গল্প
চুরি
Published
1 month agoon
শীতল গলায় আরিয়ানা বলল, তুমি কি মনে করো শখ করে জোশির ঘর ছেড়ে চলে এসেছি আমি?
শখ না, ফ্যাশন। স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসা এখন নতুন ফ্যাশন। তুইও সেই অসহনশীল ফ্যাশনের বলি হয়েছিস। টের পাচ্ছিস না। বলল বড় বোন হৃদিতা।
তোমার ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, আপু। মুখ সামলে কথা বলো।
সত্য কথা বললাম। সত্য এড়িয়ে যাওয়া যায় না। মিথ্যাকেও সত্য বানানো যায় না। এক সপ্তাহ আগে তোদের আরেক বান্ধবী হিরাও চলে এসেছে স্বামীর ঘর ছেড়ে।
রুক্ষ স্বরে আরিয়ানা আবার বলল, হিরার বিষয় ভিন্ন। তার অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছিল না শাশুড়ির সঙ্গে। এজন্য চলে এসেছে।
মানিয়ে নিতে হয়। সহনশীল হতে হয়। ধৈর্য ধরতে হয়। ধৈর্যের ধ-ও তোদের মধ্যে নেই। তাই অ্যাডজাস্টমেন্টের দোহাই দিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চট করে চলে আসতে পারছিস তোরা। অসহনশীলতার কারণে এভাবেই ডিভোর্সের হার বেড়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে।
তুমি কি মনে করো মেয়েরা অন্ধকার যুগের মতো মুখ বুজে সহ্য করবে সব? ডিভোর্সের জন্য মেয়েদেরই কি দুষবে? মেয়ে হয়ে মেয়েদের দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা আমলে নেবে না? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে নিজের ঘরের চাবি বের করল আরিয়ানা। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় বাবার বাড়িতে নিজের ঘর তালা দিয়ে রেখে গিয়েছিল। বলে রেখেছিল, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে কেউ যেন তার ঘর না খোলে।
খোলার সাহস পায়নি কেউ।
আনিসা খানমÑওদের মা, সামনে এগিয়ে এসে বললেন, হৃদিতা! থামো তুমি। নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়ে চলে এসেছে আরিয়ানা। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছ কেন? আগে শোনো কী হয়েছে। কী ঘটেছে, না জেনে আরিয়ানাকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়।
সামনে থেকে সরে গেল হৃদিতা। যেতে যেতে বলল, তোমার লাই পেয়েই আরিয়ানার মধ্যে ধৈর্যশক্তি তৈরি হয়নি, আম্মু। ছোটখাটো ইস্যুতে রাগ না করে, না চলে এসে লড়াই করার শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল তোমার মেয়েকে। দাওনি। তুমিও দায়ী তার এ অবস্থার জন্য।
বড় বোনের কথার তীর বিঁধে গেল আরিয়ানার বুকে। আনিসা খানমও আহত হলেন। কিছু বললেন না মুখে। দরজার লক খুলে ব্যাগসহ ভেতরে ঢুকে আরিয়ানা দেখল তার ঘর ফিটফাট রয়েছে। যেভাবে গুছিয়ে রেখে গিয়েছিল, গোছানো আছে সেভাবেই। কেউ ঝাড় দেয়নি। হাত লাগায়নি কোথাও। বড় বোন হৃদিতার কথার ঝাঁজ উড়ে গেল মাথা থেকে। শান্ত গলায় মাকে বলল, আমার ঘর ঝাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করো। নতুন বেড কভার, পিলো কভার লাগিয়ে দাও। কোলবালিশের কভারও বদলে দাও। বলতে বলতে জানালার স্লাইডিং গ্লাস টেনে দিল সে। ভারী পর্দা টেনে সরিয়ে দিয়ে দেখল ঝরঝরে আছে পর্দা। ধুলোবালি জমেনি। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে দেখল চারপাশ। আনন্দে ভরে উঠল মন। মনে হচ্ছে, এ ঘরই তার আসল ঠিকানা। এ ঘরই তার পৃথিবী। এতদিন জঞ্জালের মতো কাটিয়েছে অন্য বাড়িতে। স্বস্তি নিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করল। ঘুরতে শুরু করা ফ্যানের বাতাসে ঘরের গুমোট ভাব কেটে গেল অল্প সময়ের মধ্যে।
আরিয়ানার পরনে হানিকম্ব করা স্লিভলেস লং ড্রেস। ড্রেসজুড়ে রয়েছে ঠাসা সিক্যুইনের কাজ। অর্থাৎ সেজেগুঁজে হয়তো কোনো পার্টিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। ওই মুহূর্তে ঝগড়া বেধেছিল জোশির সঙ্গে। যেভাবে ছিল, সেভাবেই চলে এসেছে এ বাড়িতে। বুঝতে পারলেন মা আনিসা খানম।
তার ঘর পরিষ্কার করে গেছে বুয়া। নতুন রূপে সেজেছে কক্ষটি। এসি ছেড়ে দরজা লক করার জন্য এগিয়ে এসে আরিয়ানা বলল, তুমি এখন যাও, আম্মু। কিছু সময় আমাকে একা কাটাতে দাও আমার ঘরে।
আনিসা খানম বললেন, আমিও থাকি তোমার পাশে। বলতে বলতে নিজের হাতে দরজা লক করে দিলেন। তারপর খাটের ওপর মেয়ের পাশে বসলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন, কী হয়েছে মা, বলবে আমাকে?
মায়ের নরম স্বর শুনে গলে গেল আরিয়ানার মন। মায়ের মমতার মতো কি আর কোনো মমতা আছে এ জগতে? চোখে পানি চলে এলো। টলমল করে উঠল বড় বড় কাজলটানা চোখ। নিজেকে সামলে মায়ের উদ্দেশে বলতে লাগল, আমাকে চড় মেরেছে জোশি। দেখো, ভালো করে দেখো, এখনো বোধহয় পাঁচ আঙুলের দাগ বসে আছে গালে।
আনিসা খানম মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। সত্যি সত্যি গালে এখনো বসে আছে পাঁচ আঙুলের চিহ্ন।
আঙুলের ছাপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি। আর কোনো প্রশ্ন করার আগ্রহ বোধ করলেন না। বিয়ের দুমাসের মাথায় যে ছেলে স্ত্রীর গালে চড় মারতে পারে, তার ঘর থেকে চলে আসাই শ্রেয়। যে ঘরে মেয়ে অনিরাপদ, কীভাবে সে সংসার করবে সেই ঘরে? বর্তমান ও ভবিষ্যতের শঙ্কাবোধ উদ্বিগ্ন করে তুলল তাঁকে। আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে চুপ করে মেয়ের পাশে বসে রইলেন তিনি।
আরও সহজ হয়ে আরিয়ানা বলল, চড় খাওয়ার কারণ হচ্ছে এ ড্রেসটা। পরনের ড্রেস এখনো খোলেনি। মাকে দেখিয়ে বলল, স্লিভলেস ড্রেস পরে আমি নাকি পার্টির অন্য পুরুষদের চোখে নেশা ধরিয়ে দিতে চেয়েছি! আমার খোলা দুই বাহু নাকি পুরুষদের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেবে। এমন কটু কথা বলেছে সে আমাকে। আমিও জেদ করে বলেছি, নিশ্চয়ই অন্য নারীর বাহু তোমার মাথায় আগুন ধরায়। তাই আমার ড্রেস নিয়ে অশ্লীল কথা বলছ। সঙ্গে সঙ্গে চড় মেরেছে আমাকে।
মেয়ের কথার পর আনিসা খানমের চোখ গেল স্লিভলেস ড্রেসের দিকে। গলা থেকে বাহু পর্যন্ত পুরো উদোম। কাঁধের ওপর দিয়ে পিঠের দিকে নেমে গেছে একটি সরু ফিতা। গলা, কাঁধ, বাহু পুরো খোলা। ফরসা বাহুর উজ্জ্বল লাবণ্য মায়ের চোখও ঝলসে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন জোশি কেন এমন কমেন্ট করেছে। বুঝতে পারলেও জোশির পক্ষে দাঁড়াতে পারলেন না তিনি। মেয়ে যা-ই বলুক, তার দৃষ্টিতেই বলেছে, নিজের চোখে নিজে সুন্দর সে। নিজের মনে কোনো কালিমা নেই। অন্যের চোখে নেশা জাগিয়ে তোলার ইচ্ছা ছিল না তার। সুন্দর ড্রেসের দিকে আকর্ষণ সব তরুণী বধূরই থাকতে পারে। মেয়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথার যুদ্ধ চলতে পারত। তাই বলে কি চড় দিতে হবে মেয়েকে! স্বামীর কি চড় দেওয়ার অধিকার আছে তার বউকে? নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকালেন। আরিয়ানার বাবার সঙ্গে অনেক বিষয়ে মতভেদ হয়েছে, রাগারাগি হয়েছে, মান-অভিমান হয়েছে। কখনো স্বামী তাঁর গায়ে হাত তোলেননি। বউয়ের গায়ে হাত তোলার মতো বর্বরতা দ্বিতীয়টা হয় না। যে স্বামী বউয়ের গায়ে হাত তোলে, বর্বর স্বামী সে। এমন স্বামীর কাছে মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। অনিরাপত্তাবোধ ও মানসিক পীড়ন নারী নির্যাতন-নিপীড়নের বড় একটা বিষয়। এ বর্বর পরিপ্রেক্ষিতের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে মেয়ে, ভালো করেছে। হৃদিতা ভুল করেছে। ঘটনা না বুঝে আরিয়ানাকে কটু কথা বলেছে। হৃদিতার এ কটু কথাও পীড়িত করেছে আরিয়ানাকে। মেয়ের পক্ষ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আনিসা খানম। কিচেনে ঢুকে দেখলেন হৃদিতা দুধ গরম করছে।
আনিসা খানম থমথমে গলায় বললেন, জোশি চড় মেরেছে আরিয়ানাকে। শারীরিক নির্যাতনের কারণে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে এসেছে সে। এ সময় তার পক্ষে থাকা উচিত আমাদের। তাকে কটু কথা বলা উচিত নয়।
চড় মারার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল হৃদিতা। স্বামী তার বউয়ের গায়ে হাত তুলতে পারে! বিস্ময় লাগল ওর। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে হৃদিতা বলল, নিশ্চয়ই বড় কোনো অন্যায় করেছে আরিয়ানা। নইলে জোশির মতো ছেলে তার গালে চড় মারতেই পারে না।
পাঁচ আঙুলের দাগ বসে আছে আরিয়ানার গালে! আর তুমি বলছ চড় মারতেই পারে না?
না আম্মু। সেটা না। আসল কথা হচ্ছে, চড় মেরে অন্যায় করেছে জোশি। কিন্তু চড় মারার আগে নিশ্চয়ই ভয়াবহ কোনো অন্যায় করে থাকতে পারে আরিয়ানাও! সে কথা বলছি আমি। সেটাও নিরপেক্ষভাবে ভাবতে হবে তোমাকে।
অন্যায় করলেও চড় খাওয়ার মতো কোনো দোষ করেনি। তার মনের শখ পূরণ করবে না জোশি? সে প্রায় ছয় বছরের বড় আরিয়ানার থেকে। কেন চড় মারবে?
আম্মু! মায়ের মন দিয়ে বিচার করছ তুমি। মায়ের আবেগ ছেড়ে দিয়ে বিচার করো বিষয়টা। নইলে জটিলতা আরও বাড়বে।
তুমি কি আরিয়ানার পক্ষে দাঁড়াচ্ছ না, হৃদিতা?
অবশ্যই পক্ষে দাঁড়াব। তবে তাকে লাই দেব না। তোমাকেও বলব প্রশ্রয় দিয়ো না তাকে।
প্রশ্রয়ের কথা আসছে কেন? মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পক্ষে দাঁড়ানো কি প্রশ্রয় দেওয়া?
দেখো আম্মু, বোঝাতে পারছি না তোমাকে। আরিয়ানাদের বয়সী মেয়েরা কথায় কথায় শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসে। নির্যাতনের শিকার হলে অবশ্যই চলে আসবে। তবে সমস্যা জয় করার চেষ্টাও করতে হবে। পালিয়ে আসা পরাজয় মা। সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকাই হচ্ছে জয়ী হওয়া। আমি চাইব না, আমাদের আদরের আরিয়ানা পরাজিত হোক।
তার চলে আসাকে পরাজয় ভাবছ কেন? নির্যাতন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার অধিকার কি নেই ওর?
আছে আম্মু। ধৈর্য ধরো। অধিকার আছে নিশ্চয়ই। তবে মনে রাখতে হবে, তার পক্ষে দাঁড়ালে নিজেদের অজান্তে তাকে ডিভোর্সের দিকে ঠেলে দেব আমরা। ডিভোর্সি মেয়েরা পরবর্তী জীবনে আমাদের কালচারে আর সুখী হয় না, আরও ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়। শি উইল বি ট্রিটেড অ্যাজ অ্যা ডিভোর্সি উইমেন ফর হার হোল লাইফ। কথাটা এ মুহূর্তে আবেগের বশে ভুলে গেলে চলবে না। ভবিষ্যতের চিন্তা করতে হবে। খণ্ডকালীন টুকরো ঘটনার রেশ ধরে পুরো জীবন মাপা যায় না। মাপতে গেলে ঠকতে হবে। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় কি অভিজ্ঞতা হয়নি তোমার?
আনিসা খানমের বুকে শেল বিঁধে গেল। এভাবে চিন্তা করেননি তিনি। রাজনৈতিক কারণে খুন হয়েছে হৃদিতার স্বামী। বিয়ের দুই বছরের মাথায় বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে উঠেছে হৃদিতা। তখন সে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
হৃদিতার সন্তানের বয়স এখন পাঁচ বছর। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করছে হৃদিতা। এ প্রজন্মের টিনএজ ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওঠাবসা তার। নানা অভিজ্ঞতার আলোয় গড়ে উঠেছে দৃষ্টিভঙ্গি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে কমেন্ট করছে সে, বুঝতে পারলেন আনিসা খানম। হৃদিতার জন্যও তাঁর বুকে হাহাকার করে। অসাধারণ রূপবতী হৃদিতার চালচলনে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। একমাত্র সন্তান টুম্পাকে ঘিরে কাটছে তার জীবন। অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব আসছে। সব ফিরিয়ে দিচ্ছে হৃদিতা। টুম্পার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে চায় সে। ওই উৎসর্গের আড়ালে চলছে তার আত্মদহন। বয়সের দাবি উপেক্ষা করা কঠিন। কঠিন যন্ত্রণা বুকে পুষে দিন পার করছে সে। মায়ের স্তব্ধতার আড়ালের দীর্ঘশ্বাস এড়াল না হৃদিতার চোখ। বোঝে, তাকে ঘিরেই শেষ নেই মায়ের যাতনার। এখন আবার চেপে বসতে চলেছে আরিয়ানার বোঝা। কত সামলাবেন মা? কত সইতে পারবেন? শুনেছে দীর্ঘ মানসিক যাতনা কেবল মনের শান্তিই হরণ করে না, নানা ধরনের দৈহিক রোগেও আক্রান্ত করে মানুষকে। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মতো ভয়াল রোগ অপেক্ষা করে এ ধরনের মানুষের জন্য। মরার আগেই মরে যেতে বাধ্য হন তারা। মাকে কষ্ট দেওয়া হৃদিতার উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবতাটা মাকে ধরিয়ে দেওয়া।
গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে সে বলল, আম্মু! আমি বিধবা। স্বামী ছাড়া চলতে এ সমাজে যে কী কষ্ট, তোমাকে বোঝাতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে চাই, স্বামী ছাড়া এ বয়সী মেয়েরা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। পুরুষ মানুষগুলো কুকুরের মতো লেগে থাকে পেছনে। কাছের আত্মীয়রা এ দলে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। অচেনা, বাইরের মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম। অনিরাপত্তাবোধ স্বামীর ঘরে থাকলেও জয় করা চাই-ই। বিষয়টাতে ছাড় দিতে চাই না, আমি জোর দিতে চাই। তুমিও মাথায় রাখবে কথাটা। বলতে বলতে গ্লাসে দুধ ঢেলে কিচেন থেকে টুম্পার উদ্দেশ্যে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিল সে।
দুই.
লাঞ্চের জন্য সুন্দর করে ডাইনিং টেবিল সাজিয়েছেন আনিসা খানম। স্বামীর জন্য তৈরি করেছেন সবজি-পরোটা, কাঁচকলার দইবড়া, ঝলসানো মুরগি, আরিয়ানার পছন্দের হাঁড়িয়া কাবাব। আর কলিজা-ডালের মাখানি হচ্ছে হৃদিতা ও টুম্পার প্রিয় খাবার। হাঁড়িয়া কাবাব জোশিরও প্রিয়। টেবিল সাজাতে গিয়ে মনে পড়ে গেল জোশির কথা। এ সময় জোশি থাকলে ভালো হতো। ছুটির দিনটা ভালোই কাটত তাদের পরিবারের। দীর্ঘশ্বাস বেরোল। জোশির আসার কোনো সুযোগ নেই। আসতে চেয়েছিল জোশি। ফোন করেছিল। কড়া ভাষায় না করে দিয়েছে আরিয়ানা।
সবাইকে ডেকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়েছেন আনিসা খানম। নিজেও বসেছেন। এ সময় বেজে উঠল ইন্টারকম। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হৃদিতা।
ইন্টারকমের রিসিভার তুলে বুঝতে পারল নিচে থেকে ফোন করেছে গার্ড।
হৃদিতা প্রশ্ন করল, কী ব্যাপার?
ছোট জামাইবাবু এসেছেন। ওপরে আসবেন কি না জানতে চাচ্ছেন।
চট করে মাথা ধরে গেল হৃদিতার। ছোট জামাইবাবু, মানে জোশি? ছেলেটার কোনো আক্কেল আছে? ওপরে আসবে কি না দারোয়ানদের মাধ্যমে জানতে চাইছে! জামাই আসবে শ্বশুরবাড়িতে, অনুমতির প্রয়োজন কী? কেন গার্ডদের মাধ্যমে জানতে চাইবে?
মান-অপমানের কি কোনো বালাই নেই ছেলেটার! নানা চিন্তা আক্রমণ করল হৃদিতাকে। মন বিক্ষিপ্ত হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে গম্ভীর গলায় বলল, আসতে বলো।
রিসিভার রেখে ডাইনিং টেবিলে ফিরে এসে বসল হৃদিতা।
আরিফুল হক, ওদের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে আসতে বললে?
উত্তর না দিয়ে চুপ থাকে হৃদিতা। বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চুপ থাকা বেয়াদবি ভেবে আনিসা খানম বললেন, তোমার বাবার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন? কাকে আসতে বললে?
গম্ভীর হয়ে হৃদিতা জবাব দিল, জোশি এসেছে। ওপরে আসবে কি না জানতে চেয়েছে। আসতে বললাম তাকে।
চট করে লাফিয়ে উঠল আরিয়ানা। হৃদিতার উদ্দেশে ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, আমি কি কিছু বুঝি না! আমাকে তাড়াতে পারলেই তোমার লাভ বেশি, জানি না মনে করেছ! বাবার ফ্ল্যাট পুরোটা দখলে নিতে চাও তুমি, বুঝি না আমি! বলেই গটগট করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। ভেতর থেকে দরজা লক করে খাটে গিয়ে শুয়ে হাঁপাতে লাগল।
খালামণির হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা, হঠাৎ ক্ষুব্ধ চিৎকার শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেল টুম্পা। দ্রুত মায়ের বুকের সঙ্গে সেঁটে গেল। আদরের ছোট বোনের প্রতিক্রিয়া দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল হৃদিতা। বাকরুদ্ধ হয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল টুম্পাকে। বৈষয়িক লোভ-লালসা তাড়িত করে না হৃদিতাকে। পোড় খাওয়া জীবনের নির্মমতা বুকে ঠুকে নিয়ে টুম্পাকে ঘিরে যার জগৎ ঘুরছে, এমন ধাক্কা তাকে কাবু করতে পারল না, শক্ত হয়ে বসে রইল চেয়ারে।
আরিফুল হক বললেন, মামণি কষ্ট নিয়ো না মনে। রাগের মাথায় এমন কথা বলেছে আরিয়ানা। এটা তার মনের কথা নয়। রাগের কথা মাথায় নিতে নেই। নিলে ঠকতে হবে জীবনে।
বাবার কথার জবাব দিল না হৃদিতা। শূন্য চোখে চেয়ে দেখল টুম্পাকে। এখনো ভীত হয়ে বুকের সঙ্গে সেঁটে আছে টুম্পা। বড়দের এ ধরনের আচরণ ঘরের শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে, ক্ষতি করে শিশুর মানসিক বিকাশও। হৃদিতা জানলেও বড়রা এসব বোঝে না!
চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন আনিসা খানম। দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন লিফটের ভেতর থেকে বেরোচ্ছে জোশি। শাশুড়িকে দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে মলিন মুখে সালাম জানাল।
জোশিকে দেখে নড়ে উঠল টুম্পা। মায়ের কোল থেকে ছুটে গেল জোশির কোলে। জোশি প্রাণ ঢেলে আদর করল টুম্পাকে। টুম্পা দারুণ ভক্ত হয়ে উঠেছে তার। শিশুরা মৌলিক আদর বুঝতে পারে। যারা মৌলিক আদর দেয়, তাদের সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে শিশুর। টুম্পার ভীতি কেটে গেছে দেখে খুশি হয়ে গেল হৃদিতা। আরিফুল হকও তৃপ্ত হয়ে জোশিকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসালেন।
আনিসা খানমের শঙ্কা কাটেনি। আরিয়ানার এমন ঔদ্ধত্য পছন্দ হয়নি তাঁর। এ অবস্থায় জোশির সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে পারে, ভেবে শঙ্কিত হয়েই থাকলেন। ডাইনিং টেবিলের শূন্য চেয়ারে বসে জোশি বুঝতে পারল এ চেয়ারেই বসেছিল আরিয়ানা; তার আসার সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে চেয়ার ছেড়ে গেছে। ক্ষুব্ধতার কারণে ভুল করে রেখে গেছে তার অতি প্রিয়ধন চাবির গোছাটি। চাবির খোপ দেখে চিনতে পারল সে। যক্ষের ধনের মতো চাবির তোড়াটা আঁকড়ে থাকে আরিয়ানা। চাবির প্রতি তার এই নিবিড় সখ্য নিয়ে মাঝে মাঝে সে পরিহাস করেছে। পরিহাসের আড়ালে কাজ করত ভয়ও। একবার রাগ করে বলেছিল, ‘চাবি নিয়ে কটু কথা বলবে না। বললে আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে নিজ ঘরে লক লাগাব আমি। আর ফিরব না তোমার বাসায়। মনে করো না, থাকার কোনো জায়গা থাকবে না আমার। বাবার বাসায় না থাকলেও আমার ঘরটা আমারই দখলে আছে সেখানে। এই চাবি হলো সেই দখলদারিত্বের বড় প্রমাণ।’
আরিয়ানার থ্রেট মনে পড়ে গেল জোশির। বুঝতে পারল, দরজা লক করে দিয়েছে সে ভেতর থেকে। বুঝতে পারল, তার রাগ এখনো পানি হয়নি। বুঝে অসহায়ের মতো বসে রইল চেয়ারে। মনের ভেতর রাগ জেগে উঠল শ্বশুরের ওপর। কেন তিনি একটা নির্দিষ্ট ঘর আলাদা করে লক করে রাখবেন মেয়ের জন্য! এ কারণেই শ্বশুরবাড়িতে মন বসাতে পারে না আরিয়ানা। টুকটাক কিছু হলেই বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। অবশ্য এবারের ঘটনা কেবল টুকটাক ইস্যু নয়। বড় অন্যায় করে ফেলেছে। যাকে এত ভালোবাসে, তাকে চড় মেরেছে। নিজেকে একটা দানব মনে হচ্ছে জোশির। এজন্য সে লজ্জিত, ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু ক্ষমা পাওয়া যাচ্ছে না। এ মুহূর্তে চাবিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে স্বস্তি পেল। মনে মনে ভাবল, তার ঘরের চাবিটা এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে। চাবি হারিয়ে পাগলপারা হয়ে যাবে সে। তখন বাগে আনা যাবে। ভাবতে গিয়ে কথার ফাঁকে চাবির তোড়া থেকে তার ঘরের চাবিটা আলাদা করে খুলে নিজ পকেটে চালান করে গোবেচারার মতো বসে রইল চেয়ারে। সামনে সাজানো খাবার দেখে লোভ হচ্ছে, বিশেষ করে হাঁড়িয়া কাবাবের লোভ সামলাতে পারছে না জোশি।
টুম্পা বলল, আঙ্কেল খাবে আমার সঙ্গে?
জোশি বলল, অবশ্যই খাব। তোমার খালামণি আসুক।
না, খালামণি ভালো না। তুমি আমার সঙ্গে খাও। টুম্পার আবদার দেখে মনে শান্তি এলো। অতি উদ্বেগ কমে গেল। তবে উদ্বেগ থেকে মুক্তি ঘটেনি এখনো।
আরিফুল হক বললেন, নানুভাই, আমরা সবাই একসঙ্গে খাব। খালুকে ছেড়ে দাও, খালামণিকে নিয়ে আসুক।
খালুকে ছাড়তে চাচ্ছিল না টুম্পা। হৃদিতা কোলে তুলে নিল টুম্পাকে। টুম্পার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে আরিয়ানার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল জোশি।
আনিসা খানম অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করেছেন। দরজা খুলছে না আরিয়ানা।
জোশি বলল, মা আপনি ডাইনিং রুমে গিয়ে বসেন। আমি চেষ্টা করছি।
আনিসা খানম চলে যাওয়ার পর টুঁ-শব্দ করল না জোশি। পকেট থেকে চাবিটা বের করে অতি সাবধানে লক খুলে ফেলল। খুট করে একটা শব্দ হয়েছিল। এই শব্দের অর্থ ধরতে পারেনি আরিয়ানা। ভেবেছিল মা এখনো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, নক করছেন।
অতি সাবধানে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল জোশি। চাবিটি আবার পকেটে চালান করে দিয়ে ভেতরে এগিয়ে দেখল জানালার দিকে মুখ রেখে খাটে শুয়ে আছে আরিয়ানা। মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে দুহাত সামনে তুলে ধরে ছোট্ট করে বলল, মাফ করে দাও আমাকে।
জোশির গলার স্বর শুনে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল আরিয়ানা। মাথা ঘুরিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল জোশিকে। এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে দেখে প্রথমে ভীত হয়ে পরক্ষণেই নার্ভাস হয়ে কেঁদে ফেলল।
হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে জোশি।
আরিয়ানার কান্না দেখে তার চোখেও নেমে এলো জল।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরিয়ানা বলল, আমাকে মারলে কেন তুমি?
জোশি উত্তর দিল, মাফ করে দাও।
আরিয়ানা আবার জিজ্ঞেস করল, কেন মারলে?
জোশি আবার বলল, মাফ করে দাও।
জবাব পেয়ে জোশির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল আরিয়ানা। বুকের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে রাখল জোশি।
অনেকক্ষণ কেঁদেকেটে আরিয়ানা প্রশ্ন করল, কীভাবে ঢুকলে লক করা ঘরে!
জোশি কোনো জবাব দিল না।
আরিয়ানা আবার জিজ্ঞেস করল, আমার ঘরের চাবি চুরি করেছ তুমি?
এবার জোশি জবাব দিল, হ্যাঁ।
এত বড় সাহস তোমার! আমার চাবি চুরি করতে পারলে?
তোমার চাবি চুরি করতে না পারলে তো তোমাকে চুরি করতে পারব না; কখনো পুরোপুরি দখল নিতে পারব না তোমার। তোমাকে পাওয়ার জন্যই চাবি চুরি করতে বাধ্য হয়েছি। বলেই হো হো করে হেসে উঠল জোশি।
আরিয়ানাও হাসতে লাগল তার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে। v