খেলার খবর
ফেইসবুকে একটা-দুটি স্ট্যাটাস দিলে হয়তো গা বাঁচাতে পারতাম
Published
4 weeks agoon
মাশরাফির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও নীজের নিরব ভূমিকা নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ও সবশেষ জাতীয় সংসদের হুইপ। একসময় বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রদের একজন ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেই তিনিই এখন গোটা দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠির কাছে খলনায়ক। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকে কিছু সমালোচনা তার সঙ্গী ছিল সবসময়ই। তবে কোটা আন্দোলনে তার নীরব থাকা, দলের উর্ধ্বে উঠে মানুষের পাশে থাকতে না পারার ব্যাপারটি নিয়ে তাকে তুলাধুনা করা হচ্ছে এখনও। নড়াইলে তার বাড়ীতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এই সবকিছু নিয়ে অবশেষে খুললেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সবশেষ জাতীয় সংসদের হুইপ। সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরলেন নিজের অবস্থান।
কোথায় আছেন, কেমন আছেন?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: শারীরিকভাবে ঠিক আছি। মানসিকভাবে অবশ্যই ভালো অবস্থায় নেই। আছি আর কী। ঢাকাতেই আছি, পরিবারের সঙ্গে।
এতদিন চুপ ছিলেন, আজ কথা বলতে রাজি হয়েছেন। গত এক মাসে দেশে এই যে এত কিছু হলো, এত বড় আন্দোলন, এত প্রাণহানি, এত রক্তপাত, সরকারের পরিবর্তন… সবকিছুতে পেছন ফিরে তাকালে ব্যক্তিগতভাবে আপনার এখন কি মনে হয়?
মাশরাফি: এই কষ্ট থাকবেই। হয়তো আজীবন থাকবে। দেশের একটা ক্রাইসিস মুহূর্তে পাশে থাকতে পারিনি, কিছু করতে পারিনি, এটা আমাকে সবসময়ই ভোগাবে, পোড়াবে। সবসময়ই থেকে যাবে।
সবসময় সব কথা বলা যায় না। কিছু জিনিস হয়তো বলার ব্যাপারও নয়। এতদিন চুপ ছিলাম। আজকে কিছু বলছি। কিছু হয়তো সামনে বলব। জীবনে অনেক কিছু হবে। তবে এই কষ্টটা রয়ে যাবে। যত কিছুই হোক, এটা কখনও যাবে না। নিজের ওপর সেই হতাশা সবসময়ই থাকবে।
তাহলে চুপ ছিলেন কেন?
মাশরাফি : এখন আসলে এসব কথার উত্তর বা ব্যাখ্যা দেওয়ার অর্থ নেই। যদি সরাসরি বলি, তাহলে অবশ্যই আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি অনেক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে।
কথা যদি বলতেই হতো তখন… কোটা সংস্করারের আন্দোলন অবশ্যই যৌক্তিক ছিল। আমার নিজের কাছেও মনে হচ্ছিল, এটা হয়ে যাবে। তবে সবাই যখন চাচ্ছিল যে আমি কিছু একটা বলি বা স্ট্যাটাস দেই (ফেইসবুকে)… ততক্ষণে আসলে সবকিছু এত দ্রুত হচ্ছিল… ভাবছিলাম যে আমি যদি কিছু লিখি বা মন্তব্য করি, সেটার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে… অনেক কিছু ভাবছিলাম আর কী… সব মিলিয়ে কিছু লেখা হয়নি।
আমি কিছু করার চেষ্টা করিনি, তা নয়। আমি শুধু কিছু লেখার ভাবনায় থাকতে চাইনি। চেয়েছিলাম ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে, আলোচনার মাধ্যমে কিছু করা যায় কি না। সেই শুরুর দিকেই চেষ্টা করেছি। কারণ তাদের দাবি আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। কিন্তু সেটাও করতে পারিনি। সব মিলিয়ে অবশ্যই ব্যর্থ হয়েছি।
আপনার চেষ্টা করার দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে না পারার কারণ কি? আপনাকে করতে দেওয়া হয়নি?
মাশরাফি: দেখুন, আমি ছোট থেকে ক্রিকেট খেলেছি, একসময় জাতীয় দলে এসেছি, পরে অধিনায়ক হয়েছি। অধিনায়ক থাকার সময় দল যখন হেরেছে বা খারাপ করেছে, সেটার দায় আমাকে নিতে হয়েছি। আমি সবসময়ই নিয়েছি। আপনারা যদি মনে করতে পারেন, ম্যাচ হারলে অধিনায়ক হিসেবে আমি দায় নিয়েছি। কিন্তু রাজনীতির আঙিনা তো ভিন্ন।
রাজনীতির মাঠে আমি আমার দলের অধিনায়ক নই। সহ-অধিনায়ক নই। এমনকি, বড় কেউ নই। মাত্র কয়েক বছর হলো শুরু করেছি রাজনীতি। আমি আমার জায়গা থেকেই চেষ্টা করেছি। যতটুকু সাধ্য ছিল, চেষ্টা করেছি যেন ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি। কিন্তু সুযোগটা না পেলে তো কিছু করার থাকে না। হয়তো দলের উপদেষ্টামন্ডলিতে থাকলে বা সেরকম কেউ হলে দায়িত্ব পেতাম। তার পরও সাধ্যমতো করেছি, কিন্তু সুযোগটা আমি পাইনি।
তার পরও কাউকে দোষ দেব না। দায় আমারই। বিশেষ করে, মানুষের যে আবেগ-ভালোবাসার জায়গা ছিল, ক্রিকেটার মাশরাফির প্রতি যে দাবি ছিল, সেটা পূরণ করতে পারিনি এবং সেই দায় মাথাপেতেই নিচ্ছি। আমি ব্যর্থ হয়েছি এবং সেটা আমাকে সেই শুরু থেকেই পোড়াচ্ছে। রাজনীতিবিদ হিসেবে, আমি কিছু করার চেষ্টা করেছি। পারিনি।
অনেকের প্রত্যাশা ছিল, আপনি দলীয় আবরণের বাইরে গিয়ে কিছু বলবেন বা করবেন…
মাশরাফি: দলের বাইরে গিয়ে কিছু করতে হলে আমাকে পদত্যাগ করতে হতো। সেটা যদি করতাম, তাহলে এখন নিশ্চয়ই আমার অনেক প্রশংসা হতো। কিন্তু প্রতিটি সময়ের বাস্তবতা আলাদা থাকে। ওই সময় যদি পদত্যাগ করতাম, তাহলে আরও বড় কিছু হয় কি না, বা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় কি না, এরকম অনেক কিছু ভাবতে হয়েছে। আমি যদি সেই ভাবনাগুলি সব তুলে ধরি, সেটারও পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকবে। কিন্তু সম্ভাব্য পরিণতি বা অনেক দিক ভাবতে হয়েছে আমাকে।
নড়াইলের মানুষের কাছেও আমার দায়বদ্ধতার ব্যাপার ছিল। নড়াইল-২ আসনের মানুষের অনেক আশা আমাকে ঘিরে। তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, নড়াইলকে একটা জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। সেই মানুষগুলোর কাছে কি জবাব দেব? এরকম নানা কিছু ভাবতে হয়েছে।
অনেকেই আমাকে তখন বলেছেন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিলেও দেশের মানুষ খুশি হবে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমার দায়িত্বটা আরও বেশি। আমি যদি ছাত্রদের কাছে যেতে পারতাম, তাহলে হয়তো এটা সমাধান করা বা কিছু করার সুযোগ থাকত। ছাত্ররা যদি আমার আহবানে সাড়া না দিত বা আমাকে গুরুত্ব না দিত, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু নিজের কাছে অন্তত পরিষ্কার থাকতে পারতাম যে, কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছি। সেটা চেষ্টা করেও পারিনি। আগেই বলেছি, ব্যর্থ হয়েছি এবং দায় নিচ্ছি।
আপনার স্ত্রী বা আপনার পরিবার কি আপনার এই ভাবনার সঙ্গে একমত ছিল?
মাশরাফি: শুধু আমি নই, আমার মনে হয়, এই আন্দোলন নিয়ে যা কিছু লিখতে বা করতে পারেনি, তাদের সবাইকেই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে নিজের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে।
আমার মেয়ে হুমায়রা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে। আমার সেখানে অ্যাকাউন্ট থাকলেও সেভাবে দেখতাম না, ওকেও ফলো করতাম না। আমাকে আমার এক ছোট ভাই জানাল যে, হুমায়রা ইনস্টাগ্রামে অনেক কিছু দিচ্ছে বা শেয়ার করছে। ১৭ জুলাই থেকেই দিচ্ছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল, ‘হ্যাঁ, আমি এসব দিচ্ছি। তোমার কি আপত্তি আছে?’ আমি বললাম, ‘না, আমার সমস্যা নেই।’ আমি বরং ওকে এটাও বলেছি, ‘তোমার স্কুল থেকে বা বন্ধুরা আন্দোলনে গেলে তুমিও সঙ্গে থেকো।’ আমার পদের জন্য বা চেয়ারের জন্য তাকে বাধা পেতে হবে, এটা কখনও চাইনি।
স্ত্রী-সন্তানদের কাছেও জবাবদিহিতা করতে হয়েছে, কেন কিছু লিখতে পারিনি। শুধু পরিবার নয়, বন্ধু-বান্ধব, আশেপাশের সবাই জিজ্ঞেস করেছে। আমি আমার অবস্থান বলেছি। কেউ একমত হয়েছে, কেউ হয়নি। তবে মেয়ের কাছে অন্তত এটুকু জায়গা আমার আছে যে, বাবা তাকে আটকায়নি।
দেখুন, কোটা আন্দোলনের যে ছাত্ররা আছেন, বা সমন্বয়কদের একজন, যিনি ক্রীড়া উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন, উনি তো এখন খেলাধুলা নিয়ে কাজ করবেন। এখন যদি তার কোনো সমস্যা হয় বা কোথাও আটকে যান বা বড় কোনো ঘটনা ঘটে, তখন তিনি কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নেবেন বা সিনিয়র কারও সঙ্গে আলোচনা করবেন। তার পর বিবৃতি দেবেন। কারণ, উনি একটি দায়িত্বশীল জায়গায় আছেন। হুট করেই কিছু বলতে বা করতে পারবেন না।
কিন্তু দায়িত্বশীল জায়গাগুলোয় অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়। কিছু সীমাবদ্ধতাও থাকে। হ্যাঁ, ক্রিকেটার মাশরাফির কাছে মানুষের আবেগ-ভালোবাসার দাবি থাকবেই। ক্রিকেটের কারণেই এত ভালোবাসা পেয়েছি। নড়াইলের কৌশিক সংসদ সদস্য হতে পেরেছে সে বাংলাদেশের মাশরাফি হয়েছে বলেই। ক্রিকেটার হিসেবে সেই ভালোবাসার দাবি মেটাতে ব্যর্থ হয়েছি। সংসদ সদস্য হিসেবে চেষ্টা করেছি বড় পরিসরে কিছু করতে। সেখানেও ব্যর্থ হয়েছি। অজুহাত দেওয়ার কিছু নেই।
তার মানে, আপনি মেনে নিচ্ছেন যে অসংখ্য মানুষকে আপনি হতাশ করেছেন?
মাশরাফি: সেটা তো বারবার বলছিই। যা চেয়েছি, তা পারিনি। একটা-দুটি স্ট্যাটাস (ফেইসবুকে) দিলে হয়তো গা বাঁচাতে পারতাম। তার পরও অনেকে সমালোচনা করতেন, অনেকে খুশি হতেন। কিন্তু আমার জায়গা থেকে আরও বড় পরিসরে কিছু করার চেষ্টা করেছি। সেটিও পারিনি। কাজেই ব্যর্থ হয়েছি অবশ্যই।
এই ব্যর্থতার কারণে সামাজিক মাধ্যমে আপনার তুমুল সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি নড়াইলে আপনার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা তো কিছুদিন আগেও অকল্পনীয় ছিল। ক্ষোভ থেকেই কি লোকে আপনার বাড়িতে আক্রমণ করেছে?
মাশরাফি: জানি না… হয়তো একটা ‘মব’-এর মতো হয়েছে এবং হুট করেই উত্তেজিত কিছু লোক এটা করেছে। কারণ, নড়াইলের মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো কিছু আমি করিনি বলেই মনে করি। কেন তারা বাড়িতে হামলা করল, এই কারণ আমিও খুঁজেছি এবং খুঁজছি।
আমার বাড়ির দুয়ার সবসময় সব মানুষের জন্য খোলা ছিল। সংসদ সদস হওয়ার পরও তেমনই ছিল। আমি নড়াইলে গেলে রাত ১টা-২টা পর্যন্ত লোকের ভিড় থাকত বাসায়। আমি রাজনীতিতে আসার পরই জানতাম, সবাই আমাকে ভোট দেবে না বা সবাই পছন্দ করবে না। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর আমি সবারই এমপি। আমি সেভাবেই চিন্তা করেছি এবং কাজ করার চেষ্টা করেছি। আমার আসনে কোনো ভিন্ন মতের কাউকে কখনও দমন করিনি, ভিন্ন পথ আটকাইনি। নড়াইল সদর ও লোহাগড়ায় যেন সব দলের সব মতের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি গত সাড়ে ৫ বছরে। কাজেই লোকের ক্ষোভ থাকার কথা নয়।
কিংবা কে জানে, থাকতেও পারে (ক্ষোভ)। হয়তো সবার কাছে পৌঁছতে পারিনি। লোকে যেভাবে চেয়েছে, সেই প্রত্যাশা হয়তো পূরণ করতে পারিনি। তবে আমার জ্ঞানত, নড়াইলের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু আমি করেছি।
প্রায় ২০ বছর জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলেছি। আমার পরিসংখ্যান বলবে না, আমি দুনিয়ার সেরা বা দেশের সেরা ক্রিকেটার। তবে আমি জানি, চেষ্টা সবসময় করেছি। রাজনীতির মাঠেও আমি এমন বড় কেউ নই। ৫-৬ বছরে কেউ বড় হতে পারেও না। কিন্তু এখানেও চেষ্টার কমতি রাখিনি। আমার চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়া, সব নড়াইল ঘিরেই ছিল। নড়াইলের উপকার নিয়ে কাজ করেছি নিজের পরিবারকে ভুলে।
কাজেই, নিজেও জানি না, কেন আমার বাড়ি পোড়ানো হলো।
আমার বাড়ির কাছেই সভাপতি মহোদয়ের বাড়ি। শুরুতে তার বাড়িতে আক্রমণ করা হয়, গাড়িতে আগুন দেয়। পরে আমাদের বাড়িতে প্রথম ধাপে কেউ কিছু করেনি।
দ্বিতীয় ধাপে কয়েকজন এসে ইট-পাটকেল মেরেছে। তৃতীয় দফায় আরেকটা গ্রুপ এসে বাসায় ঢুকে কিছু ভাঙচুর করেছে। পরের দফায়, মাগরেবের আজানের আধ ঘণ্টা আগে মনে হয়, ওই গ্রুপে যারা এসেছে, তারা ভাঙচুর করে আগুন দিয়েছে।
এখন আর কী বলব, জানি না। সব মিলিয়ে হতাশ তো অবশ্যই। রাজনীতিবিদ হিসেবেও কিছু করতে পারলাম না। নিজের পরিবার, বাবা-মায়ের জন্যও কিছু পারলাম না।
হামলার একটু আগেও আপনার মা সম্ভবত বাড়িতেই ছিলেন…
মাশরাফি: মা কয়েক মিনিট আগেও ছিলেন বাড়িতে। বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পর তো আমার মায়ের আর একটা কাপড়ও ছিল না। এক কাপড়ে বের হয়েছেন।
উনারাও তো আসলে এরকম কিছু বুঝতে পারেননি। বাসায় কয়েকটি ছেলে-মেয়ে থাকে, ওরাই আগে দেখেছে। আপনারা অনেকেই জানেন, এলাকার এতিম-অসহায় কিছু বাচ্চাকে বাসায় রাখেন মা। অনেক বছর আগে থেকেই রাখেন। কারও হয়তো বাবা-মা নেই বা বাবা-মা কেউ বিয়ে করেছে আবার, বাচ্চাকে রাখতে চায় না। এরকম কিছু বাচ্চাকে বাড়িতে এনে রাখেন আমার মা। তাদের পড়ালেখা করাতেন। পরে তারা একটু বড় হয়ে নিজের পথ বেছে নিত। এরকম ৬-৭ জন ছিল বাসায়। ওরাই দেখেছে, সামনে মাঠ থেকে লাঠিসোটা নিয়ে অনেকে আসছেন। ওরাই গিয়ে বাবা-মাকে বলেছে বাইরে চলে যেতে।
ওই বাচ্চাদের ভবিষ্যতও এখন অনিশ্চিত হয়ে গেল। দেখি কী করা যায়… কিছু তো ব্যবস্থা হবেই।
আপনার সব ক্রিকেট স্মারকও তো তাহলে পুড়ে শেষ!
মাশরাফি: আমি তো এমন বড় ক্রিকেটার নই বা এমন নয় যে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তবে যা কিছু পেয়েছি, প্রায় সব ওখানেই ছিল। ঢাকায় কিছু নেই। সব পুড়ে শেষ। এমন নয় যে, স্মারকগুলির প্রতি আমার টান অনেক বেশি ছিল। তবে মাঝেমধ্যে দেখতে ভালো লাগত। অনেক লোকে বাড়িতে যেত এসব দেখতে। সবার জন্যই তো দুয়ার খোলা ছিল। কিছুই আর নেই।
তবে দিনশেষে সান্ত্বনা যে, বাবা-মা অন্তত প্রাণে বেঁচে গেছেন। যা গেছে, কথা বলে লাভ নেই।
এই বাড়ি তো আপনি তৈরি করেছিলেন রাজনীতিতে আসার আগে?
মাশরাফি: এটা ২০১৪ সালে সম্ভবত কাজ শুরু করেছিলাম, ২০১৫ সালে শেষ হয়েছে।
আমার সম্পদ যা কিছু আছে, সব খেলোয়াড়ি জীবনেই গড়া। যে কোনোভাবেই খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। পূর্বাচলে একটি জমি আছে, ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর সরকার থেকে সবাই পেয়েছিলাম ৫ কাঠা করে। মিরপুরে একটা বাড়ি আছে, ২০০৮ সালে আইপিএল খেলে আসার পর করা। মিরপুরে আরেকটি বাড়ি করছি, যেখানে পরিবার নিয়ে উঠব, এটাও ২০১৫ সালে কাজ শুরু করেছি। এখনও উঠতে পারিনি, কাজ চলছে। ২০১৮ সালের পরের আয় দিয়ে তেমন কোনো সম্পদ গড়তে পারিনি।
২০১৮ সালের নির্বাচনের হলফনামা ও ২০২৪ সালের হলফনামা দেখলেই বুঝতে পারবেন। আমি দাবি করলে তো লাভ নেই। যে কেউ খতিয়ে দেখলেই জানতে পারবে।
রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত আমার এন্ডোর্সমেন্ট ছিল অনেক। ২০টির ওপরে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। খেলাধুলা করে ও স্পন্সরশিপের আয় থেকেই এসব করেছি।
নড়াইলের বাড়িটা করেছিলাম মায়ের জন্য। এখন শেষ। অনেকেই বলেছেন মামলা করতে, ব্যবস্থা নিতে। ছবি-ভিডিও সবই আছে অনেকের কাছে। তবে আমি বলেছি, এসব করব না। আমার বাবাকেও বলে দিয়েছি। এখনকার সরকার বা ভবিষ্যতে নির্বাচন করেও যে সরকার আসুক, কারও কাছেই বিচাই চাইব না। কোনো অভিযোগ নেই। খুলনা-যশোর থেকে বা ঢাকা থেকে গিয়ে কেউ এই বাড়ি ভাঙেনি। নড়াইলের কোনো না কোনো জায়গা থেকে উঠে আসা মানুষই পুড়িয়েছে। নড়াইলের মানুষের বিরুদ্ধে বিচার আমি চাইব না। নিজের ভাগ্য মেনে নিয়েছি। হয়তো কোনো ভুল করেছি, সেটার ফল পেয়েছি। কষ্ট আছে অবশ্যই, তবে রাগ-ক্ষোভ নেই কারও প্রতি। আমার প্রতি এখনও কারও ক্ষোভ থাকলে, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
রাজনীতিতে আসার আগে আপনি গোটা দেশে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। এখন নিশ্চিতভাবেই তা নন। এবারের এই আন্দোলনে তো আপনাকে শূলে চড়ানো হয়েছে। আপনি কিছুক্ষণ আগে বলছিলেন যে, নিজের জন্য কিছু করতে পারেননি, পরিবারের জন্যও পারেনি। এখন কি তাহলে মনে হয়, রাজনীতিতে আসা আপনার ভুল ছিল?
মাশরাফি: তখন আমার কাছে মনে হয়নি। বিভিন্ন সময়ের বাস্তবতা আলাদা। এখনও যদি ওই সময়ে ফিরে যাই, একই কথা বলব।
আমি জানতাম, ক্রিকেটার হিসেবে হয়তো সবার আছে আমার গ্রহণযোগ্যতা আছে। রাজনীতিতে নামলে সেটা থাকবে না। কিন্তু ওই চ্যালেঞ্জ আমি নিতে চেয়েছি। মানুষের জন্য বড় পরিসরে কিছু করতে চেয়েছি। এই জায়গায় নিজের কাছে পরিষ্কার ছিলাম।
এখন যে সরকার এসেছে, আমরা যদি আমার জায়গা থেকে, আপনার জায়গা থেকে সমালোচনা করে নিচে নামাই, তাহলে তো এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে। তো, আমি যে জায়গায় ছিলাম, হয়তো রাজনীতিতে না এলেও পারতাম। ভালো ছিলাম। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি।
রাজনীতিতে আসার পর আমার বড় বড় কিছু এন্ডোর্সমেন্ট বাতিল হয়েছে। ২০১৯ বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে যাব, এজন্য আরও বড় কিছু প্রস্তাব ছিল এন্ডোর্সমেন্টের। রাজনীতিতে আসার পর সেগুলোও সরে গেছে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তারা, রাজনীতির সঙ্গে থাকতে চায় না। ৮-১০ কোটি টাকার চুক্তি বাতিল হয়েছে। আমি ওই টাকা নিয়ে অনায়াসেই পরিবার নিয়ে সুখে থাকতে পারতাম। কিন্তু একার ভালো থাকার কথা না ভেবে নড়াইলের কথা ভেবেছি।
নড়াইল তো ‘সি’ ক্যাটাগরির জেলা। কিন্তু আমার চেষ্টা ছিল ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলার সুযোগ-সুবিধা যেন নড়াইলের মানুষকে দিতে পারি। সেই চেষ্টাকে এতটা আবেগ দিয়ে, এতটা মরিয়া হয়ে করেছি… আমি অন্তত জানি, সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করেছি। ২০১৮ সালের নড়াইল আর এখনকার নড়াইলের তুলনা করলেই সেটা বোঝা যাবে। আশা করি নতুন সরকার তা চলমান রাখবে।
রাজনীতিতে এসে ভুল করেছি, এটা তাই বলব না। ভুল করে থাকলে হয়তো নিজেরই ক্ষতি করেছি। তবে আমার ভেতরে কোনো খেদ কখনও কাজ করবে না। কারণ, নিজের চিন্তাটা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল।
এখন আপনার কি ভাবনা? মানে, আপনি তো প্রথাগত মাঠের রাজনীতিবিদ নন বা ছিলেন না। এখন রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ কি?
মাশরাফি: ভবিষ্যতের কথা তো ভেবেছি অনেক। জানি না, সামনে কী করব।
আমি কখনও কোনো ব্যবসা করিনি সেভাবে। আমার ছোট ভাইয়ের একটি ফ্যাশন হাউজ আসে, সেটাও বেশ আগে থেকে। এছাড়া আমার পরিবারের কেউ ব্যবসা করে না। এখনও আমার মূল পেশা ক্রিকেট খেলাই। রাজনীতি ছিল প্যাশন, নড়াইলের জন্য করার চেষ্টা করেছি।
যে কাজগুলি নড়াইলে করেছি বা চলমান আছে, তালিকা ধরে যদি এগোতে থাকেন… অনেক কিছুই দেখতে পাবেন।
গত ৫-৬ বছরের দুই বছর তো কোভিডেই চলে গেছে। তার পরও যদি দেখেন, সড়কে ফোর লেনের কাজ চলছে। নদী ভাঙনের এলাকা আমাদের। সেখানে ৩০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। কিছু কাজ জরুরি ভিত্তিতে হয়েছে। পল্লী অবকাঠামোর রাস্তার কাজ হয়েছে ২০০ কোটি টাকার। নড়াইল জেলা পল্লী অবকাঠামো উন্নয়নের ২৫০ কোটি টাকার কাজের অনুমোদন হওয়ার পর ৩৪ কোটি টাকার মতো টেন্ডার হয়েছে। হাসপাতাল ছিল ১০০ শয্যার। সেটা ২৫০ শয্যা করা হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ১০টি আইসিইউ বেড নেওয়া হয়েছে। লোহাগড়া হাসপাতাল ছিল ৩১ শয্যার। সেটাকে চার তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ৫০ শয্যা করা হয়েছে।
দেশের ২৯-৩০ টি পৌরসভায় এমজিএসপি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। আমার আসনের দুটি পৌরসভা সেখানে ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অনুমোদন হয়ে টেন্ডার হয়েছে। কাজ শুরু হয়নি। আইটি ট্রেনিং সেন্টারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। আরও আছে অনেক।
একটা বিশ্ববিদ্যালয় বাকি ছিল। সবশেষ যে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব গেছে, এর মধ্যে নড়াইল ছিল। এসএম সুলতানের নামে আমরা করতে চেয়েছিলাম।
আমি চেষ্টা করেছি। আশা করি, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সরকার সেসব চলমান রাখবে।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ?
মাশরাফি: আমি তো আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলি না। বিপিএল খেলি আর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলি। ভেবেছিলাম, আর এক মৌসুম খেলে হয়তো বাদ দেব। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে আদৌ বিপিএল হয় কি না, বা ঢাকা লিগ হয় কি না, কে জানে। সময় হলে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেব।
ক্রিকেট বোর্ডে বা ক্রিকেটে কোনোভাবে সম্পৃক্ত থাকার সম্ভাবনা আছে?
মাশরাফি: আমি সংসদ সদস্য হওয়ার পর খেলা বাদ দিয়ে ক্রিকেট বোর্ডে যাইনি সাধারণত। নিজের কথা আসলে ভাবিনি। যে জায়গায় আমি ছিলাম, হয়তো ওপরের মহলে গিয়ে বলতে পারতাম যে ক্রিকেটে এই কাজটা করতে চাই বা ওই দায়িত্ব নিতে চাই। কিন্তু নিজের কথা বলতে চাইনি কখনোই।
যখন বলার সুযোগ ছিল, তখনই বলিনি। এখন যে পরিস্থিতি, আমার কাছে মনে হয়, ক্রিকেট বোর্ডে থাকা বা এরকম কোনো দায়িত্ব আমার প্রাপ্য নয়। আমি দাবিও করতে পারি না।
যখন রাজনীতিতে ছিলাম, ক্রিকেট বোর্ডে থাকার চেষ্টা করিনি। এখন রাজনীতিতে নেই, এখন যদি বোর্ডে থাকার চেষ্টা করি বা থাকতে চাই, তাহলে কেমন হয়ে যায় না!
যদি ছোট কোনো প্ল্যাটফর্মে সুযোগ আসে, সেই জায়গা থেকে চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু বড় পরিসরে বা বোর্ডে গিয়ে বলব, ‘এখন কাজ করতে চাই ক্রিকেট নিয়ে’, এটা অনেকটা সুযোগসন্ধানী ব্যাপার হয়ে যাবে। এই জায়গা থেকে আমার মনে হয়, এটা আমার প্রাপ্য নয়।
হ্যাঁ, ক্রিকেট আমার রক্তে আছে। কেউ কখনও সহায়তা চাইলে অবশ্যই পাশে থাকব। কিন্তু বোর্ডে থাকার বাস্তবতা এই মুহূর্তে আমার নেই। ডিজার্ভও করি না।