Connect with us

বিশেষ আয়োজন

নিউ ইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

নিউ ইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

এ বছর আয়োজিত হতে যাচ্ছে ৩৩তম নিউ ইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা। টানা ৩২ বছর ধরে নিউ ইয়র্কের মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ বইমেলাটি তার জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে আসছে। সচরাচর সে অনুযায়িই সাজানো হয় তার কর্মসূচি।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও আদর্শ তুলে ধরতেও থাকে নানা আয়োজন। প্রতি বছর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত বই প্রতিটি স্টলে রাখতে উৎসাহিত করা হয়।
আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপনের জন্য বেশ কয়েক বছর শিশু-কিশোর মেলার আয়োজন করেছি। এই অনুষ্ঠানটি শিশু-কিশোরদের পরিকল্পনায়, অংশগ্রহণে এবং সর্বোপরি তাদের নেতৃত্বেই আয়োজিত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ২০২০ বইমেলায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। পৃথিবীব্যাপী কভিড মহামারীর জন্য সে বছর আমরা অনলাইনে বইমেলার আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার ওপর দায়িত্ব পরেছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের উপর বিশিষ্টজনদের ৩০ মিনিটের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তা অনলাইনে সম্প্রচার করা। কাজটা প্রথমে সহজ মনে হলেও সেটা বাস্তাবায়ন করতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়েছিল।
প্রথমত আমি তিনজন বিশিষ্টজনকে খুঁজে বের করি, যারা এককালে বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে জেনেছেন এবং তাঁর কর্মাবলী পর্যবেক্ষণ করেছেন। আমি অতি সহজেই এই রকম তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে পেয়ে যাই। তাঁরা হলেন সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক রাফিকুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব এবং আওয়ামীলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। এই তিনজন আমারও ঘনিষ্ঠজন।
তিনজনকে টেলিফোনে টকশোতে আমন্ত্রণ জানালে তাঁরা আনন্দের সাথে রাজি হলেন। পূর্বে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ থাকলেও বিগত বছরগুলোতে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। অনুষ্ঠানটির জন্য তিন দেশ আমেরিকা, বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যকে জুমের মাধ্যমে সংযুক্ত করতে হবে। আমাদের বইমেলার প্রযুক্তিবিশারদ স্নেহভাজন আকাশ আমাকে আশ্বস্ত করল—কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল তিন দেশের সময়ের পার্থক্যে। ভিন গোলার্ধের তিনজনকে এক সময়ে পাওয়া নিয়ে। গাফফার ভাই এবং রফিক স্যার বয়স্ক মানুষ এবং তাঁরা দুজনেই অসুস্থ। হাসপাতাল এবং ডাক্তার তখন তাঁদের নিত্যসঙ্গী। অনেকবার তাঁদের সাথে কথা বলে একটা দিন এবং সময় ধার্য করলাম। যথা সময়ে জুম অন করলাম। একজন জানালেন, তিনি জানেন না কীভাবে জুমে যোগ দিতে হয়। তাঁর পুত্র সাহায্য করার কথা ছিল, সে তখন ঢাকাতে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে। অগত্যা সেদিন ভিডিওটি রেকর্ড করা গেল না। আরেকটি দিন ধার্য করা হল। কিন্তু সেদিন অন্য একজন জানালেন ডাক্তার তাঁর অ্যাপয়েনটম্যানটের সময় পরিবর্তন করেছেন, তিনি সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। যা হোক, আরও কয়েকবার চেষ্টা করে অবশেষে একদিন তিনজনকে একই সময়ে পাওয়া গেল। কিন্তু আর একটি সমস্যা দেখা দিল। কে প্রথেমে বলবেন? কেউ প্রথমে বলতে রাজি নন। বঙ্গবন্ধু বলে কথা! শেষ পর্যন্ত রফিক স্যার রাজি হলেন প্রথমে বলতে, তাঁর পর গাফফার ভাই এবং সব শেষে তোফায়েল ভাই।
তাঁরা সেদিন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমাদের অনেক অজানা কথা তুলে ধরেছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের দেখা বঙ্গবন্ধুকে একান্ত স্মৃতির আলোকে সেদিন মূর্ত করে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধ জ্ঞাপন করেছিলেন। কথা ছিল অনুষ্ঠানটি মাত্র ৩০ মিনিট স্থায়ী হবে। কিন্তু তাঁরা যখন কথা বলছিলেন, সময়ের সীমাবদ্ধতা ভুলে বলেই চলেছিলেন। আমি তাঁদেরকে থামাইনি। তিরিশ মিনিটের পরিবর্তে আমাদের সেই অনুষ্ঠানটি সেদিন দেড় ঘণ্টাব্যাপী চলেছিল । সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা!

দুই.
মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের পক্ষে এই প্রতিষ্ঠানের সিইও বিশ্বজিত সাহা বঙ্গবন্ধুকে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সম্মানিত ও স্বীকৃত করার জন্য নানা সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। এই প্রচেষ্টার ফলে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষ্যে ১৭ মার্চকে আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু দিবস আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত স্মারক সিলমোহর প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ডাক বিভাগ-ইউএসপিএস। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আবেদনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চে নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস পোস্ট অফিসে এই স্মারক ডাকচিহ্ন আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেন পোস্ট অফিসের সুপারভাইজার স্যালাজার ফাতিমা।
এর আগে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র পোস্টাল বিভাগ ও মুক্তধারা ফাউন্ডেশনকে এ মহতী উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানান। কনসাল জেনারেল তাঁর বক্তব্যে সেই দিনটিকে একটি ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে অভিহিত করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও বিশ্বজিত সাহা ও সাংগঠনিক সম্পাদক ফাহিম রেজা নূর।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পোস্ট অফিসে রাখা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানান মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদ এবং আমি।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৭ মার্চ থেকে ৩০ দিনের জন্য শুধুমাত্র জ্যাকসন হাইটস পোস্ট অফিসে এই সিলমোহর সম্বলিত ডাক টিকিট কেনার সুযোগ ছিল।

এটি ছিল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বলয়ে বঙ্গবন্ধুকে নানানভাবে শ্রদ্ধা জানাবার উদ্যোগের অন্যতম একটি প্রয়াস। ২৬ মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগের বিশেষ বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত এই স্মারক, যার নকশা করেছেন শিল্পী কে সি মং।
প্রাথমিকভাবে স্মারক সিলমোহর সম্বলিত চিঠি যুক্তরাষ্ট্র ডাক বিভাগের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, কয়েকজন মন্ত্রী, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধিসহ বিশিষ্টজনদের কাছে পাঠানো হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আবেদনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে উপলক্ষ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ডাক বিভাগ স্মারক ডাকচিহ্ন প্রকাশ করে। এছাড়া মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আবেদনে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু যেদিন জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই দিনটিকে ‘বাংলাদেশি ইমিগ্রান্ট ডে’ ঘোষণা করে নিউইয়র্ক স্টেট সিনেট। এছাড়া গত ১০ মার্চ ২০২০ স্টেট সিনেটর জন ল্যুর প্রস্তাবনায় বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিউইয়র্ক স্টেট বিশেষ রেজ্যুলেশন পাশ করে। রেজ্যুলেশনে বলা হয়, নিউ ইয়র্ক স্টেটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বাংলাদেশিরা বহুমাত্রিক যে অবদান রেখে চলেছে তারই স্বীকৃতিস্বরূপ এই স্মারক পাশ হয়েছে।
রেজ্যুলেশনে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে, মার্চ মাস বাংলাদেশিদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। একাত্তরের এ মাসেই বঙ্গবন্ধু রমনার রেসকোর্সে সেই পৃথিবীবিখ্যাত ভাষণটি দিয়েছিলেন আর এ মাসেরই ২৬ তারিখে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
স্টেট সিনেট ও এসেম্বলি নিউইয়র্কের সার্বিক বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক আবহে বাংলাদেশি আমেরিকান কম্যুনিটির এই আয়োজন যে নতুন পালক যোগ করেছে, তার জন্য গর্ব প্রকাশ করা হয় রেজ্যুলেশনে। সে কারণেই স্টেট সিনেটের এবং এসেম্বলি সদস্যরা তাদের সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেন বলে উল্লেখ করেন রেজ্যুলেশনে। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সিইও বিশ্বজিত সাহার হাতে রেজ্যুলেশনের কপি হস্তান্তর করেন সিনেটর জন সি. ল্যু। উল্লেখ্য, বিশ্বজিত সাহার চেষ্টায় আগের বছরও একই ধরনের একটি রেজ্যুলেশন পাশ হয় নিউইয়র্ক স্টেট পার্লামেন্টে।
মূলত নিউ ইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিষ্ঠাবান থেকে প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং আদর্শ প্রচারে কখনও আপস না করার জন্য নিউ ইয়র্কের মুক্তধারা ফাউন্ডেশন সব সময়ই নীতিগত এবং সাংগঠনিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending