বিশেষ আয়োজন
যে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের
Published
5 months agoon
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশ কোনটা? শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে যে ব্যক্তি ১৮৬১ সালে জন্ম নিয়েছিলেন, তাঁর জন্মস্থান কলকাতা। এই সুবাদে তাঁর রাষ্ট্র হলো ভারত। কিন্তু যিনি মহাকবির গরিমা নিয়ে বাংলা ভাষার বলয়ে উজ্জ্বল রবি হয়ে আছেন, তাঁর দেশ বাংলাদেশ। দেশ আর রাষ্ট্র যে এক নয়, এই জ্ঞান মাথায় নিলে পরে এই সত্য ধরা দেবে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৯৪১ সালে। ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা তিনি দেখে যাননি। তাঁর পদ্মাপাড়ের পূর্ববঙ্গ যে একদিন বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উঠে দাঁড়াবে, সেই কল্পনাও তাঁর করবার কথা নয়। তাঁর ‘বাংলাদেশ’ এক সজল সুন্দর গ্রামাঞ্চল। জমিদারির কাজে যত না, তার চেয়ে বেশি নিজেকে ফিরে পাওয়ার আবেগে পদ্মা থেকে ইছামতী আর যমুনায় নৌকায় করে ঘুরেছেন। তাঁর সাহিত্যিক মনের আবহাওয়া এই বাংলার আলো-বাতাস আর নদীর রসায়নেই গড়া। (কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার জগৎও অনেকটা পূর্ব বাংলার বরিশালীয়)
সেকালের পূর্ববঙ্গের গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই রবীন্দ্রনাথের হাতে সৃষ্টি হয় প্রথম বাংলা ছোটগল্প। গবেষকরা দেখিয়েছেন, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে, কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, নওগাঁর পতিসরে বসে তিনি লিখেছেন তাঁর সেরা গল্প-কবিতা-গানের অনেকগুলো। ‘ছিন্নপত্র’ রচনায় এসবের বহু সাক্ষ্য আছে। বাংলার কৃষকদের সঙ্গে পরিচয় বিনা কৃষি সংস্কার ও গ্রামীণ কৃষি ব্যাংকের চিন্তাও আসত কিনা সন্দেহ।
গোরা উপন্যাস ও রাজা নাটকের শুরুয়াৎও এই বাংলায়। গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-বলাকা-বৈকালীর বিস্তর কবিতার ভাবোদয় এখানেই হয়। গীতাঞ্জলি নামে তাঁর কবিতা সংকলনের কবিতাগুলো বাংলা থেকে ইংরেজি করা আরম্ভ হয় সেকালের পূর্ব বাংলাতেই। রবীন্দ্র-সাহিত্যে যে প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতার কাঁচামাল, তার বিরাট জোগানদাতা বাংলাদেশ। কিন্তু তাঁকে বাংলাদেশি বলার কারণ এটি নয়।
রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের ভিটাবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে; তাঁর শ্বশুরবাড়িও এখানে। ১৮৯৮ সাল থেকে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে শিলাইদহে বাস করেছেন এই কবি। তিনি বহু বছর এই দেশে বিচরণ করেছেন; এর ভাষা ও সুরের আস্বাদন নিয়েছেন। তাঁর রচনা থেকেই নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, যে সংগীতের সুরের কাঠামোটা বাংলাদেশেরই লোকশিল্পী গগন হরকরার থেকে ধার করা– এসব আত্মীয়তার সুতাতেও তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে বাঁধা। তবে সেটিও তাঁকে বাংলাদেশি বলার প্রধান কারণ নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও সাহিত্য নিয়ে যত প্রতিষ্ঠা আছে, তার বেশির ভাগই বাংলাদেশে। উপমহাদেশে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত আটটি জাদুঘর বা সংগ্রহশালা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ভারতে হলেও বাকি পাঁচটি এই বাংলাদেশে। রবীন্দ্রসংগীতকে জনপ্রিয় করায়, তাতে ভিন্ন আবহ আনায় বাংলাদেশি শিল্পী ও সংগঠনের অবদান বিপুল। রবীন্দ্রসংগীতের সবচেয়ে বড় সম্মেলনটি ৪১ বছর ধরে বাংলাদেশেই আয়োজিত হয়। তবে এটিও রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যের বৃহত্তর শরিকানা দাবির মূল যুক্তি নয়।
আমাদের মূল যুক্তি হলো, আজকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতে যে বিরাট ভাবমূর্তির মানুষের নির্মাণ হয়েছে, তার কারিগর বাংলাদেশ, তার জনক বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস, রক্তের দামে তাঁকে আমাদের করে নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতেই রবীন্দ্রনাথ নামক এমন এক প্রতীকের জন্ম হয়েছে, যা এই দেশের নিজস্ব।
এ কারণেই আমরা বলি, পুবের রবি পশ্চিমের ঠাকুর। এই কথাটা বলে আমরা বোঝাই, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ আলোর মতো; দেবতার মতো নন। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিম বাংলায় জীবৎকালেই দেবতার মতো সম্মানিত হতেন। তাঁর উপাধি হয়ে গিয়েছিল গুরুদেব। অজস্র মধ্যবিত্ত বাড়িতে তিনি ফুলমাল্যে পূজিত হতেন। তাঁকে ঘিরে এক ধরনের ধর্মীয় পবিত্রতার জ্যোতির্বলয় সৃষ্টি হয়ে যায়। তিনি হয়ে পড়েন প্রেম ও পূজার কবি।
কিন্তু পাকিস্তানি শাসনে পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যখন কোণঠাসা, তখন আবির্ভূত হন এক লড়াকু রবীন্দ্রনাথ। ঢাকার প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী মহলের দরকার পড়ে প্রেরণার বড় উৎসের, একতার কোনো ডাকের। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের সময়ে মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল মহল তাঁকে নিয়েছিল সংগ্রামের অংশ হিসেবে; নিজ দেশের দাবিদার হওয়ার উপাদান হিসেবে। এই রবীন্দ্রনাথ হৃদয়েরও, আবার ময়দানেরও; ভক্তিমার্গের অচল ছবি নন। ‘তুমি কি কেবলই ছবি’– এ কথা বলার কোনো সুযোগ তাই ছিল না। ঋষি আদলের অহিংস আধ্যাত্মিক এক কবিকে রাজপথের স্লোগানে নিয়ে আসা, তাঁর গানকে আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় আবেগে সজ্জিত করা বটেই ঢাকাই সমাজের কাজ। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ আক্রান্ত হন, এ কারণেই আবার তিনি নতুন এক সংগ্রামী রূপে অভিষেকও পান। এই সেটা অভূতপূর্বভাবে ঘটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশপন্থি মানুষেরা গণহত্যার বিপক্ষে, বর্বরতার বিপক্ষে, দেশপ্রেমের আবেগে ভেজা কণ্ঠে তাঁর গান তুলে নেয়। স্বদেশি আন্দোলনের চেতনায় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতায় সশস্ত্র হয়ে ওঠে। মরমি রবীন্দ্রনাথ এভাবে হয়ে ওঠেন বিপজ্জনক বিদ্রোহী, স্বাধীনতাপন্থি বিপ্লবী।
এভাবে মহৎ কবি থেকে সংগ্রামের শক্তিমান দিশারি কবি হিসেবে তাঁর পুনর্জীবন লাভ ঘটে এই ঢাকায়, এই বাংলাদেশে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রক্তনদীতে অবগাহনের পর যে রবীন্দ্রনাথ দেখা দিলেন, সেটা পশ্চিমের অচেনা। বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঋণ তো ছিলই। বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম তাঁকে আরও বড় উচ্চতায় নিয়ে গেছে, নতুনভাবে জন্ম দিয়েছে। এভাবে তিনি শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও আরও বড় মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বাংলাদেশ ছাড়া এই রবীন্দ্রনাথকে কল্পনা করা যায় না। আরও পরে, হয়তো তিনি একসময় ভারতচন্দ্রের মতো করে স্মরণ পেতেন; কিন্তু বাংলাদেশ তাঁকে হৃদয়ে স্থান দিয়ে জীবিত ও প্রাসঙ্গিক রেখেছে। অতীত হতে দেয়নি। বাংলাদেশ তাঁকে গুরুদেবের আলখাল্লা থেকে বের করে দৈনন্দিন করে নিয়েছে।
হৃদয়ের কথায় হৃদয়ের কথাও আসে। রবীন্দ্রনাথের আগে ‘হৃদয়’ নামক এই সাগরের কল্লোল এতটা শোনা যায়নি। হৃদয়-সাগরে যে কত কিছু ঘটে, তাঁর গান প্রমাণ; সে কথা এমন করে কেউ বলেনি। আমাদের এই হৃদয়-সচেতনতাও রবীন্দ্রনাথের অবদান।
এই রবীন্দ্রনাথ ভক্তি চান না, পূজার মাল্য চান না; তিনি চান হৃদয়ের সহচর থাকতে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ভক্তির বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে ছিলেন। ‘চারিত্রপূজা’ নিবন্ধে তিনি লেখেন, ‘যথার্থ ভক্তিই যেখানে উদ্দেশ্য, সেখানে মালা বেশি বাড়িতে পারে না। ভক্তি যদি নির্জীব না হয় তবে সে জীবনের ধর্ম অনুসারে গ্রহণ-বর্জন করিতে থাকে, কেবলই সঞ্চয় করিতে থাকে না… দলের আন্দোলনে অনেক সময় তুচ্ছ উপলক্ষে ভক্তির ঝড় উঠিতে পারে– তাহার সাময়িক প্রবলতা যতই হোক-না কেন, ঝড় জিনিসটা কখনোই স্থায়ী নহে… আমাদের দেশে আধুনিক কালের বারোয়ারি শোকের মধ্যে– বারোয়ারি স্মৃতিপালনচেষ্টার মধ্যে, গভীর শূন্যতা দেখিয়া আমরা পদে পদে ক্ষুব্ধ হই। নিজের দেবতাকে কোন্ প্রাণে এমন কৃত্রিম সভায় উপস্থিত করিয়া পূজার অভিনয় করা হয় বুঝিতে পারি না।’
সুতরাং রবীন্দ্রপূজা থাকলে কায়ার সঙ্গে ছায়ার মতো তার সমালোচনাও থাকবে। তাঁর গান আমাদের আরাধনার কাজে লাগে না, গণসংগীত ও (আত্ম) জাগরণের কাজে লাগে। কিন্তু অনেকেই দেখি, তাঁকে দেবজ্ঞান করে মমি বানিয়ে ফেলেছেন। জাতীয়তাবাদবিরোধী রবীন্দ্রনাথকে বাঙালিত্বের দৈবপুরুষ জ্ঞান করেন। সেই ধারাবাহিকতায় রবিকে তারা গুরুদেব বানিয়ে ফেলেন, শান্তিনিকেতনকে বানান তীর্থস্থান। রবীন্দ্রনাথ মহাপুরুষ হলেও মানুষ। তাঁরও ঘরানা-বাহিরানা আছে, সম্প্রদায় আছে। বাংলা ভাষা প্রশ্নে তাঁর স্ববিরোধও ছিল। জাতীয়তাবাদ মানেন না বলে বাঙালিরাজের জন্য কাজ করেননি, কিন্তু ঠিকই ইংল্যান্ডের রানীমাতার আদলে ভারতমাতার আইডিয়ার সেবা করেছেন। ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও রাষ্ট্রভাষা হিন্দির পক্ষে ছিলেন; তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর মনোগ্রামে দেবনাগরী হিন্দি ও সংস্কৃত লেখা, বাংলা নেই। তিনি জমিদার ছিলেন, ইংরেজের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি নিয়েছেন, আবার ছেড়েওছেন। মুসলমান সমাজ ও জীবন নিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্ম নেই বললেই চলে–ইত্যাকার সমালোচনার পরেও তাঁর জরুরত ফুরায় না। সমালোচনার পরেও দহনশুদ্ধ সোনা হিসেবে অক্ষয় থাকবে কীর্তি।
রবীন্দ্রনাথকে মাটিতে নামিয়ে আনার মধ্য দিয়ে তাঁকে ভালোবাসা বরং সহজ হয়। তাঁকে বাংলাদেশের করে নিয়েই না তাঁর সঙ্গে আলাপ ও বিতর্ক করা যায়। বাংলা ভাষা ও মানসের সুফলনে রবীন্দ্রনাথ এক বিরাট পাওয়ার হাউস। তাঁকে আমরা ছাড়তে পারি না। মোটে রবীন্দ্রনাথ কেন, বাংলা ভাষা ও ইতিহাসের সবকিছুর ওয়ারিশ হয়ে ওঠার মাধ্যমেই জাতি হিসেবে সেয়ানা হওয়া যায়। অস্বীকার সেখানে নাবালকত্বের পরিচয়। আমরা ক্রিটিক করব, রাবীন্দ্রিক জগৎ ছাড়িয়ে আরও আগাব; কিন্তু বাংলার মরমি, দরদি ও মননী(য়) সবকিছুর দাবিদার থাকব। সংস্কৃতির বেলায় খারিজিপনা আত্মনাশা, ভক্তিপন্থা চেতননাশা, ঝাড়াই-বাছাই করার পথই এখানে সাধনার পথ। রূপকথায় মজে থাকার সময় বা সুযোগ দেহ-মন-ভূমিতে কোণঠাসা জনগোষ্ঠীর নাই।