ভাই এবং যার বাবার ঢাকায় দুটি ছয়তলা বাড়ি আছে তাদের বিচক্ষণতা অন্যদের চাইতে একটু বেশিই থাকে। সে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক টাকা ঢেলে একদিন রেজিস্ট্রি অফিস থেকে লোকজন বাসায় এনে অতিগোপনে ছয়তলা বাড়ি দুটি দানপত্র দলিলের মাধ্যমে মৃত্যুপথযাত্রী বুদ্ধিজ্ঞানলুপ্ত পিতার কাছ থেকে নিজের নামে লিখিয়ে নিল। বিষয়টি সে গোপনই রাখল। এই দিনটির জন্য সে সারা জীবন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। কী করে বোনদেরকে তাদের প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত করে তা নিজের নামে লিখিয়ে নেয়া যায় এ-নিয়ে সে অনেক ভেবেছে। পিতার কাছে পর্যন্ত খোলাসা করে তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি। শেষমেশ সুযোগ আপনিই তার হাতে এসে ধরা দিয়েছে। তাকে কিছু করতে হয়নি শুধু অপেক্ষার প্রহরগুলো ধৈর্য নিয়ে গণনা করা ছাড়া।
বৈশাখের এক খরতপ্ত বায়ুর প্রবাহহীন কাকডাকা ভোরে আলী সাহেব মৃত্যুবরণ করলেন।
ব্ল্যাডের মতো ধারাল সূর্যের রশ্মিকে উপেক্ষা করে মেঘশূন্য আকাশের দিকে চেয়ে বৃষ্টিপাতের জন্য অস্থির হয়ে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন নিয়ে আমীন জানাজা পড়ে তার পিতাকে খিলগাঁ গোরস্থানে কবরস্থ করল। মেজো ও ছোট বোন কেঁদেকেটে সন্ধ্যার দিকে যার যার বাসায় ফিরে গেল। বড় আর মেজো ফোনে অনেক কান্নাকাটি করল। পিতা মাত্রই মৃত্যুবরন করেছেন। এরকম মুহূর্তে সম্পত্তির কথা তোলা যায় না। তাই বোনেরা কেউই বিষয়আশয়ের কথা মুখে আনল না। কিছুদিন যাক। তারপর দেখা যাবে।
রাতে খেয়ে-দেয়ে আমীন আর তার স্ত্রী লায়লা ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ল। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি আমেরিকায় ফুফুর কাছে থেকে ওখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। মেয়েটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। দাদার মৃত্যুর খবর শুনে সে চট্টগ্রাম থেকে বাসায় এসেছে। সে তার রুমে শুয়ে পড়েছে। বাসায় মানুষ বলতে এই তিনজনই। আলী সাহেবের রুমটি ফাঁকা। রাত বারোটা নাগাদ সবাই ঘুমিয়ে গেল। বাইরে চাঁদনি রাতের আবছা আলোকে ঢেকে দিয়ে ঘন কালো মেঘ কোত্থেকে যেন আসতে শুরু করল। দেখেতে দেখতে সারা আকাশ কৃষ্ণবর্ণ মেঘে ছেয়ে গেল। চাঁদ অন্তর্ধান করল কোথায় কেউ জানে না। গোটা শহরটা গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে গেল। রাস্তার বাতিগুলোর সাধ্য কী সেই আঁধারকে বিদূরিত করে। চারিদিকে একটা গুমোট থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগল। বাতাসেরা হয়ে রইল স্তব্ধ। রাত দুটো নাগাদ শোঁ শোঁ শব্দে প্রচণ্ড বেগে ছাড়ল বাতাস । সেই সাথে সারা শহরকে আলোকিত করে কড়কড় শব্দে মুহুর্মুহু বজ্রপাত হতে থাকল। প্রথমে হালকা তারপর হতে লাগল ভারী বৃষ্টিপাত। ঝড়ের লেজের বাড়ি খেয়ে কাছেই কোনো বাড়ির জানালার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল।
এমন সময় কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমীনের। লায়লার দিকে তাকিয়ে দেখে সে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমীন কান খাড়া করে রাখল সত্যিসত্যি কলিং বেল বাজছে কিনা তা পরখ করে দেখার জন্য। আবার কলিং বেল বেজে উঠল। দুবার। বাবা বাইরে থেকে এলে যেভাবে কলিং বেল বাজাত ঠিক সেভাবে দুবার বেলটি বেজে উঠল। তাদের বাড়ির কোনো দারোয়ান নেই। লায়লা পানির মোটর ছাড়ে আর সে রাতে বাড়ির মূল দরজায় তালা দেয়। সে ভাবতে লাগল তার স্ত্রীকে ডেকে তুলবে কিনা। তারপর ভাবল, নাহ, তার ঘুম ভাঙানোর দরকার নেই। কিন্তু ঝড়ের এই রাতে কে বেল বাজাতে পারে? কোনো ভাড়াটিয়ার হয়তো কোনো বিপদ হয়েছে। সে বিছানা থেকে উঠে ডাইনিং রুমের বাতি জ্বেলে দরজার লুকিং গ্লাসে চোখ রাখল। সে সিঁড়ির আলোয় শোঁ শোঁ শব্দের মধ্যে একটা মানুষের অবয়বকে দেখতে পেল। সে সিটকানি নিচে নামিয়ে দরজা খুলে দেখে সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কেবল ঝড়ো বাতাস ছাড়া সেখানে আর কোনো মানুষের উপস্থিতি নেই। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস তাকে ধাক্কা দিল। সে অনুভব করল তার গা ঘেঁষে কিছু একটা বায়বীয় যেন ঘরে ঢুকে পড়ল। ভয় তাকে ঘিরে ধরল। সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে সন্তর্পণে স্ত্রীর ঘুম যেন না ভাঙে এমনভাবে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর সে কখন ঘুমিয়ে গেল তা নিজেই টের পেল না।
আলী সাহেবের মৃত্যুর চারদিন পর বাড়িতে মিলাদ দেয়া হলো। মিলাদ শেষে হুজুরকে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন বাড়িটাকে বেঁধে দিয়ে যান যাতে করে জিন-ভূত বা অশরীরী কোনো কিছু যেন আমীনদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। সকলে মিষ্টান্ন নিয়ে চলে যাবার পর হুজুর আরো অতিরিক্ত দোয়াদরুদ পড়লেন এবং এক বোতল পানি এনে দিতে বললেন। আরো কিছু দোয়া পড়ে তিনি বোতলের পানিতে কয়েকবার ফুঁ দিলেন। তারপর বললেন এই পানি যেন সমস্ত বাড়িতে ছিটিয়ে দেয়া হয়। আমীন হুজুরের কথা মতো সযত্নে সেই বোতলের পানি তাদের সমস্ত ঘরে, সিঁড়িতে এবং ছাদে ছিটিয়ে দিল। পড়া পানি ছিটিয়ে দেয়াতে আমীনের বুক থেকে একটা ভারী কোনো কিছু যা এই কয়দিন তাকে চিন্তাচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা আলগোছে সরে গেল এবং নিজেকে মনে হলো যথেষ্ট হালকা। মিলাদ শেষ হওয়ার পর ক্লাসের ক্ষতির কথা বলে মেয়ে রাতের ট্রেনে প্রথম শ্রেণিতে চেপে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। রাত বারোটা বেজে গেলে লায়লা বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমীনও নির্ভার মনে এবং নিঃশঙ্ক চিত্তে স্ত্রীর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত যখন গভীর হলো তখন আমীনের ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল। সে শুনতে পেল বাথরুমের কল থেকে পানি পড়ার শব্দ। এটা সেই বাথরুমটা যেটা বাবা ব্যবহার করতেন। সে কান খাড়া করে গভীর অভিনিবেশ সহকারে পানি পড়ার শব্দটা শোনার চেষ্টা করল। তার কাছে মনে হলো কেউ যেন কল ছেড়ে অজু করছে। সে বিছানা ছেড়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখে বাবার বাথরুমে আলো জ্বলছে এবং সেখান থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে।
সে হেঁটে বাবার বাথরুমের কাছে গেল। বাথরুমের দরজা খোলাই ছিল। সে দরজাতে আস্তে ধাক্কা দিল। দরজা খুলে গেল। দরজা খোলার পর সে দেখল তার বাবা অজু করছে। তিনি সুস্থ থাকা অবস্থায় দেখতে যেরকম ছিলেন এখন তাকে দেখতে ঠিক সেরকমটিই লাগছে। আলী সাহেব খোলা দরজা দিয়ে ক্রুদ্ধভাবে তার ছেলের দিকে তাকালেন। তার চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে। বাবার দিকে তাকিয়ে আমীনের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হলো। তীব্র ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে পিঠের নিচের দিকে নামতে লাগল। সে বলল : বাবা! এমন সময় সে তার পিঠে একটি হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল। সে পিছন ফিরে দেখে লায়লা তার পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। লায়লা জিজ্ঞেস করল : তোমার কী হয়েছে? সে কম্পিত গলায় বলল : কিছু না। মনে হলো যেন এই কলটি দিয়ে পানি পড়ছে। লায়লা বলল : কই কল দিয়ে তো পানি পড়ছে না। চল, ঘুমাতে চল। লায়লা তখন তাকে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল। সে রাতে আমীনের আর ঘুম এল না।

কয়েকদিন পর এক ফকফকে জ্যোৎস্নার আলোয় তাদের নির্জন পাড়াটি যখন ধবধবে সাদা দেখাচ্ছিল আর থেমে থেমে কয়েকটি কুকুর করে উঠছিল আর্তনাদ আমীন তার স্ত্রীর সাথে শোবার ঘরে গভীর নিদ্রায় অচেতন ছিল। আকাশে ছাইরঙা মেঘেরা প্রেতিনীর মতো এদিক-ওদিক ওড়াউড়ি করছিল। গলির মোড়ে যে বটগাছটা আছে তার শাখায় বসে একটা প্যাঁচা মন্দ্র ধ্বনি তুলে তার স্বরে ডেকে যাচ্ছিল। আনন্দে আত্মহারা বাদুড়ের দল বাতাসে ভর করে ভেসে বেড়াচ্ছিল চাঁদের মায়াময় রহস্যের জাল ছিন্ন করবে বলে। পাড়ার পার্শ্ববর্তী সরকারি স্কুলের আম বাগানে কোনো শীতল সরীসৃপের সূচালো মুখের অন্ধকার গহ্বরে আটকে যাওয়া অসহায় পাখির করুন চিৎকার ভেসে আসছিল। রাত তখন অনেক গভীর। হঠাৎ কী যেন একটা শব্দে আমীনের ঘুম ভেঙে গেল। সে সতর্ক হয়ে শব্দটা শোনার চেষ্টা করল এবং শব্দের উৎপত্তিস্থল নির্ণয়ের জন্য কানকে সজাগ করল। সে ভালোভাবে খেয়াল করে শুনল। এটা জিকিরের আওয়াজের মতো। তার বাবাও ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ জিকির করতেন। সে বিছানা ছেড়ে উঠল। হ্যাঁ বাবার রুম থেকেই জিকিরের আওয়াজ আসছে। সে সন্তর্পণে বাবার রুমের দিকে গেল। দেখে বাবার রুমে বাতি জ্বলছে আর সেখান থেকেই একটানা আওয়াজটা আসছে।
বাবার রুমের দরজা খোলাই ছিল। সে আস্তে করে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। সাথে সাথে জিকির বন্ধ হয়ে গেল। সে দেখে তার বাবা জিকির বন্ধ করে তার দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সেই দৃষ্টি থেকে অনল বর্ষিত হচ্ছে। তীব্র ঘৃণা মিশ্রিত চাহনির সুতীব্র উত্তাপে যেন তাকে ভস্মীভূত করে ফেলবে তার বাবা। বাবার দিকে চেয়ে আমীনের মনে সুগভীর ভীতির সঞ্চার হলো। এই ভয় গহিন অরণ্যের আঁধারের চেয়েও কালো। আর পিশাচের চেয়েও হিংস্রতর। সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার গায়ের সমস্ত লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট বোধ হচ্ছিল। সে ঘামতে লাগল। সে কতক্ষণ এভাবে ছিল সে জানে না। তার সম্বিত ফিরল লায়লার ডাকে। লায়লা বলছে : এত রাতে ওখানে কী করছ? স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে বলে উঠল : তুমি তো ঘেমে একশেষ হয়ে গেছ। সে লায়লার কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। সে স্ত্রীর কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বিছানায় শুয়ে তার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লেও সে কিছুতেই ঘুমাতে পারল না।
