Connect with us

গল্প

পাতানো ব্রহ্মপুত্র

Published

on

পাতানো ব্রহ্মপুত্র

সকালে ফোন দিয়ে বলল, ‘তোর সাথে জরুরি কথা আছে, আয়।’ অফিসে আসতে গিয়ে আমার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেছে, ঢাকার নানান কোনায় একসাথে কয়েকটা এক্সিডেন্ট ঘটে পুরো শহর থেমে আছে। শুধু আমার নয়, আজ মনে হয় পুরা শহরেরই মেজাজ খারাপ। এর মধ্যে হাসি হাসি গলায় আয় বলেই ফোন কেটেছে, আমি রাগে বিড়বিড়ালাম, ‘হারামজাদা আয় বলেই কাটছে ফোন, কই আসব সেইটা পর্যন্ত বলে নাই।’ দুপুর পর্যন্ত ভাবলাম, জাহান্নামে যাক, যাব না। দুপুরের পর থেকে মন নরম হতে শুরু করল। না জানি কী বলবে, হয়তো জরুরি কিছুই, হয়তো অসুখবিসুখ। আমরা চল্লিশ আর পঞ্চাশের মাঝখানে ঝুলে আছি, ঠুসঠাস করে বন্ধুদের দুই একজন মরেও যাচ্ছে। এ পর্যন্ত চিন্তা করেই সব রাগ উড়ে গেল, বিকেল হওয়ার আগেই ফোন দিয়ে বললাম, ‘কই আসব?’ সিরাজ বলল, ‘তোর অফিসের নিচে!’ আমি হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। নেমেই দেখলাম, ঝলমল করছে আমাদের বন্ধু সিরাজ। সারা জীবন আউলাঝাউলা সিরাজ হালকা সবুজ শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্পষ্ট পরিপাটি, বয়স কমে গেছে অন্তত দশ বছর। দেখা হলেই যে হারামজাদা বলে গালি দেই, আজ পারলাম না, অবাক হয়ে বললাম, ‘কী হইছে দোস্ত, তোরে তো প্রিন্সের মতো লাগতেছে!’ সিরাজ দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে, মুখ আকাশের দিকে তুলে পুরা সিনেমার মতো বলল, ‘আই অ্যাম ইন লাভ!’ তারপর আমরা কফি খেতে গেলাম। সারাক্ষণ প্রেমের গল্পই করল সিরাজ। মুনিরার ছবি দেখিয়ে বলল, ‘কাউকে প্রেমের গল্প বলতে না পারলে প্রেম ঠিক জমে না বুঝলি?’ হাসতে হাসতে বলল, ‘তুই ছাড়া আর কে আছে আমার প্রেমের গল্প শোনার।’ আবার কেমন মায়া হলো সিরাজের জন্য। কেমন নাছোরবান্দা ছেলে, পাতিয়ে হলেও জীবনের খেলায় জিতবে। মধুমিতা বা আনিলাকে নিয়ে কোনো কথা তুললাম না, এত কলকল করে প্রেমের গল্প বলছিল, থামাতে ইচ্ছে করে নি। আমরা যখন জীবন প্রায় গুটিয়ে এনেছি, তখন সিরাজের জীবনের নতুন শুরু দেখে খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম।


সিরাজ আমার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। একসঙ্গে ময়মনসিংহ শহর মাথায় নিয়ে ঘুরেছি আমরা, ব্রহ্মপুত্র রোজ একসাথে দেখেছি। সবসময় টগবগ করে ফুটতে থাকে যারা সিরাজ ছিল সেই দলের। সারাক্ষণ হৈচৈ করে বেড়াত, ক্লান্তি বলে কিছু ছিল না। ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াত, পাওয়ার পলিটিক্স করত, তবু সকলের প্রিয় ছিল। সাধারণ বন্ধুদের সঙ্গে দিলখোলা, দলের নেতাদের কাছে সব সম্ভব করতে পারা কর্মী, লেখাপড়ায়ও খুব খারাপ না। আবার রক্তদান টাইপ সংগঠনের সাথেও থাকত। ক্যাম্পাসে কোনো অনুষ্ঠান হলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ত।

আর কিশোর বয়স থেকে সিরাজের একটাই স্বপ্ন, মেয়ের বাপ হবে। কোনো মেয়ে দেখে পছন্দ হলেই বলত, দেখছিস আমার মেয়ের আম্মাজান। কোনো দোকানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেত, ছোট্ট একটা ফ্রক বা গোলাপি একজোড়া ছোট্ট জুতা দেখলে মুখটা কেমন কোমল হয়ে যেত। আমরা টেনে না ধরলে দোকানে ঢুকেই যেত। দোকানি যখন জিজ্ঞেস করত, ‘মেয়ের বয়স কত ভাই?’ তখন লজ্জায় লাল হয়ে যেত। আমরা হাসতে হাসতে বলতাম, ‘মেয়ের আম্মাজানকেই এখনও পাওয়া যায় নাই।’ আর একলা গেলে কিনেই ফেলত ছোট একটা রানি পুতুল। ক্যাম্পাসে ফিরে হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজত, বোকা হাদারামের মতো মুখ করে বলত, ‘নে তোর কাছে রাখতে দিলাম। এটা নিয়ে হলে গেলে হারামিগুলা খ্যাক খ্যাক করে হাসবে।’
আমি রেগে বলতাম, ‘হারামজাদা কিনেই ফেলছিস!’
ব্রহ্মপুত্রের পারে বসে সিরাজ উদাস হয়ে বলত, মেয়ের নাম রাখব ব্রহ্মপুত্র। আমরা একযোগে হৈহৈ করে বলতাম, ‘তোকে শালা কেউ বিয়ে করবে না, যদি আগেই শোনে মেয়ের নাম রাখবি ব্রহ্মপুত্র।’ হো হো করে হেসে সিরাজ বলত, ‘কথা পেটে চেপে রেখে বিয়ে করব, হাসপাতালে বউ যখন অজ্ঞান থাকবে, তখনই হাসপাতালের রেকর্ড বুকে মেয়ের নাম লিখে দেবো, ব্রহ্মপুত্র। বউয়ের জ্ঞান ফেরার আগেই আব্বাকে বলব আকিকা দিয়ে নাম রেখে ফেলতে। জ্ঞান ফিরে বউ আর নাম বদলাতে পারবে না।’ আমরা বলতাম, ‘শালা বউরে অজ্ঞান রাখতে রাখতে মাইরা ফেলবি নাকি?’
অনার্স ফাইনালের আগে আগে ওর পার্টির দুই গ্রুপে কী জানি ঝামেলা হলো, ক্যাডারদের গোলাগুলিতে একজন মারাও গেল, সিরাজের মন উঠে গেল ক্যাম্পাস থেকে। খালি বলত দেশে আর থাকব না। ঘন ঘন ঢাকায় চলে যেত। সিরাজকে ছাড়া আমাদের খুব খালি খালি লাগত, কয়েকজন প্রেম করতে শুরু করল, আমি পড়ালেখায় খুব মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। যেদিন অনার্স ফাইনাল শেষ হলো, সেদিনই সিরাজ বোম ফাটাল—‘আমার ডিভি লাইগা গেছে রে!’ টিকিট পর্যন্ত হয়ে গেছে। আমরা শোকে পাথর। ‘মাস্টার্স করবি না’ বলে চিল্লালাম। কোনো লাভ হলো না, সিরাজ চলেই গেল। সি অফ করতে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন। এয়ারপোর্টে খুব হাসিখুশি ছিল, আমরাও মজা করছিলাম। সিরাজ বলেছিল, ’গিয়ে ফিট হয়েই বিয়ে করে ফেলব, জানিস নিউইয়র্কে অনেক বাঙালি মেয়ে আছে, ব্রহ্মপুত্রের মুখে আব্বা ডাক না শুনে আমি আর টিকতে পারতেছি না। তোদের টিকিট পাঠায়ে দেবো, মেয়ে দেখতে চইলা আসিস।’ তখনও নেট এত জাল বিছায় নাই। মাসে একবার মেইল করত, সিসি দিয়ে সবাইকে এক চিঠি। আমরা আলাদা আলাদা উত্তর লিখতাম। তারপর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে নানান দিকে ছড়িয়ে ছটিয়ে গেলাম, সবার সঙ্গেই যোগাযোগ কমে গেল।
তিন বছর পর সিরাজ জানিয়েছিল, বিয়ে করেছে, প্রেমের বিয়ে, কলকাতার মেয়ে মধুমিতাকে। ছবি পাঠিয়েছিল, খুব সুন্দর বউ, সুচিত্রা সেনের মতো। তারও বছর দুয়েক পরে একদিন মাঝরাতে ফোন। ফোন ধরেই শুনি ও পাশে হাউমাউ করে কাঁদছে সিরাজ। আমি ব্যাকুল হয়ে বলেছিলাম, ‘কী হইছে দোস্ত!’ ভয়ে আমার গলা শুকায়ে কাঠ, বিদেশের বিয়ে ভেঙে-টেঙে গেল নাকি! নাকি দেশে ওর বাপমায়ের কিছু হলো! সিরাজ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল, ‘ছেলে হইছে আমার!’ আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, ‘হারামজাদা ছেলে হইছে তো কান্দিস ক্যান? মিতা কেমন আছে?’ ‘মিতা ঠিক আছে রে, আমার ব্রহ্মপুত্র তো আইলো না!’ রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেছিল। যা মনে আসে সব গালি দিয়ে বলেছিলাম, ‘তুই আমারে আর কোনোদিন ফোন দিবি না হারামজাদা।’ এবং তারও বছর দুয়েক পরে দেশে ফিরে এসেছিল সিরাজ, একা।
আমার তখন বন্ধুবান্ধবের খবর নেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। অসুখবিসুখ, টাকাপয়সার টানাটানিতে জেরবার। ছেঁড়া ছেঁড়া শুনেছিলাম, বিয়ে ভাঙে নি, তবু ছেলে আর বউকে আমেরিকায় ফেলে দেশে চলে এসেছে সিরাজ। আমার তখন মনে মনে গালি দেওয়ার শক্তিও ছিল না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা ছোটখাটো ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সব টাকা-পয়সা, এনার্জি শেষ হয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে খবর পেতাম সিরাজও ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা দাঁড় করাচ্ছে। বাকি বন্ধুবান্ধবও যার যার জীবনের গরম তেলের কড়াইয়ে ভাজভাজা হচ্ছিল। ত্রিশ থেকে চল্লিশ এই দশ বছর সবারই এরকম কড়াই-জীবন যায় নাকি শুধু আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের কয়েকজনের গেছে জানি না। তবে চল্লিশ হয়ে এলে আমাদের কড়াইয়ের চুলা নিভে গিয়েছিল, ধীরে ধীরে তেল ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। আমরা ঠান্ডা তেল থেকে না নেমেই, কাছিমের মতো গলা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে বন্ধুদের খুঁজেছিলাম। দুই-একজন সাহস করে কড়াই থেকে নেমে দেখেছিল, বাইরের দুনিয়া কেমন করে কতটা বদলে গেছে।
দেখাদেখি হওয়ার উদ্যোগ সিরাজই প্রথম নিয়েছিল। রীতিমতো পার্টি দিয়েছিল। সে নাকি একটা মেয়ে পেয়েছে, সেই খুশিতে পার্টি। দীর্ঘদিন পর সবার দেখা, একেক জনের চেঞ্জ চোখে পড়ার মতো—কারো চুল পড়ে টাক, কারো ভুঁড়ি, চোখে মোটা চশমা, চুলে পাক ধরেছে কারো। বাইরের এসব চেঞ্জ দেখা হয়ে গেলে পরে টর্চের ডান্ডায় দড়ি বেঁধে নামিয়ে দিয়েছিলাম এক একজনের আত্মার ভেতরে। দেখেছিলাম, সেখানে জমেছে ক্লান্তি আর ক্লান্তি। সিরাজের পাতানো মেয়ে এসেছিল। আমাদের খুব আঙ্কেল আন্টি ডেকেছিল, সিরাজকে বাবা বাবা ডেকেছিল, সিরাজও খুব ব্রহ্মপুত্র ব্রহ্মপুত্র ডেকেছিল। যারা ময়মন্সিঙ্গা তাদের জিভে ব্রহ্মপুত্র খুব আরামের শব্দ। অন্যরা আসল নাম আনিলাই ডেকেছিল। গল্পে গল্পে জেনেছিলাম, একটা ট্যুরে গিয়ে আনিলার পরিবারের সঙ্গে দেখা সিরাজের। সিরাজ ছিল ট্যুর ম্যানেজার। চাচা চাচি মা আর ভাইয়ের সাথে সুন্দরবন ট্যুরে গিয়েছিল আনিলা। আনিলার তখন স্কুলের শেষ পরীক্ষা শেষ হয়েছে, কলেজে ওঠার আগে বেড়ানো। সঙ্গে বাবা নেই দেখে সিরাজ ধরেই নিয়েছিল মারা গেছে। আর তাতেই সিরাজের মন হুহু করে উঠেছিল। মনে মনে বলেছিল, ‘আহারে মা, তোর তো আমার ঘরেই আসার কথা ছিল, ভুল করে অন্য ঘরে জন্মাইছিস।’ আনিলাও হয়তো বুঝেছিল সিরাজের মায়ার দৃষ্টি। আংকেল ডেকেছিল আর খুলনায় ফিরে গিয়ে রেজাল্টের খবর দিয়েছিল সিরাজকে। সিরাজ খুব উৎসাহ দিয়ে বলেছিল ঢাকার কলেজে ভর্তি হতে। আনিলা অবশ্য আসে নি। দুই বছর পরে কলেজ শেষ করে কোচিং করতে এসেছিল ঢাকায়। সিরাজের মনে হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র এসে গেছে ঢাকায়। মধুমিতা যখন বলেছিল, ছেলের নামই ব্রহ্মপুত্র রাখো, তখন সিরাজ সিনেমার মতো বলেছিল, না না না। এবার সেইভাবেই তার মনে হয়েছিল হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ শি ইজ মাই ডটার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আনিলা যেদিন আজিমপুরে একটা ম্যাচে উঠেছিল, সেদিন সিরাজের গলার কাছে দলা পাকিয়ে ছিল একটা কথা, ‘তুই আমার মেয়ে, আমার বাসায় থাকবি চল।’ কিন্তু যতই ইমোশোনের ডিব্বা হোক, এটা যে বলা যায় না সিরাজ বুঝেছিল। আজিমপুরের মেসে আনিলাকে রেখে চোখ মুছতে মুছতে বাসায় ফিরেছিল সিরাজ।
কন্যাপার্টির পর সিরাজের সাথে যোগাযোগ ছিল। বাবা-মাকে নিয়ে উত্তরার বাসায় থাকত। পুরাতন বন্ধুবান্ধবের কেউই উত্তরা থাকত না, ব্যবসায়িক বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে হাঁপিয়ে উঠলে হুটহাট ফোন দিত, ছেলে আর বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘ওরা আছে ভালোই।’

আমি যদি বলতাম, ‘তুই মাঝেমধ্যে ওদের দেখতে যাস না কেন? ব্যবসা তো এখন ভালই চলতেছে, টাকা-পয়সার টানাটানি নাই, যা পোলা দেইখা আয়।’ সিরাজ বলত, ‘আব্বাআম্মার বয়স হইছে, একলা ফালায়া ক্যামনে যাই।’ আমি রাগ করে বলতাম, ‘তাইলে ওদেরই আসতে বল।’ সিরাজ বিরক্ত হয়ে বলত, ‘তুই বড়ই আম্মাগিরি করিস।’ আমার হাসি পেয়ে যেত, বলতাম, ‘হারামজাদা মানুষ হইলি না।’ আনিলা কেমন আছে জানতে চাইলে কলকল করে অনেক কথা বলত। ‘মেয়েটা অনেক ভালো রেজাল্ট করতেছে বুঝলি, আমার ভয় ভয় করতেছে, বিদেশ চলে যাবে।’ আমি আবার বলতাম, ‘ভালো তো আমেরিকা চলে যাক, তুই গেলে একসাথে সবাইকে দেখে আসতে পারবি।’


আমার অফিসে এসে আমাকে বের করে নিয়ে কফি খেতে খেতে প্রেমকাহিনি শোনানোর পর কয়েকমাস কেটেছে। আমি দুই একবার ভেবেছি, মধুমিতার সাথে ডিভোর্স হয় নি সিরাজের, মুনিরাকে যদি বিয়ে করতে চায়, তাহলে ডিভোর্স লাগবে। আর যদি শুধু প্রেমই করে, ঝামেলা নেই তেমন। মধুমিতা জানতে পারলে হয়তো নিজেই ডিভোর্সের কথা তুলবে। এভাবে দুই জন দুই দেশে আর কতদিন? কিন্তু এসব সিরাজকে বলি না কখনও। আগে হলে হয়তো বলেই ফেলতাম, কিন্তু এখন ঢাকা শহরে রোজ এত এক্সিডেন্ট হয়! বলা হয় না, কেমন মৃত্যুমুখী হয়ে গেছি আমি। কে কবে মরে যাবে, তার নাই ঠিক, যা খুশি করুক। কিন্তু সিরাজ আবার এল। অফিসের নিচে এসে ফোন করে আমাকে নামাল। নেমে দেখলাম আগের সেই ঝলমলে ভাব উধাও। মাত্র কয়েকমাস আগেই ঝলঝল করছিল। আমি আগের মতোই বললাম, ‘কী হইছে দোস্ত, তোরে এত মলিন লাগতেছে ক্যান!’ সিরাজ আগের মতোই বলল, ‘মে বরবাদ হো গায়া!’

আবার কফিশপে গিয়ে বসলাম, সিরাজের বরবাদির গল্প শুনতে। আগের দিন প্রেমের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগছিল, আজ বরবাদির গল্প শুনতে হবে ভেবেই কেমন ক্লান্ত লাগছে। মনে মনে বললাম, ‘হারামজাদা আর কাউরে পাইলি না?’ শব্দ করে এটা বলতে পারলাম না বলে রাগ করে আগুন গরম কফিতে বড় চুমুক দিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেললাম। প্যাঁচার মতো মুখ করে বললাম, ‘বল কী হইছে।’ ততোধিক প্যাঁচা হয়ে সিরাজ বলল, ‘ব্রহ্মপুত্রের কথা শুনতেই পারে না মুনিরা!’ রাস্তার একেবারে পাশেই কফির দোকানটা। আমি বসেছি রাস্তার দিকে মুখ করে, সিরাজ পিঠ দিয়ে। সিরাজের বাক্য শেষ হওয়ার সাথে সাথেই একটা প্রাইভেট কার এক মোটর সাইকেলকে ধাক্কা মারল। কাচের দোকানে শব্দ ঢুকল না, একটা সাইলেন্ট এক্সিডেন্ট দেখলাম। আশপাশের লোকজন ছুটে এল, দোকানে যারা ছিল তারাও ছুটে বেরিয়ে গেল। সিরাজ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হইলো রে?’ বললাম, ‘কিছু হয় নাই, তুই কী বলতেছিলি বল।’ আমার চোখ সিরাজের ঘাড়ের উপর দিয়ে রাস্তায়, সিরাজ বলছে, ‘মুনিরার সাথে মধুমিতার গল্প পর্যন্ত করা যায়, কিন্তু আনিলার নামও নেওয়া যায় না।’ বাইরে অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ি এসে গেল। বাইকে একটা পরিবার ছিল, একজন মনে হয় মরেই গেছে। এক্সিডেন্টের আগে পিছে যতদূর চোখ যায়, দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গাড়ি। ক্রমাগত হর্ন নিশ্চয়ই বাজছে, কাচের কফিঘরে শব্দ আসছে না।

এদিকে সিরাজ বলছে, ‘মুনিরার সাথে এক মাস ধরে যোগাযোগ নেই। শেষ কথা বলেছে, হয় আনিলা না হয় আমি, যে কোনো একজন!’ অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ি চলে গেল, মোটরসাইকেল আর প্রাইভেট কার কোনদিক দিয়ে কোথায় গেল বোঝা গেল না। জ্যাম খুলে গাড়ির সারি চলতে শুরু করল। রাস্তা থেকে চোখ এনে সিরাজের মুখে ফিট করলাম। সিরাজ ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘তুই একটু মুনিরার সাথে কথা বলবি?’ কফিঘর থেকে যারা এক্সিডেন্ট দেখতে গিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ ফিরে এল। তাদের একজন ক্যাপাচিনো অর্ডার দিয়ে বলল, ইশ বউটাই মরেছে। আমি সিরাজকে বললাম, ‘কী বলব মুনিরাকে? তোমার কেন সিরাজের পাতানো মেয়েকে সহ্য হচ্ছে না?’
সিরাজ রাগে কটকট করে তাকালো আমার দিকে। সেটা উপেক্ষা করে বললাম, ‘আমার ইচ্ছা করতেছে তোরে ঢিল মেরে বউ-ছেলের কাছে পাঠায়ে দেই।’
সিরাজ আমার ফোন নিয়ে মুনিরার নাম্বার লিখে দিয়ে ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘এখনি কথা বল প্লিজ!’
ওপাশে হ্যালো হওয়ার পর স্পিকার বন্ধ করে কানে নিলাম আমি। নিজের নাম বলে দেখা করতে চাইলাম। দিনক্ষণ ঠিক করে ফোন কেটে সিরাজের দিকে আগুনচোখে তাকালাম। সিরাজ কোকিলের মতো ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘মুনিরারে ফিরায়ে এনে দে দোস্ত!’


তিনদিন পর বিকালে মুনিরার অফিসের নিচে গিয়ে ফোন করলাম। নেমে এল বিষণ্ন মেঘের মতো মুনিরা। কথা বলতেই ভয় করছিল আমার। মনে মনে বললাম, হারামজাদা সিরাজ কিসের মধ্যে ফালাইলো আমারে। গলা শুকায়ে গেছে, কথা বলতে গিয়ে দেখি ঠোঁট জোড়া লেগে গেছে। মুনিরাই মাছরাঙা হয়ে মাঝনদী থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিল আমাকে। বলল, ‘আমি জানি আপনি সিরাজের বন্ধু, সিরাজই আপনাকে পাঠিয়েছে, কোথায় বসা যায়?’ আমি আটকে থাকা দম ধীরে ধীরে ছেড়ে বললাম, আপনার যেখানে ইচ্ছা। মুনিয়া মোমের মতো হেসে বলল, ‘একটু নিরিবিলি বসা লাগবে, আপনাকে যা বলতে হবে, সেটা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলতে পারি। লোকে দেখলে কেমন কেলেঙ্কারি, চিন্তা করেন!’ আমিও হাসলাম, ‘আরে না না কিসের কান্নাকাটি, হারামজাদা সিরাজ যদি আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকে, আপনি আর আমি দুই জনে মিলা পিটামু শালারে।’ এবার হো হো করে হাসল মুনিরা। আমরা সূর্যসেন হলের সামনে ঘাসের উপরে গিয়ে বসলাম। আবার মুনিরা মেঘের মতো গম্ভীর, আবার আমার ভয়। এবার আমাকেই কথা বলতে হলো—মুনিরার হাত ধরে বললাম, ‘মেয়ের বাবা হওয়ার খুব শখ ছিল সিরাজের, শখ না ঠিক, এটা প্রায় জীবনের লক্ষ্যের মতো ব্যাপার!’ মুনিরা বলল, ‘আপনার হয়তো মনে হচ্ছে কী ছোট মন আমার, একটা বাচ্চা মেয়েকে সহ্য করতে পারছি না আমি!’ আমি পুকুরে আংটি খোঁজার মতো কথা খুঁজতে শুরু করলাম, সিরাজকে গালি দিতেও ভুলে গেলাম। মুনিরা প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘খুব ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে আমার, পাতানো বাবারা আমার জীবন তছনছ করেছে!’ সত্যি বলছি, এ রকম একটা কথার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমি। ভেবেছিলাম, হয়তো পাগলা সিরাজ মেয়ে মেয়ে করে খুব আদিখ্যেতা করে, সেটাই অপছন্দ করে মুনিরা। মুনিরা কী আরো কিছু বলবে? প্রাণপণে চাইলাম, যেন আর বিস্তারিত কিছু না বলে। ভয়ে ভয়ে তাকালাম মুনিরার মুখের দিকে। ঘৃণায়, বিতৃষ্ণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুনিরার চাঁদের মতো মুখ! আর কিছুই বলল না মুনিরা।


পরের দিন সিরাজের ফোন ধরলাম না। সিরাজকে বাদ দিয়ে অন্য বন্ধুদের নিয়ে বৈঠক হলো। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো সিরাজের ব্যবসা কয়েকজন মিলে সামলাবে মাস ছয়েক, সিরাজের ইউএস ভিসা আর টিকিট সামলাবে বাকিরা।
আবার আমরা সিরাজকে এয়ারপোর্টে সি অফ করতে গেলাম দল বেঁধে। আবার খুব হাসাহাসি হলো। সিরাজ বলল, ‘আগের বার তো কোনো শালা চাস নাই যে যাই, এবার জোর কইরা পাঠাইলি মনে রাখিস।’ আবার একচোট হাসাহাসি হলো, হৈহৈ করে সবাই একসাথে বললাম, ‘এবার ফিরা আয়, তোরে বরইভর্তা বানামু হারামজাদা।’
পৌঁছে তিন জনের একসাথে তোলা ছবি পাঠালো সিরাজ। শান্তিময় ছবি, পাতানো সম্পর্কের কালো ছায়া সরে গেছে সিরাজের মুখ থেকে।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending