বিশেষ আয়োজন
‘দ্য ভেনচারার’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার
Published
5 months agoon
লন্ডন থেকে গিলবার্ট থমাসের সম্পাদনায় ‘দ্য ভেনচারার’ ছোটকাগজের ১৯২১ সালের একটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। এতে তৎকালীন ভারতের অসহযোগ আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধী, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এবং শান্তিনিকেতন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বেশ কিছু দিক উঠে এসেছে। ‘দ্য ভেনচারার’-এর সেই প্রকাশনাটিতে সাক্ষাৎকারটি কে নিয়েছেন তার উল্লেখ নেই। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পত্রিকাটি সংগ্রহ করে বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের এ সাক্ষাৎকারটি প্রথমবারের মতো অনুবাদ করেছেন তুহিন দাস
এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক পোর্ট্রেট, যার সব তার মতোই! সম্ভবত তিনিই সেই মানুষ যিনি নিজের ক্যানভাসগুলো থেকে আপনাকে অভিবাদন জানাতে নেমে আসেন। তিনি তার লেখার মাধ্যমে পশ্চিমকে যে বার্তা ও গান দিয়েছেন সে কথা আমি ভাবছিলাম—‘গীতাঞ্জলি’র সুবাস, ‘ডাকঘর’-এর সাধারণ অনুভূতিমালা আমার মনে জেগে উঠেছিল, কিন্তু যখন তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন, মানুষটির ব্যক্তিত্ব নিজেই তার কাজের প্রতিটি স্মৃতিকে ডুবিয়ে দিলেন যেন।
ভারতে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে আমি তার মতামত জানতে চাইলাম। খানিকটা উচ্চৈঃস্বরে কিন্তু ক্লান্ত কণ্ঠে, খুব সামান্য বাঁক নিয়ে ও খুব কমই বিরতি দিয়ে তিনি একটানা তার বাণী ঢেলে গেলেন। কণ্ঠস্বরটি প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা কোনো মানুষের অবসাদকে যেন অগ্রাহ্য করে; যা তার ভারকে উপেক্ষা করার জন্য খুব সংবেদনশীল, আবার সমর্পণের জন্য খুব শক্তিশালী। কিন্তু প্রায় সময়ে উদ্দীপনা, হাস্যরস, এমনকি লুকোনো এক নিন্দাবাদ তার অতিশয় দয়ালু চোখের গভীর জুড়ে জ্বলজ্বল করে।
“আজকের দিনের এই আন্দোলন? এটা বিস্ময়কর। আমি এর নামটিকে পছন্দ করি না। আমি এর সমস্ত প্রবণতার সঙ্গে একমত নই। অসহযোগের অর্থ হলো—অন্তত কিছু—বিচ্ছিন্নতার আকাঙ্ক্ষা, শুধু ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় থেকে নয়, বরং পশ্চিমের সমগ্র সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং এটি অগ্রগতির সম্ভাবনার জন্য ক্ষতিকর হবে। যদিও নিঃসন্দেহে এমন কিছু লোক আছে যারা পশ্চিমা বস্তুবাদের অশ্লীল অসারতা নিয়ে বিরক্ত এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বাসঘাতকতায় মোহভঙ্গ হয়ে আমাদের মধ্য থেকে আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের মূলোৎপাটন করতে চাইবে। এই সংস্কারবিরোধীরা কেবলমাত্র পশ্চিমের কাছ থেকে আমরা যে গুরুতর মন্দ পেয়েছি তাকেই চিহ্নিত করে, কিন্তু ভারতীয় চেতনার ব্যাপক সহনশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতার বৈশিষ্ট্য বিশেষায়িত করে না। আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতি ছাড়া উন্নতি করতে পারি না, পশ্চিমও অবশ্যই আমাদের ছাড়া অগ্রসর হতে পারে না। জাতীয় আন্দোলন, যাকে ভুল করে বলা হচ্ছে ‘অসহযোগিতা’, আসলে তা নয়, এটি জাতীয় জীবনের একটি মহান পুনর্গঠন এবং এর পেছনে সমস্ত শ্রেণির জনগণ রয়েছে; কেবলমাত্র কিছু স্পর্শকাতর ব্যক্তি আর যারা বিজাতীয়কৃত শিক্ষার শিকার, তারা পাশে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।”
“আমার কাছে যা খুব চমৎকার, যা খুব স্পর্শকাতরভাবে সুন্দর ও আমাদের মানুষের মৌলিক আধ্যাত্মিকতার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, গান্ধীর প্রতি তাদের ভক্তি। সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সূক্ষ্মতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষিত বাগ্মীতা, যা একজন সফল আধুনিক রাজনীতিবিদের থাকে সেসব তাদের কাছে বৃথা। তারা গান্ধীকে দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে কেবল একটিমাত্র কারণে যে, তারা তাকে একজন সন্ত বা পবিত্র ব্যক্তি বলে বিশ্বাস করে। একজন সাধুকে অনুসরণ করার জন্য নানান সম্প্রদায়, মেজাজ ও আদর্শের একটি পুরো দেশকে হাত মেলাতে দেখা একটি আধুনিক অলৌকিক ঘটনা এবং এটা শুধু ভারতেই সম্ভব। আমি অনেক বিষয়ে গান্ধীর সঙ্গে একমত নই, কিন্তু আমি তাকে পরম শ্রদ্ধা ও প্রশংসা করি। তিনি শুধু ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষই নন, তিনি আজ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। আন্দোলনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফলগুলোর মধ্যে একটি হলো এটি কার্যত মদপান ব্যবসাকে ধ্বংস করেছে। এটা জানতে পারা অসাধারণ যে, যারা মদপানের অভ্যাসের জন্য প্ররোচিত ও প্রলুব্ধ হয়েছে তারা কীভাবে শুধুমাত্র গান্ধীর কথায় তা ছেড়ে দিয়েছে। বদ্ধ মাতালরা গান্ধীর প্রতি তাদের ভক্তির মাধ্যমে যে কোনো প্রকারে মদকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার শক্তি খুঁজে পায়। তারা সাদামাটাভাবে বলে যে, ‘মহাত্মা গান্ধী এটা নিষেধ করেছেন’ এবং সারা জীবনের মন্দ শেকলগুলো ভেঙে যায়। রাজস্বের একটি ফলপ্রসূ উৎসের এই পাইকারি দমনে সরকার অত্যন্ত বিরক্ত, ভান করছে যে, কিছু রাষ্ট্রদ্রোহী প্রভাব রয়েছে এবং অনেককে নির্যাতন করছে। কিন্তু জনগণ কিছু মনে করবে না, গান্ধীর জন্য ও ভারতের মুক্তির জন্য তারা উল্লাস করে কারাগারে যাবে।”
আমি রবীন্দ্রনাথকে তার নিজের কাজ সম্পর্কে কিছু বলতে বলেছিলাম এবং তিনি তার কথা চালিয়ে গেলেন:
“বর্তমানে, আমি শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নিয়ে সম্পূর্ণভাবে ব্যস্ত। আপনি জানেন, আমি বিশ বছর আগে একটি ছোট্ট বিদ্যালয় হিসেবে একে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। বছরের পর বছর ধরে ভবন ও সরঞ্জামাদি যোগ করা হয়েছে, এখন এর খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এর রক্ষণাবেক্ষণ কোনো একক ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের সামর্থ্যের বেশ বাইরে।”
“সমতার শর্তে সহযোগিতা হলো চলমান যুগের মহান বার্তা। সকল মানুষের যৌথতা ভবিষ্যতের সভ্যতার মূল মন্ত্র।”
“যে দেশগুলো অহংকার বা লোভের বশবর্তী হয়ে যুগের মন্ত্রকে স্বীকার করতে অস্বীকার করে তারা পদযাত্রা থেকে ছিটকে পড়বে এবং মরুতে নিঃশেষিত হবে। এখন আমাদের সম্মুখে সংকটটি হলো একটি একক দেশের—যেটি নিজেই একটি বিশ্ব, যেখানে সম্প্রদায়গুলোকে এককভাবে নিজেদের আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা খুঁজে পেতে হবে এবং সংঘের বন্ধনেও একত্রিত হতে হবে। এই লক্ষ্যে, প্রত্যেককে অবশ্যই অন্য সকলের উপহার ও সামর্থ্যের প্রশংসা করতে হবে। প্রাচ্যকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে শিখতে হবে, পশ্চিমকেও পূর্বকে বুঝতে শিখতে হবে।
পশ্চিমাদের দ্বারা পূর্বের দেশগুলোর নির্মম বাণিজ্যিক ও সামরিক শোষণের কারণে এ পর্যন্ত প্রাচ্য পাশ্চাত্য থেকে নৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল।
এই বিচ্ছেদ উভয়ের জন্য গভীর আঘাতের। যদি না আমরা যে যুদ্ধ থেকে সবেমাত্র বেঁচে গেছি তার চেয়েও ভয়ানক এবং ব্যাপক একটি বিশ্ব বিপর্যয়ে অসীমভাবে ধ্বংস হয়ে যাই। কিছু সংশোধনের উপায় কিছু সহযোগিতার উপায় প্রদান করা আবশ্যক। এটি অর্জন করতে পূর্ব ও পশ্চিম মানবতার মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া প্রচারের অন্যতম সেরা উপায় হিসেবে কলকাতা থেকে প্রায় নব্বই মাইল দূরে শান্তিনিকেতনে আমি একটি দুর্দান্ত আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন শুরু করেছি। এটা আমার পরিকল্পনা যে, সেখানে বিশ্বের সমস্ত প্রান্ত থেকে ছাত্রদের আমাদের দর্শন, শিল্প, সংগীত ও বিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলো তাদের শ্রেণিগত পরিবেশে অধ্যয়ন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে নিযুক্ত অধ্যাপকদের অধীনে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাবে। ইংল্যান্ডে, আমেরিকায়, জার্মানিতে এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়েছে যারা প্রতিটি জাতির বিশেষ সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা সংরক্ষণ করে ও তাদের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের মননের ও অর্জনগুলোর বিভিন্ন দিকগুলো বিশ্বের কাছে উন্মোচিত হয়। আমাদের নিজস্ব অমূল্য ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে ও সব মানুষের লাভের জন্য দায়বদ্ধ ভারতে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন। আমার অভিপ্রায় হলো তহবিল বৃদ্ধি করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ততটুকু সম্প্রসারিত করা যতক্ষণ না এটি প্রাচ্যের সংস্কৃতির সম্পূর্ণ পরিসর—আর্য, মঙ্গোলিয়ান, সেমেটিক ও অন্যান্যকে ধরতে পারে।”
“আমার আকাঙ্ক্ষা শান্তিনিকেতন এমন একটি ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হবে যেখানে প্রাচ্য ও পশ্চিমের সেরা মননরা একটি নতুন বিশ্বসভ্যতা গড়ে তুলতে যৌথভাবে কাজ করবে এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বশিক্ষা ও ফেলোশিপের কেন্দ্রে পরিণত করতে আমাকে সাহায্য করবে। আমি সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়া পশ্চিমা কমরেডদের সহযোগিতাকে স্বাগত জানাই।”