জ্যৈষ্ঠের এক ঘামে সিক্ত দুপুরে আমীন তার শাড়ির দোকানে বসে বসে ভাবছিল যে আর কয়েকদিন পর-ই তো বাবার চল্লিশা। সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে চল্লিশায় তিনটি বড় গরু জবাই করে ফকির মিসকিনকে খাওয়াবে। ক্রেতা তেমন একটা ছিল না। হঠাৎ এক বৃদ্ধ ক্রেতা দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করল জামদানি শাড়ি আছে কিনা। দোকানের কর্মচারীটি তৎপর হলো। সে বলল, হ্যাঁ, জামদানি হবে। আপনি বসুন। একথা বলে সে চার-পাঁচটি শাড়ি বের করে বৃদ্ধের সামনে একে একে মেলে ধরল। বৃদ্ধটি তখন বলল, একটু পুরাতন ডিজাইন হলে ভালো হয়। কর্মচারীটি তখন পুরাতন ডিজাইনের কয়েকটি শাড়ি বের করে এনে বৃদ্ধের সামনে রাখল। আমীন ক্যাশবাক্সের সামনে বসে ছিল। সে বৃদ্ধকে পর্যবেক্ষণ করছিল। আয়নাতেও বৃদ্ধ লোকটির প্রতিফলন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। বৃদ্ধ লোকটি একটি লাল রঙের শাড়ি পছন্দ করল।

হঠাৎ আমীনের মনে পড়ে গেল ঠিক এরকম একটি শাড়ি অনেক বছর আগে বাবা তার মায়ের জন্য কিনে এনেছিল। মা তখন জীবিত ছিল। বাবার বয়সও তখন কম ছিল। বৃদ্ধ লোকটি যখন কর্মচারীটির সাথে কথা বলছিল তখন আমীন একবার বৃদ্ধের দিকে আরেকবার আয়নায় তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকাচ্ছিল। অকস্মাৎ তার দৃষ্টি বৃদ্ধের প্রতিবিম্বের উপর স্থির হয়ে গেল। সে দেখল প্রতিবিম্বটি অনেকটা তার বাবার মতোই। সে বিস্ফারিত চোখে খেয়াল করল যে প্রতিবিম্বটি বাবার মতো শুধু নয় এটা তো স্বয়ং বাবাই। সে প্রতিবিম্ব থেকে চোখ সরিয়ে বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি দিল। হ্যাঁ, বৃদ্ধ ক্রেতাই তো ওখানে বসে বসে কর্মচারীটির সাথে কথা বলছেন । সে আবার প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল। আয়নার ভেতরে বাবা বসে বসে কর্মচারীটির সাথে কথা বলছেন। তারপর সে দেখতে পেল তার চতুর্দিকের দৃশ্যাবলি বৃত্তাকারে তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। সে চোখে অন্ধকার দেখল। এরপর আর কিছু তার মনে নেই। ডাক্তার ডেকে আনা হলে তিনি আমীনের রক্তচাপ মেপে দেখলেন যে, উপরেরটা ১৯০ আর নিচেরটা ১২০। তিনি ইনজেকশন দিয়ে কিছু ওষুধপত্র লিখলেন। আমীনের জ্ঞান ফিরে এলে তিনি তাকে কয়েকদিন বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়ে চলে গেলেন।
আমীন বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছে আজ দুদিন হলো। শেষ বিকেলের রোদেও উত্তাপের কমতি নেই। আকাশে মেঘেদের আনাগোনা থাকলেও বৃষ্টি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিকেলের চা-নাস্তা খেয়ে সে বসার ঘরে বসে টিভি দেখবে কিনা ভাবছিল। রাতে ভালো ঘুম না হওয়াতে সে ঝিমাতে লাগল। সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার চোখের সামনে একটা দৃশ্যপট ভেসে উঠল। সে এক গ্লাস দুধের মধ্যে আট নয়টি ঘুমের বড়ি ছেড়ে দিয়ে চামচ দিয়ে নাড়ছিল সবার অলক্ষ্যে। তারপর সে দুধের গ্লাসটি নিয়ে বাবার রুমে গেল। বাবার তখন ঘুমাবার সময়। বাবাকে সে দুধ খাওয়াল। কিন্তু গ্লাসের সব দুধ খাওয়াতে পারল না। আধা গ্লাস দুধ নিয়ে সে রান্না ঘরে গিয়ে সবটুকু দুধ সিঙে ফেলে দিল। কেউ দেখল না।
বাবার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই একদিন ভোরবেলা আমীনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল তার বাবার রুমে। ডাক্তাররা বললেন হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কেউ লক্ষ করল না যে তার গলায় দুটো আঙুলের ছাপ ছিল।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending