Connect with us

নিউইয়র্ক

নিয়ন্ত্রণহীন দাবানল, পুড়ছে হলিউড

Published

on

পালাচ্ছেন বাসিন্দারা | ৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ পুড়েছে | থেমে নেই লুটপাট

যেদিকে দুচোখ যায় খালি আগুন আর আগুন। আগুনের খ্রীপতায় পুড়েছে বাড়ি, ঘর, আসবাবপত্রসহ সব কিছু।
আগুনের লেলিহান শিখার চারপাশটা জুড়ে কেবল এখন তেজি শব্দ আর সাইরেনের শব্দ।
কালো ধোঁয়ায় অন্ধকার আকাশে চক্কর দিচ্ছে একের পর ফায়ার সার্ভিসের হেলিকপ্টার। দিক বেদিক হয়ে ছুটে চলেছে মানুষ। বাপ দাদার আমল থেকে কেউ বা বাস করছেন এখানে কারো বা সবে ভিটে বাড়ির বসতি। স্বপ্ন আর সাধের সব কিছু হারিয়ে কেবল

অনিশ্চয়তা আমনে। সবার চেহারায় অজানা আশঙ্কা। কোথায় যাবেন, জানেন না অনেকে।
এ চিত্র এখন ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের। একশো বছর তো বটেই ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানলের কবলে এখন এ শহর , মাইলের পর মাইল খালি পোড়া গন্ধ।
বিশ্ব খ্যাত বিনোদন জগতের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লস অ্যাঞ্জেলেসে এ দাবানলের সূত্রপাত হয় মূলত গত মঙ্গলবার। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সেখানে সবমিলিয়ে ছয়টি আলাদা দাবানল সৃষ্টি হয়েছে।
দাবানল যখন জ্বলছে তখন এর ওপর আবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রচণ্ডগতিতে বয়ে চলা ঝড়। ঝড়ো হাওয়া বাতাসে আগুনের গতিবেগ যেন দ্রুত গতিতে বাড়ছে। শত উপায়ে নিভছে না। এখন পর্যন্ত দাবানলে ঝড়েছে তরতাজা ৫টি প্রাণ। এক নিমিষে আগুনে পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বহুমূল্যের ঘর ও গাড়ি। এরই মধ্যে ক্ষতি হয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের।
লস অ্যাঞ্জেলেসের ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর জানিয়েছে, আলাদা ছয়টি দাবানলের মধ্যে তিনটি নিয়ন্ত্রণের পুরোপুরি বাইরে চলে গেছে। বাড়ি ঘর সহায় সম্পদ পুড়ে গেলেও প্রাণে বাঁচতে এরই মধ্যে ১ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি বাসিন্দাকে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজনে সময় আরও বাড়ানো হতে পারে।
এদিকে , দাবানল ছড়িয়ে পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে আগুনের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা গেছে অভিজাত এলাকা প্যাসিফিক প্যালিসেইডসে। সেখানে ১৫ হাজার ৮৩২ একর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। এই এলাকার একটি বাড়িতে ১৯৭৯ সাল থেকে বসবাস করে আসছেন হলিউডের তারকা অভিনেতা বিলি ক্রিস্টাল। আগুনে সেটিও পুড়ে গেছে। আগুন ছড়িয়েছে হলিউড হিলসেও।
অন্যদিকে, বুধবার সন্ধ্যায় হলিউড হিলসে নতুন করে আগুন লাগে, যা হলিউড বুলেভার্ড থেকে মাত্র কয়েকশ মিটার দূরে অবস্থিত। যেখানে গ্রুম্যানস চাইনিজ থিয়েটার, ওয়াক অফ ফেম ও এল ক্যাপিটান থিয়েটারের মতো দর্শনীয় স্থান আছে।
পরিস্থিতি সামলাতে ঐতিহাসিক এলাকাটির কিছু সড়ক খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কারণ দমকলকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটাচ্ছিলেন।
এলএএফডির মার্গারেট স্টুয়ার্ট বলেন, ‘আমাদের সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। আমরা চাই না মানুষ আটকে থাকুক। আমরা চাই সবাই নিরাপদে বেরিয়ে আসুক।’
সাধারণ শহরবাসীর পাশাপাশি আগুনে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন বিনোদনজগতের আরও অনেকে। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। যেমন টেলিভিশনে নিজের বাড়ি আগুনে পুড়তে দেখেছেন অভিনেত্রী প্যারিস হিলটন। তিনি জানান,‘আমার মন ভেঙে গেছে।’ আর অস্কারজয়ী অভিনেত্রী জেমি লি কার্টিস ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘আমার এলাকায়, সম্ভবত আমার বাড়িতেও আগুন লেগেছে। আমাদের জন্য প্রার্থনা করবেন।’
লস অ্যাঞ্জেলসে ছিলেন নোরা ফতেহিও। ভয়ংকর অবস্থায় তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি জানান যে কয়েকমিনিটের নোটিসে তাঁকে সেই বাসস্থান ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। নোরা জানান যে তিনি খুবই ভয় পেয়ে যান। তিনি জানান যে ‘এখানে ভয়ংকর অবস্থা। আমি কখনও আগে এরকম অবস্থার সম্মুখীন হইনি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজের যাবতীয় জিনিস গুছিয়ে আমি ওখান থেকে বেরিয়ে যাই’।
অন্যদিকে বাড়ি থেকেই দাবানল দেখে আতঙ্কিত প্রিয়াঙ্কা। অস্কার, এমি ও গোল্ডেন গ্লোবজয়ী অভিনেত্রী জেমি লি কার্টিস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছেন, তাঁর পরিবার নিরাপদ, কিন্তু তাঁদের বাড়ি রক্ষা পায়নি। তিনি উদ্ধারকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
সংগীতশিল্পী ও অভিনেত্রী ম্যান্ডি মুর ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, আগুন থেকে বাঁচতে তিনি তাঁর সন্তান ও পোষ্যদের নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। দাবানল ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আগেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন তিনি। একই অবস্থা ‘স্টার ওয়ারস’ তারকা মার্ক হ্যামিলের। প্যাসিফিক প্যালিসেডসের দাবানলে পুড়েছে অভিনেতা স্পেনসার প্র্যাটের বাড়িও।
মালিবুতে প্যারিস হিলটনের বাড়ি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। নেটপাড়ায় ছবি প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, ‘এই অভিজ্ঞতা যেন আর কারও না হয়।’ তিনি আরও জানান, এই বাড়িতে অনেক মূল্যবান স্মৃতি ছিল তাঁর। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছে সব। তাঁর পরিবারের সদস্য ও পোষ্যদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ‘দ্য প্রিন্সেস ব্রাইড’ ছবির অভিনেতা ক্যারি এলওয়েসের বাড়িও পুড়ে ছাই। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে রয়েছেন পরিবারের অন্যরা। অভিনেতা বিলি ক্রিস্টালের বাড়িও পুড়ে গেছে। প্যাসিফিক প্যালিসেডসের বাড়িতেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন তিনি। অনেক দিন ধরেই সেই প্যাসিফিক প্যালিসেডসের বাসিন্দা ব্রিটিশ অভিনেত্রী কেট বেকিনসল।
থমকে গিয়েছে হলিউডের কাজও। পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে অস্কারের মনোনয়নের ভোটদানের সময়ও। দাবানলের কারণে লস অ্যাঞ্জেলেসে পূর্বনির্ধারিত বেশ কয়েকটি সিনেমার প্রিমিয়ার স্থগিত করা হয়েছে। এসব সিনেমার মধ্যে আছে ‘আনস্টপেবল’, ‘উলফম্যান’, ‘বেটার ম্যান, ‘দ্য পিট’, ‘দ্য লাস্ট শোগার্ল’ ইত্যাদি। বাতিল হয়েছে একাধিক শ্যুটিং।
লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি ফায়ার চিফ অ্যান্থনি ম্যারোন বলেছেন, ‘আমাদের কর্মীরা বিপর্যয় মোকাবিলায় লড়াই করছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তবে পরিস্থিতি সামলাতে লস অ্যাঞ্জেলেসে পর্যাপ্ত ফায়ার কর্মী নেই।’
লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলের ভয়াবহতা স্যাটেলাইটে ধারণ করা ছবিতেও স্পষ্ট হয়েছে। স্থানীয় কেটিএলএ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা ভিডিওতে দেখা গেছে, ধোঁয়ায় ছেয়ে আছে এলাকার পর এলাকা। হঠাৎ করে ধোঁয়া ভেদ করে বেরিয়ে আসছে আগুনের শিখা। অর্থাৎ নতুন কোনো বাড়িতে আগুন লেগেছে।
আগুনে এখন পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রায় দুই হাজার অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে শতকোটি ডলারের বাড়িও রয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অন্তত ৩ লাখ ১১ হাজার বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দাবানলে এখন পর্যন্ত ৫০ বিলিয়ন (৫ হাজার কোটি) ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছে আবহাওয়াবিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট অ্যাকুওয়েদার।
অ্যাকুওয়েদারের প্রধান আবহাওয়াবিদ জোনাথন পোর্টার বলেন, সামনের দিনগুলোতে আরও অবকাঠামো আগুনে পুড়ে যেতে পারে। এমনটি হলে অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক দিয়ে এই দাবানল ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হতে যাচ্ছে। এই আগুনের ফলে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, লোকজন চাকরি হারাবে, আর ধোঁয়ার প্রভাবে চিকিৎসা খরচ বাড়বে।
আগুনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একজন আল্টিডিনা এলাকার ৬৬ বছর বয়সী ভিক্টর শ। তাঁর বোন শারি শ গণমাধ্যমকে বলেন, নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশনা কানে তোলেননি ভিক্টর। পরে বাড়ির ভেতর থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এই এলাকার আরেক বাসিন্দা উইলিয়াম গঞ্জালেস বেঁচে ফিরেছেন। তবে তাঁর বাড়িটি পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমার সব স্বপ্ন আগুনে জ্বলে গেছে।’
এদিকে দাবানলে বিপর্যস্ত লস অ্যাঞ্জেলেসে লুটপাটের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় বোর্ড অব সুপারভাইজারসের প্রধান ক্যাথরিন বার্জার বলেন, অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। দুর্বৃত্তরা পরিত্যক্ত ওই বাড়িগুলোয় লুটপাট চালাচ্ছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। লুটপাটে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের। লস অ্যাঞ্জেলেসের ফায়ার সার্ভিসের প্রধান অ্যান্থনি ম্যারন বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগুন নেভাতে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ছয় অঙ্গরাজ্য থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ক্যালিফোর্নিয়ায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ২৫০টি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এবং ১ হাজার সদস্য দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় গেছেন।
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির পাশাপাশি হেলিকপ্টারও আগুন নেভানোর কাজে মাঠে নেমেছে। অ্যান্থনি ম্যারন বলেন, ‘আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করছি। তবে লস অ্যাঞ্জেলেসের ফায়ার সার্ভিসের সব বিভাগ মিলেও এই আগুন নেভানোর মতো যথেষ্ট সংখ্যক কর্মী নেই।’
আগুন নেভানোর কাজে নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে পানি। কারণ, গত কয়েক মাস ধরে ক্যালিফোর্নিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃষ্টি হয়নি। ফলে প্যাসিফিক প্যালিসেইডস এলাকার কিছু হাইড্রেন্ট (আগুন নেভানোর জন্য পানি সরবরাহ পাইপ) শুকিয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা জেনিস কুইনোনেস বলেন, শহুরে পানি সরবরাহব্যবস্থা দিয়ে দাবানল নেভাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন তাঁরা।
ক্যালিফোর্নিয়ার পানি সংকট নিয়ে দারুন চটেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি বলেন, ক্যালিফোর্নিয়ার সরকার একটি অযোগ্য সরকার। এই পানিসংকটের কারণে আগুন নেভানোয় বাধা আসছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আগুন নেভাতে যা যা দরকার সব করবে সরকার।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending