Connect with us

ইসলাম কী বলে

মানুষকে বিভ্রান্তকারী মোহসমূহ

মানুষকে বিভ্রান্তকারী মোহসমূহ

‘নারী, সন্তান-সন্ততি, সোনা-রুপার স্তূপ, বাছাইকৃত ঘোড়া, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে। এসব (কেবলমাত্র) পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্তু। আর আল্লাহ, তারই কাছে রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৪

বর্ণিত আয়াতে ছয়টি বিষয়ের প্রতি মানুষের স্বভাবগত আকর্ষণের কথা বলা হয়েছে। বিষয়গুলো একদিকে যেমন লোভনীয়, তেমনি দুনিয়ার জীবনেও পরীক্ষার মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি পার্থিব সবকিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা করেছি মানুষকে পরীক্ষার জন্য, যাতে তাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে কে শ্রেষ্ঠ (সেটা বাছাই করা যায়)।’ -সুরা কাহাফ : ৭

আলোচ্য আয়াতে সর্বপ্রথম নারীর প্রতি আকর্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর প্রত্যেক পুরুষের সব থেকে বেশি প্রয়োজন হয় একজন সঙ্গিনীর। পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) থেকে শুরু করে আজ অবধি এ ধারা চলমান। তবে শর্ত হলো, নারীর প্রতি ভালোবাসা হতে হবে শরিয়তসম্মত ও আধিক্যবর্জিত। তবেই নারী হবে উত্তম জীবন সঙ্গিনী ও আখেরাতের সম্বল।মানব প্রকৃতির সঙ্গে সুশোভিতকরণের দ্বিতীয় বিষয় সন্তান-সন্ততি। যা মা-বাবার জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পরম নেয়ামত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সন্তান-সন্ততি অন্তরের ফসল, এটি পিতাদের কাপুরুষতা, কৃপণতা ও চিন্তার কারণ।’ সন্তানের প্রতি মা-বাবার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মা-বাবার প্রতি সন্তানের অগাধ অনুরাগ একান্তই প্রাকৃতিক। একজনের অনুপস্থিতি অপরজনকে সদা তাড়া করে, কাছে পাওয়ার আকুলতা অস্থির করে তোলে। মা-বাবা ও সন্তান-সন্ততির অভেদ্য ভালোবাসা ও অকৃত্রিম অনুরাগ নিরেট আল্লাহর দান। কোরআনের ভাষায়, ‘ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা এবং স্থায়ী সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের কাছে পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং কাঙ্ক্ষিত হিসেবেও উৎকৃষ্ট।’ -সুরা কাহাফ : ৪৬

তৃতীয় বিষয় সোনা-রুপার রাশি রাশি স্তূপ। আমরা জানি, মানব মাত্রই সম্পদের প্রয়োজন। তবে সে প্রয়োজনীয়তা যেন লোভে পরিণত না হয়, যা আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন করে দেয়। কোরআনের ভাষায়, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও।’ -সুরা তাকাসুর : ১-২

হাদিসের ভাষায়, ‘বনি আদমের (মানুষের) যদি দুই উপত্যকা পরিমাণ সম্পদ থাকে, সে তৃতীয় উপত্যকার বাসনা করবে। আর বনি আদমের পেট কবরের মাটি ছাড়া পূর্ণ হবে না। আর আল্লাহ তওবাকারীদের অনুশোচনা কবুল করেন।’ -সহিহ বোখারি : ৬৫১২

চতুর্থ বিষয়, প্রশিক্ষিত ঘোড়া। তৎকালীন আরব ও সমকালীন বিশ্বে ঘোড়ার আলাদা কদর রয়েছে। পবিত্র কোরআন-হাদিসে ঘোড়ার বর্ণনা ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা বারবার বলা হয়েছে। সুরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহ ও তোমাদের শত্রুকে এবং অন্যদের, যাদের তোমরা জানো না।’

পঞ্চম বিষয়, চতুষ্পদ প্রাণী। যেমন- উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে ২০০ আয়াতে বিভিন্ন প্রাণী সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে এবং মোট ৩৫টি প্রাণীর নাম উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে পাখি, পোকামাকড়, বন্যপ্রাণী ও পোষাপ্রাণী। কয়েকটি সুরা প্রাণীর নামেও রয়েছে। প্রাণী সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর চতুষ্পদ জন্তুগুলো, তিনি তা সৃষ্টি করেছেন; তোমাদের জন্য তাতে শীত নিবারক উপকরণ ও বহু উপকার রয়েছে এবং সেগুলো থেকে তোমরা আহার করে থাকো, আর তোমরা যখন গোধূলিলগ্নে তাদের চারণভূমি থেকে ঘরে নিয়ে আস এবং প্রভাতে যখন তাদের চারণভূমিতে নিয়ে যাও তখন তোমরা তাদের সৌন্দর্য উপভোগ করো।’ -সুরা নাহল : ৫-৬

পশু-পাখির অধিকার রক্ষার বিষয়ে হাদিসে নববিতে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বারবার সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন তোমরা হালাল পশু জবাই করবে, সর্বোত্তম পন্থায় করবে। জবাইয়ের বস্তু ভালোভাবে ধার দিয়ে নেবে আর পশুটিকে স্বাভাবিকভাবে প্রাণ বের হওয়ার সুযোগ দেবে।’ -সহিহ মুসলিম : ১৯৫৫

ষষ্ঠ বিষয় হলো- ক্ষেত-খামার, চাষাবাদ। অর্থাৎ ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মতো ক্ষেত-খামারের চাষাবাদ ইত্যাদি পার্থিব উপায়-উপকরণ। যেমন সুরা নাহলের ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য (পানি দ্বারা) শস্য, জয়তুন, খেজুর গাছ, আঙুর ও সর্বপ্রকার ফল জন্মানো। অবশ্যই এতে চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার একখ- জমি রয়েছে, সে যেন তা আবাদ করে। যদি সে আবাদ করতে না পারে, তার উচিত; তা অন্যকে দান করা। যাতে সে আবাদ করে ভোগ করতে পারে।’ -জামে : ৬৫১৪

ইসলামের চাষাবাদের প্রতি যেমনি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, তেমনি অতিমাত্রার আসক্তিকে পরীক্ষার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব কিছু মানুষের পার্থিব জীবনের উপকরণ ও ব্যবহারের ভোগ্যবস্তু মাত্র। কোরআনের ভাষায়, ‘আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখেরাতের নিবাস হলো- প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।’ -সুরা আনকাবুত : ৬৪

লেখার শুরুতে উল্লিখিত আয়াতের শিক্ষা প্রসঙ্গে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, বৈষয়িক সম্পদের প্রতি আকর্ষণ প্রতিটি মানুষের সহজাত প্রকৃতি। কিন্তু বিপজ্জনক বিষয় হলো, বৈষয়িক চাকচিক্যের মোহে প্রতারিত হওয়া ও পরকালের জবাবদিহির কথা ভুলে যাওয়া। ইসলাম মতে, পার্থিব বিষয় ও আশ্রয়কে ব্যবহার করা, সে সবের প্রতি আকর্ষণ মন্দ নয়। কিন্তু পার্থিব বিষয় ও আশ্রয়ের মোহের জালে আটকে পড়া এবং এসবের ওপর নির্ভর করা ক্ষতিকর।

তাই প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের উচিত, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে শেখা। মহান আল্লাহর দিকেই যে মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য, সেটা মনে রেখে জীবন পরিচালনা করা। তাহলেই কমে আসবে দুনিয়ার জীবনের হানাহানি, অসম প্রতিযোগিতা ও লোভ-লালসা। ফলে, ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র হবে সুখের ও শান্তির।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending