Connect with us

বিশেষ আয়োজন

বইমেলা : একটি পুরানো প্রতিবেদন

বইমেলা : একটি পুরানো প্রতিবেদন

নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলার বয়স আজ ৩৩। ভাবতে অবাক লাগে, বাংলাদেশ থেকে ১২,০০০ মাইল দূরে, নিউ ইয়র্কের মত এক ব্যস্তসমস্ত মহানগরে কোনো যতি ছাড়া এত বছর একটি বাংলা বইমেলা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই ৩৩ বছরে মেলার পরিসর বেড়েছে। একদিন থেকে বেড়ে এখন চারদিন। স্কুলের ঘুপচি ঘর ছেড়ে এখন মেলা বসে জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারের উন্মুক্ত প্রান্তরে। বেড়েছে দর্শকদের সংখ্যা। অনুষ্ঠান হয়েছে বৈচিত্র্যময়। অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাংলাভাষার সেরা লেখক, সেরা শিল্পী। বেড়েছে নতুন প্রজন্মের লেখক ও দর্শক। শেষদিন, অর্থাৎ চতুর্থ দিন, এখন পুরোটাই নতুন প্রজন্মের লেখক-শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণে। তারাই অনুষ্ঠান সাজায়, অনুষ্ঠানে অংশ নেয়।
এতসব পরিবর্তনের পরেও মেলার মোদ্দা চরিত্র কিন্তু এখনো অপরিবর্তিত। নয় বছর আগে, ২০১৫ সালের ২৪তম বইমেলার ওপর আমার লেখা একটি প্রতিবেদন পড়ে কথাটা মনে হল। তখন যেমন ছিল, এখনো এই মেলা মূলত বইয়ের মেলা। দূরদূরান্ত থেকে পাঠক আসে নতুন বইয়ের খোঁজে। নতুন বই কেনার সুযোগ ছাড়াও এটি বাঙালিদের সাংবাৎসরিক একটি মিলনমেলাও বটে। এখানে দেখা হয় পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে। জন্ম নেয় নতুন বন্ধুত্ব।
প্রতিবেদনটি (প্রথম আলো, ২১ মে ২০১৫) এখানে পুনর্মুদ্রিত হল। আমার বলা কথাটা আপনারাই মিলিয়ে নিন।

খোলা চোখে
নিউ ইয়র্কে বইমেলা
আজ শুক্রবার, ২২ মে থেকে নিউইয়র্কে বসছে বাংলা বইমেলা। চলবে তিন দিন। এই নিয়ে ২৪ বছর হলো নিউইয়র্কের বইমেলা। ঢাকা-কলকাতার বাইরে বাংলা বইয়ের এমন মহোৎসব অন্য কোথাও নেই। তার বাইরে একটানা এত দীর্ঘ সময় কোনো বাংলা বইমেলা চলেছে, তা-ও আমার জানা নেই।
গত আড়াই-তিন দশকে নিউইয়র্কে বাঙালির পদচারণ অভাবনীয় রকম বেড়েছে। শুধু মানুষের সংখ্যার হিসাবে নয়, তাদের গুণগত উপস্থিতির বিচারে। গত রোববারের কথা বলি। ব্রুকলিনের চার্চ অ্যাভিনিউতে সেদিন বসেছিল বৈশাখী পথমেলা। কম করে হলেও ১০ হাজার মানুষ—পুলিশের হিসাবে তার দেড় গুণ—মেলায় অংশ নিয়েছিল। হঠাৎ যে কেউ এই শহরে প্রথমবারের মতো হাজির হলে বিভ্রান্ত হবেন: আমি ঢাকায় বসে নেই তো? পথমেলা মানে হরেক রকম ভাজাপোড়া, পুলিপিঠা নিয়ে সাজানো দোকান। হালফ্যাশনের শাড়ি বা পাঞ্জাবি, তা-ও আছে। আর আছে গান। খোলা মঞ্চে প্রাণ খুলে বাংলা গান।
একই দিন এস্টোরিয়ায় অনুষ্ঠিত হলো এক মঙ্গল শোভাযাত্রা। কয়েক শ মানুষ—গুণে দেখলে দেখা যাবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই সেখানে বেশি—হরেক রকম বাহারি পোশাকে ঢোল-করতাল নিয়ে সোল্লাসে রাস্তা প্রদক্ষিণ করছে। সঙ্গে নানা রঙের, নানা ভাবের মুখোশ। ছোট ছেলেমেয়েরা, যারা এ দেশে বড় হয়েছে—বাংলাদেশের কোনো স্মৃতি তাদের নেই—তারা দল বেঁধে নেচে চলেছে। রাস্তার পাশ থেকে অথবা উঁচুভবনের জানালার ফাঁক দিয়ে নানা জাতের, নানা বর্ণের মানুষ হাততালি দিচ্ছে, ক্লিক ক্লিক ছবি তুলছে। ঢোলের তালে তালে নাচতে লেগে গেছে ভিনদেশি মানুষ। হ্যাঁ, আমার বাংলাদেশকেই এরা করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
নিউ ইয়র্কের বইমেলা ঘিরেও এই শহরের বুকে তৈরি হবে একটুকরো বাংলাদেশ। দুই বাংলা থেকে আসছেন লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী। উত্তর আমেরিকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভিড় করবেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ভালোবাসেন, এমন অনেক মানুষ। এখন এ দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই বাঙালির বাস, কিন্তু একসঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষের এমন সমাবেশ অন্য কোথাও নেই। অনেকে আছেন, যাঁরা দেশ ছেড়েছেন ৩০ বছর বা তার চেয়েও আগে। কিন্তু বুকের মধ্যে বাংলা নামের দেশটাকে তাঁরা ঠিকই ধরে রেখেছেন। তাঁদের কেউ চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, স্কুলশিক্ষক অথবা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। অন্য কোনো পরিচয়ে নয়, নিজের বাঙালি আত্মপরিচয় নিয়েই এই মেলায় সম্মিলিত হবেন এক আনন্দ সমাবর্তনে।
এই মেলা প্রথমাবধি খুব সচেতনভাবে দুই বাংলার মানুষকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেছে। রাজনৈতিক ভেদরেখায় আমরা বিভক্ত হলেও ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয়ে আমরা সবাই বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও শামসুর রাহমান—তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের অভিন্ন উত্তরাধিকার। এই মেলায় একই মঞ্চে পাশাপাশি কবিতা পড়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শহীদ কাদরী ও সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা ভাষার দুই প্রধান কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও সমরেশ মজুমদার একই মঞ্চে সাহিত্যের আড্ডা জমিয়েছেন। গান গেয়েছেন দুই বাংলার সেরা শিল্পী। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালি লেখক, শিল্পী, গায়ক-গায়িকা।
এবারের মেলায় প্রধান অতিথি হয়ে আসছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। পরিণত বয়সে দীর্ঘ ভ্রমণ তাঁর ভালো লাগে না। আমাকে বলেছেন, শরীর এখন বিশ্রাম চায়। কিন্তু প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেননি। ঢাকা থেকে আরও আসছেন ড. অনুপম সেন, রামেন্দু মজুমদার ও আরও কয়েকজন নবীন-প্রবীণ লেখক, শিল্পী। অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও অধ্যাপক রওনক জাহানও মেলায় উপস্থিত থাকবেন। তাঁরা দুজনেই ‘আগামী দিনের বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেবেন।
এবারের মেলার এক বিশেষ আকর্ষণ একাত্তরে আমাদের সহযোদ্ধা লেয়ার লেভিন। তারেক মাসুদ নির্মিত চলচ্চিত্র মুক্তির গান তাঁর ক্যামেরায় তোলা। বাংলাদেশ ও তার মানুষের তিনি অকৃত্রিম বন্ধু, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁকে প্রবাসীরা কাছে পান। এবার মেলার পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মান জানানো হবে। তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
আরেক আকর্ষণ নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের পরিবেশনায় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। একাত্তরে এই শহরের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনেই বসেছিল জর্জ হ্যারিসন-রবিশঙ্করের উদ্যোগে যুদ্ধরত বাঙালিদের জন্য সংহতি কনসার্ট। সে ঘটনার ৪৫ বছর পর তাঁদের গাওয়া গান দিয়েই নতুন প্রজন্মের বাঙালি তরুণ-তরুণীরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে সেই দুঃসময়ের বন্ধুদের।
ঢাকা ও কলকাতা থেকে এবারে প্রায় ১৫ জন পুস্তক প্রকাশক যোগ দিচ্ছেন। প্রবাসী বাঙালিরা তাঁদের আগমনের জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। শুধু যে নতুন বই হাতে মিলবে সে জন্য নয়, যাঁরা লেখেন, তাঁরা মেলার ফাঁকে ফাঁকে জেনে নেবেন ঢাকা থেকে বই প্রকাশের নিয়মাবলি, তার অলিখিত শর্ত। শুধু এই মেলা উপলক্ষে ঢাকার ‘সময়’ প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে একটি উপন্যাস। কে জানে, হয়তো আগামী মেলার জন্য আরও কয়েকটি বইয়ের চুক্তি এখানেই হয়ে যাবে।
সারা বছর অপেক্ষায় থেকেছে প্রবাসী বাঙালিরা এই মেলার। সারা বছরে মোটে তিনটি দিন, অথচ তারই প্রতীক্ষায়, তারই আয়োজনে ব্যস্ত থেকেছে তারা। আপনারা যাঁরা দূরে বসে এই লেখা পড়ছেন, আমি জানি আপনারাও এই মেলার অলক্ষ্য দর্শক। বাঙালি এই ‘ধারণাটি’ শুধু ভূগোলের অঙ্কে আর আটকে রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা ছাড়িয়ে সে এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলা ভাষার শিকড় তাকে এক অভিন্ন মালায় গেঁথে নিয়েছে। বিশ্বের যেখানেই সে থাকুক, সে মালার সুবাস তার হৃদয় ভরাবেই। অন্যথায় তাকে বাঙালি বলি কী করে!

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending