Connect with us

গল্প

এক বোতল আসমান

Published

on

এক বোতল আসমান

কাল রাতে এক জগঝম্প অজগর আটকে ফেলেছিল ছমিরুদ্দিনের নাও। কংসের তখনও কাটেনি হেমন্তের ঘ্রাণ। তারা নাও বায় আর নাও বায়। এক গঞ্জ থেকে আরেক বাজার, ঘুরে ঘুরে চক্কর খায় বারো মাস। বারো মাসে একবারই গ্রামে আসে, নীলডুরি। ছমিরুদ্দিন হিসাব করে, আর হাজার টাকা জমলেই নীলডুরি যাওয়া পড়বে, হয়তো তখনও কলাইয়ের ক্ষেতে মহিষ চড়তে নামেনি, ডেউয়া ফলেরা পিচ্ছিল করে তোলেনি ঘরের পথ। হাজার টাকা হলে এবারের মতো বছর খোরাকির ধান হয়ে যায়। পোলাপানের বায়না সামাল দেওয়া কি আর এখন ঘরগেরস্তির বিষয়, গেরস্তিতে আর কোনো আয় রোজগার নাই এখন। তাই তো তাকেও প্লাস্টিক নাওয়ে কাজ নিতে হয়, বাপে দর্জির কাম জানত, সেইটা তো তার আর শেখা হয় নাই। এক জনমে মানুষ এত কিছু কী করে মনেই-বা রাখবে? ঘাড়ের ওপরে মুণ্ডু তো একটাই, মানুষ তো আর রাবণ না যে এক ঘাড়ে দশ মুণ্ডু নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। গ্রাম বাজার ঘুরে ঘুরে তারা প্লাস্টিকের খালি বোতল কি তেলের গ্যালন, খালি কৌটা কিনে ঠাসা করে মহাজনের নৌকা, ঐ নৌকাতেই রান্না ঐ নৌকাতেই গোসল, ঐখানেই ঘুম। সরকারে আড়ঙ্গ খেদাইছে বলে মানুষের মনে কোনো ফুর্তি ফার্তা নাই এইবার। থানায় নোটিশ আসছে, গাঁওগেরামের ষাঁড় গরু সব গেরস্ত বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। ষাঁড়ের নাড়াই ছাড়া কি আর রং লাগে গায়! না কোনো ফিরিস্তি না কোনো ফর্দ। খালি খালি দশ রাত বসিয়ে রাখা হয়েছে কবিরাজদের, কত সব তাবিজ কবজ আর তেল-পানির কারবার। গুল সিরাজীকে নিয়ে আসা হয়েছে তিলকপুর থেকে, চার দিনের হাঁটা আর নাও পথ, কবিরাজিতে এই তল্লাটে তাকে পাট দেয় এমন গর্দান কারও নাই।

যত তেলেসমাতির ষাঁড়ই হোক না কেন, গুল আলীর শরীরের ঝাঁজ বশ করে ফেলতে পারে তারে এক ঝটকায়। আড়ঙ্গ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো দানাপানি নেয় না গুল আলী, কেবল দিনরাত মেরাজ আলী ফকিরের গানই সজাগ থাকবার রসদ জোগায় তাকে। ছমিরুদ্দিনরা গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়ায় আর বিষণ্নবিমুখ মানুষের যাতনা দেখে না দেখে দুমড়ানো-মুচড়ানো প্লাস্টিকের বোতল জোগাড় করে। দুপুরের ফিনফিন উষ্ণতা কংসের ঘোলা বুকে ছড়িয়ে রাখে বাড়ি ফেরার টান বা তাড়না। সেইসব তাড়না ডিঙিয়ে ছমিরুদ্দিন বা হানিফ মিয়া বা বটকেল কারোর সাধ্যি নাই ঝাঁজ শুঁকে শুঁকে বশ হয়ে যাওয়ার। নাওভর্তি প্লাস্টিকের থ্যাঁতলানো বোতলে শত ঝাঁকালেও যেমন আর কোনো তলানির হদিস পাওয়া যায় না, দিনশেষে বিকালে রান্নার সময় প্রতিদিন যেন এমন হয়, শত ঝাঁকালেও একটি তরকারি বা একহাতা ভাতও বাড়ে না কোনো সন্ধ্যায়। নিজে খেটেই বাজার করতে হয়, রান্না চাপাতে হয়, এখানে কোনো তেলেসমাতি নাই, বাজারে গিয়া কোনোদিন কেউ দেখে না চাউলের দাম কমেছে বা মাছের একটা টুকরা ছমিরুদ্দিনদের পাতেও পড়েছে। তেল-নুন-হলুদ-মরিচ-ধনিয়া-জিরা-সরিষা-মেথি-কালোজিরা-গুয়ামুরি-রান্ধুনি-সজ-তেজপাতা-লং-এলাচি-দারচিনি একটা আরেকটার আগপিছে মিলেমিশে কি ধাঁধানো তাতানো তৈয়ার করে ছমিরুদ্দিনরা গেল তিরিশি বছরে সেইসব ভুলে গেছে।
ছমিরুদ্দিনদের স্মৃতি থেকে তিতা-মিঠা-নোনতা-টক-কষা-পানসে সব স্বাদ লাপাত্তা হয়েছে সেই কবে, ক্ষয়াটে জিহ্বার দলিত মথিত রোয়ার ভাঁজ থেকে প্রাগৈতিহাসিক ঢেকুরের ছিন্নভিন্ন টুকরা টাকরা জানান দেয় ‘সেই কবে জীবন ছিল …’ এমন কথা। ইরির ভাতে মরিচ ভর্তা ডলতে ডলতে তেতে উঠে হাতের তলা, রঙিন ভাতে ঠিকরে পড়ে কুপিবাতির শিরশির। দিনের ভেতর এই একবারই খাবার জোটাতে ছমিরুদ্দিনদের হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় গ্রাম কি গ্রাম থ্যাঁতলানো বোতলের খোঁজে। গ্রামের মানুষের জন্য তাদের মায়া হয়, একটা বোতল খাওয়ার পয়সাও জোটাতে পারে না কেউ, শহরে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে কত বোতল খালি হয়, ঘণ্টায় ঘণ্টায় বোঝাই হয় নাও, সেখানে কি আর কেউ বাড়ি ফেরার জন্য হাজার টাকা জোগাড় করতে মাসের পর মাস মরিচ ডলে ভাত গিলে? আর গাঁওগেরামের মানুষেরাও কেমন যেন, বোতলে যা থাকে তা ঝেড়েমুছে খাওয়ার দরকার কী, আর খেতেই যদি হয় তবে তেল কি নুন কি, বীজ কত কি রেখে বোতলগুলো আটকে রেখে লাভ কী। গাঁওগেরামের কত না ঘরের কত না সংসারের বলা না বলা কত কিসিমের আহাজারি নিয়ে দুমড়েমুচড়ে এক-একটা জায়গা নেয় ছমিরুদ্দিনদের নৌকাতে। মাঝপথে নানান বন্দর বাজার ঘুরতে ঘুরতে এইসব বোতল আবারও শহরের কারখানাতে যায়। শহরের কারখানার মেশিনে আবারও পেট ফুলিয়ে রংবেরঙের নাম লাগিয়ে আবারও ঢুকে গাঁওগেরামের গরিবি জিম্মায়।
শহর থেকে কেন আসে গাঁয়? কেন আবার হতচ্ছাড়া বোতলের লাশগুলোকে পাঠাতে হয় শহরে। গ্রাম থেকে শহরে শূন্য দুমড়ানো বোতল পৌঁছে দেওয়ার এই দায় কেন বারবার ছমিরুদ্দিনদেরকেই সামলাতে হয়। বাদাঘাট থেকে আসা ভারতীয় পাতার বিড়ির কষ ভিরমি খায় গলুই থেকে নাওয়ের পাছা ছাড়িয়ে এক হাইতোলা বাজারের দোকান খুপরির বেদনার্ত কলিজায়। যেন এক দীর্ঘ নিশ্চুপ বাজার যেখানে গ্রামের কেউ কোনো কিছু বেচে না কিন্তু হরদম বেচাকেনা থামে না, শহরের মালপত্তরে বোঝাই দম ফেলার জায়গা পায় না মানুষ, কিন্তু বিক্রি থামে না, দাম কমে না কোনো কালে। কোনো দরবার নাই, হট্টগোল নাই, ঘাড় নোয়ানো হাজার টাকা জোগাড়ের হাপিত্যেশ থ্যাঁতলানো বোতলের বোঝাই পাহারা দেয় সারারাত। যেন সারারাত আসমান ভেঙে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গলে গলে দুমড়ানো বোতলের ঘেরে জমা হয়, নীলডুরি বা অন্য নামে যেখানে কোনো হদিস নাই, চূড়ান্ত হয় না কোনো কিছু, থাকে কেবল নিরাপদ যাত্রার একচ্ছত্র দাগ ও দাগিদের অসম্ভব অপেক্ষা। রাতের তড়পানো সরিয়ে সাহসী কায়দায় ছমিরুদ্দিন, বটকেল কি হানিফ মিয়া আবারও বোতল মাপার সিদ্ধান্ত নেয়।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending