মিশিগানের খবর
মিশিগানের দেয়ালজুড়ে বাংলাদেশ
Published
3 months agoon
৫৫ ফুট প্রস্থ আর ৪৬ ফুট উঁচু এক দেয়ালে আলোকিত হয়ে আছে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা আর বহুজাতিক এক বাস্তবতায় সগৌরবে শোবা পাচ্ছে লাল সবুজের রঙে আঁকা সর্ববৃহৎ এক ম্যুরাল। বিশাল দেয়ালজুড়ে রক্তে পাওয়া বাংলা বর্ণ—অ-আ-ক-খ। সাথে বাংলাদেশের পতাকা জড়ানো বাংলার চিরায়ত কিশোরীর হাসিমাখা মুখের মায়াবী চাহনি। তার কালো চুলে আলোয় রাঙানো দুটি শ্বেত শাপলা। পতাকার লাল সবুজের সাথে মিশে গেছে আমাদের ঐতিহ্যের চা-বাগান, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক শাপলা। সেই সঙ্গে স্থান পেয়েছে বায়ান্নের আবেগজড়িত শহীদ মিনার।
জন্মভূমি থেকে তের হাজার তিনশো কিলোমিটার দূরে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যে এভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে লাল সবুজের রঙে আঁকা ম্যুরাল ‘বাংলাদেশ: কামিং টু আমেরিকা’। বাংলাদেশি অধ্যুষিত ডেট্রয়েট ও হ্যামট্রাম্যাক শহরের সীমানায় যে কারোরই চোখ আঁটকে যায় বৃহৎ এই দেয়ালচিত্রে।
২০১৮ সালের ২১শে অক্টোবর ‘ওয়ান হ্যামট্রাম্যাক’ নামের সংগঠনের উদ্যোগে মেক্সিকোর খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ভিক্টর কুইনোনেজ সর্ববৃহৎ এই ম্যুরালটি অঙ্কন করেন। বাংলাদেশিদের অস্তিত্বের জানান দেয়া এই দেয়ালচিত্র গড়ে তোলার নেপথ্যে ছিলেন প্রয়াত আবু হানিফের পরিবার। প্রযুক্তিবিদ আবু হানিফ বাংলাদেশিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে এমন একটা শিল্পকর্মের মাধ্যমে সামনে আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে বাস্তবায়নের দুই বছর আগেই মারা যান স্বপ্নদ্রষ্টা এই মানুষটি। বাবার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে আসেন দুই মেয়ে সুবাহ হানিফ ও ফারাহ হানিফ। ৫৬ হাজার ডলার ব্যয়ে নির্মিত জন্মভূমি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা এই ম্যুরাল বাস্তবায়নে যুক্ত হন বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই। কার্পেন্টার এভিনিউয়ের ব্রিজ একাডেমি মাধ্যমিক স্কুলের বিশাল দেয়ালজুড়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত চিত্রকর্মটির ৫৬ হাজার ডলার ব্যয়ের অর্ধেক বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে উঠে আসে। বাকি অর্থ আসে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিল মায়ার (প্রজেক্ট ডিরেক্টর), মাইক ডুফফি, শ্যারন ফিল্ডম্যান, আবু হানিফ, টায়লা মায়ার, কামাল রহমানসহ নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি আমেরিকানরা মিলে গঠিত হয় কমিটি। দফায় দফায় মিটিং, ম্যুরালের জন্য স্থান নির্ধারণ, ইতিহাসের ছবি নির্বাচন, অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব কিছু নিয়ে অনেক বেগ পেতে হয়েছে এই কমিটিকে। পুরো এক সপ্তাহ অবিরাম কাজ করে চলে ‘মার্কা২৭’। শেষদিকে প্রতিদিন ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় চিত্রকর্মে ব্যস্ত সময় পার করেন তারা।
অবশেষে অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিশাল দেয়ালজুড়ে বিদেশের মাটিতে জন্ম দেন ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাংলাদেশ। পরেরদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটি, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মিশিগান অঙ্গরাজ্যের অফিশিয়াল ডেলিগ্যাটরা উপস্থিত ছিলেন। তবে বাঙালির ঐতিহ্য, ভাষার স্তম্ভ, জাতীয় প্রতীক আর তাজা রক্তে পাওয়া বর্ণ নিয়ে স্থাপিত ম্যুরালের অন্যতম কারিগর ছিলেন মার্কিন নাগরিক বিল মায়ার। ভিন্ন দেশ আর ভাষার মানুষ হয়েও প্রকল্প বাস্তবায়নে বিল মায়ারের পরিশ্রম আপ্লূত করে সবাইকে। ভিনদেশি এই মানুষটি দিনের পর দিন স্বপ্নের পথে নিজেকে উজাড় করে হয়ে উঠেছিলেন আপাদমস্তক এক বাঙালি যেন।
এদিকে শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের তৈরি ম্যুরালের মধ্যে এটিই সবথেকে বড় বলে জানা গেছে। প্রবাসে বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্যকে বহমান রাখতে এই ম্যুরাল অসামান্য অবদান রাখবে বলে মনে করেন বাংলাদেশি-আমেরিকানরা। নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে কেউ ঘুরতে আসলে ছুটে যান দেয়ালজুড়ে একখন্ড এই বাংলাদেশকে দেখতে। তাছাড়া দেশ থেকে মিশিগানে নতুন আসা অনেকেই ৩১০৫ কার্পেন্টার অ্যাভিনিউয়ের বাংলাদেশ দেখতে ছুটে যান।
তবে এমন সব ইতিহাসে প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কতটুকু তা দেখার প্রয়োজন আছে বলে জানান স্থানীয়রা। তাছাড়া এই দেয়ালচিত্র এখানকার বাংলাদেশি অভিবাসীদের মর্যাদার প্রতীক বলে মনে করছেন স্থানীয় মার্কিনীরা। বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করা এই ম্যুরাল এখানে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের কাছে অস্তিত্বের স্মারক। ছয় বছর ধরে ‘বাংলাদেশ: কামিং টু আমেরিকা’ ম্যুরালটি অভিবাসীদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জন্মভূমির অস্তিত্ব, মাতৃভূমির পরশ।