Connect with us

গল্প

পরী | দেবী শর্মা

Published

on

পরী | দেবী শর্মা

মফস্বলের শৈশব বড় সুন্দর, আমি বলছি ৫০-৬০ বছর আগের কথা। শহরের আয়তনটা মোটামুটি সবার ধারণার মধ্যে। এখানে বসন্ত প্রথম জানান দেয় বগুড়া রোড, নতুন বাজার আর হাসপাতাল রোডের ত্রিকোণে, সংযোগস্থলের কৃষ্ণচূড়ার হঠাৎ প্রস্ফুটনে কেমন যেন চলমান হয়ে ওঠে আবালবৃদ্ধবনিতা। আবার এসেছে বসন্ত।
বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসে লক্ষ করি সত্তরোর্ধ্ব শিক্ষক শান্তিবাবুর (আমরা ডাকি শেয়াল পণ্ডিত) শততালিযুক্ত ফ্যাকাসে ছাতিটা আজ ঘরের আড়ায় ঝুলছে। ওনারও দেহে-মনে পুলকের ছোঁয়া। তাই আমাদের টিপ্পনীতেও তেমন তেড়ে এলেন না। হলোটা কী?
দল বেঁধে বড় রাস্তায় গেলাম। না, সেই বড় কালো ষাঁড়টা মহাদর্পে রাস্তার মধ্য দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, সাইকেল-রিকশা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি এগুলো মফস্বলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঢং ঢং করে গার্লস স্কুলের ছুটির ঘণ্টা পড়ল, মেয়েরা হুড়হুড় করে দল বেঁধে বেরোচ্ছে। কিন্তু ‘ও বাবা কালো ষাঁড়টা দাঁড়িয়ে!’—ভয়ে আবার হুড়হুড় করে ঢুকে গেল মেয়েরা।
কখনো বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে সেজেগুঁজে বড় রাস্তা দিয়ে বান্ধবীর বাড়ি যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছি—উল্টোদিকে ল্যাম্পপোস্টের নিচে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনিসা পাগলি। যে কোনো শহর পাগল ছাড়া অম্পূর্ণ। বয়স, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে তারা কোনো এক লক্ষ্যে ঘুরে বেড়ায়। কেউ ঊর্ধ্বমূখে আঙুল তুলে, কেউ নিঃশব্দে ভূপৃষ্ঠের মাপ নিতে নিতে, আবার কেউ কেউ নারীর সৌন্দর্য সন্ধানে।
পাগলি আমাকে লক্ষ করছে। তার পরনেও বাসন্তী ফ্যাকাসে রঙের শাড়ি। পাড়ের কমলা রংটা জ্বলে গেছে, ব্লাউজের বালাই নেই। লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবতী বিশ-বাইশ বছরের মেয়ে। শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম তাকে ভিজিয়ে পুড়িয়ে প্রাকৃতিক করে তুলেছে। তাই ডগা ভাঙতে গেলে সে ফস করে ওঠে, সকলে তাই ভয়ও পায়, পাগলের যে কোনো শাস্তি হয় না।
দেখেশুনে বিয়ে হয়েছিল মেয়েটির। সুশ্রী হাসিখুশি মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতেও সবার প্রিয়পাত্র। রান্না-বান্নায়, অতিথি আপ্যায়নে তার তুলনা নেই। ব্যাংক কর্মচারী স্বামীকে সবাই ভাগ্যবানই মনে করে। বসন্তে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো এমন প্রেমিক শহরে বেশ আলোচনার বস্তু। ওরা কিন্তু নিজেদের মধ্যেই মগ্ন। বছর ঘুরে নতুন বসন্তে ঢাউস চাঁদটা নদীর জলে মায়াবী আলো ছড়ালে এবার ওর স্বর্গীয় হাসি মেলল না। কন্যাটি অন্তঃসত্ত্বা।
তিন-চার মাস পর হেমন্তের হিম হিম সন্ধ্যায় আবার তারা নদীর কাছে আসে—বিমর্ষ মেয়েটি, কোনো একটা অসুস্থতার কারণে মা হতে পারেনি। ভাঙাচোড়া দেহ নিয়েও স্বামীর কণ্ঠলগ্ন হয়ে আবার সেই অপার্থিব নদীর তীরে সৌন্দর্যে মিশে যায়।
কিন্তু আজকাল প্রায়ই কালো মেঘ ঢেকে দেয় নির্মল সুস্থ আকাশ। তখন ভীত মেয়েটির গায়ে কাঁটা দেয়। এবার তার গর্ভপাত হয় পূর্ণ মাসের বেশ আগেই এবং বছরে বছরে এর পুনরাবৃত্তি হতে থাকে।
স্বামীর দূরত্ব একসময় অবহেলার পর্যায়ে পৌঁছায়।
বছর তিন-চারের মধ্যে আত্মীয়স্বজনদের উদ্যোগে লাল শাড়ি পরা আরেক নতুন বউ ঘরে স্থায়ী হয়ে বসে। আর পেছনের আধা অন্ধকার ঘুপচি ঘরে সে স্থানান্তরিত হয় পুরোনো বাসনকোসনের সঙ্গে। কিন্তু দিনে দিনে তার ভেতরে ভয়ংকর এক ক্রোধ জন্ম নিতে থাকে, একসময় হাঁড়িপাতিল ভাঙতে থাকে সে। প্রতিবাদের একটাই ভাষা—গগনভেদী চিৎকার, শব্দ। এক কুয়াশাঢাকা ভোরে ক্যাঁচক্যাঁচে দরজাটা ফাঁক করে সে বেরিয়ে পড়ে মুক্ত পৃথিবীতে। ততদিনে তার নামের সঙ্গে পাগলি শব্দটা যুক্ত হয়েছে। এ শব্দটা আবালবৃদ্ধবনিতা অর্থাৎ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের তাকে উত্ত্যক্ত করার একটা বৈধ অধিকার বুঝি।
জন্মায় ধর্মের ষাঁড়। বর্ষায়, শীতে, গ্রীষ্মে কারও বাড়ির খোলা বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে পুরুষের অস্তিত্ব টের পায়। আজকাল আর বিশেষ কিছু যায় আসে না তার। প্রথম দিকে প্রচণ্ড শক্তিতে ছুড়ে ফেলে দিত, এখন সে ক্লান্ত।
এবারের বসন্তে হঠাৎ মনে হলো কী একটা ঘটছে তার শরীরে, বিবিমিষা, বিতৃষ্ণা, আবার ভিন্ন খাদ্যে লোভ। ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছা করে, নেয়ও সে। পানের দোকানদার তাকে দুটা লজেন্স, এক খিলি পানও দেয়। ততদিনে তার শরীরে মাতৃত্বের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। রাতের ছায়াগুলো এবার ভয় পেয়েছে।
আনিসা আজকাল স্বগর্বে ঘুরে বেড়ায়, সে তার মাতৃত্ব টের পেয়েছে, এখন তাকে বাঁচিয়ে রাখতে

হবে। তার যক্ষের ধন। এর অভাবেই সে পিতৃগৃহে, স্বামীগৃহে সর্বত্র বাঁজা নামের আনিসা পাগলি।
শহরে ঘুরতে ঘুরতে একসময় রেলিং দেওয়া হাসপাতালের ‘মা ও শিশু কেন্দ্রে’র নবজাতকের কান্নার চুম্বক শক্তি তাকে এনে বাইরের সিঁড়ির ওপর বসিয়ে দেয়। আকাশ ফাটিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে সে। সমস্ত শরীরে কলকল করে ঝরনার প্রস্রবণ।
‘আনিসা পাগলি তুই এখানে কেন? ও তরও তো সময় ঘনাইছে’—দাইয়ের অভিজ্ঞ মতামত। ‘ব্যথা উঠলে আইয়া পরিস’—গলায় সহানুভূতির সুর। আনিসা মা হবে।
আনিসা হাঁটতে হাঁটতে একদিন তলপেটে শরীর মোচড়ানো ব্যথা অনুভব করে। পাগলের প্রসব বেদনাও তো ধনীর দুলালির মতোই। কোনোমতে সে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছায়। দাই তাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের মর্যাদা দিয়ে ভেতরে নিয়ে শুইয়ে দেয়। সমস্ত শরীর ধুয়েমুছে মাতৃত্বের আবাহনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। আনিসা সব অনুভব করে। শিশুকাল ফিরে এসেছে বুঝি—‘মা এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমি তো এত অবহেলা সহ্য করতে পারিনি। নারীত্বের অপমান তো খোদ সৃষ্টির প্রতি কটাক্ষ। নারীর লাঞ্ছনা, পীড়ন—এসব ভাবনা আমাকে পাগল করে দিত। ক্রমে সুন্দরী মেয়ে দেখলে তেড়ে যেতাম। সুন্দর ফুল দেখলে পিষে দিতাম।’
‘কিন্তু এখন তো তুমি মা হতে যাচ্ছ—এই গর্ভযন্ত্রণা তো একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা। কোথাও কোনো ব্যত্যয় নেই। পৃথিবীর শুদ্ধ, সুন্দর পবিত্রতম নারী তুমি’—মা বলে।
দাই নারী কাটা ধনকে পাশে শুইয়ে দেয়। চক চক করে শব্দ করছে, তার অধিকার এখন মাতৃদুগ্ধ। কিন্তু পাগলের দুধ তো খাওয়ানো যাবে না—অন্য মায়েদের দুধ সংগ্রহ করে খাওয়ানো হলো। বোধহয় কারও সঙ্গে একটা বোঝাপড়াও হয়।
হঠাৎ আনিসা আবার সেই প্রচণ্ড ক্রোধ অনুভব করে এবং তার একমাত্র অভিব্যক্তি গগনবিদারী চিৎকারে চারপাশের সব যেন ভেঙে খানখান হয়ে পড়ে। কিন্তু ও যে আনিসা পাগলি—ওর স্থান হয় বাইরের সিঁড়িতে, তারপর হাসপাতালের চারদিকে, রাস্তায়।
শরীরটা যেন জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। বড় গলি এড়িয়ে ছোট গলি ঘুপচি তাকে একটু শান্তি দেয়, ছেলেরা ঢিল মারে না—এমন একটা গলির মাঝামাঝি ক্ষীণ জলস্রোতের পাশে বিশাল তেঁতুলগাছটা তার প্রিয়, শান্ত, শীতল। অন্ধকার ঘনালে মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। পাশের জমির কামলারা তাদের দড়ি-কাছি এখানেই ঝুলিয়ে রেখে যায়। আনিসা পাগলি তরতরিয়ে উঠে যায় গাছে। নৈঃশব্দ্যে কী সুন্দর! শরীর মনের জ্বালা কেমন শুষে নেয় তেঁতুলগাছের ঝিরঝিরে পাতা আর তার শক্ত ডালে সে পরীর মতো বসে পা ঝোলায়। তারপর একসময় সে আনিসা পাগলি হয়ে ঝুলে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending