Connect with us

বিশেষ আয়োজন

জাপানি রবীন্দ্রসুহৃদ কাজুও আজুমা

Published

on

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন

জাপানে ও দুই বাংলায় জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা। একজন বিস্ময়কর বিরল বিদেশি রবীন্দ্রপূজারি!

জানার আগ্রহ তাকে এতই উদ্দীপ্ত করেছিল যে, তিনি যোগাযোগ করেন জাপানের প্রবীণ অধ্যাপক ও বহুভাষাবিদ শোওকোও ওয়াতানাবের সঙ্গে। ড. ওয়াতানাবে সংস্কৃত, পালি, চীনা, গ্রিক, রুশ, ইংরেজি, ফরাসি, বাংলা এবং আরও কিছু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনিই ১৯৬১ সালে প্রথম রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ মূল বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন। যেহেতু বাংলা ভাষায় তার অগাধ বুৎপত্তি ছিল তাই ‘গীতাঞ্জলি’র প্রকৃত অনুবাদ তার পক্ষেই যথার্থভাবে সম্ভব হয়েছিল। তার আগেও ১৯১৫ সাল থেকে আরও একাধিকবার গীতাঞ্জলি জাপানি ভাষায় ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে কিন্তু জনপ্রিয়তা পায়নি। আজুমা সস্ত্রীক অধ্যাপক ওয়াতানাবের কাছে বাংলা শেখেন। প্রফেসর ওয়াতানাবে তাকে বলেন, ‘তোমরা রবীন্দ্রসাহিত্য মূল বাংলা ভাষায় পড়বে। তাহলে আরও ভালো জানতে পারবে।’ তার কাছে রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠের রেকর্ড ‘হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে জাগো রে ধীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে…’ কবিতাটি শুনে আজুমা রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ছন্দের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি সোৎসাহে রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয়, চণ্ডালিকা, নটীর পূজা, মুক্তধারা ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন।

এ সময় তিনি য়োকোহামা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

হঠাৎ করে তার শিক্ষাগুরু ভারতত্ত্ববিদ অধ্যাপক নাকামুরা হাজিমের মাধ্যমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানি বিভাগে অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রণ পান। তখন একই সঙ্গে জার্মানি থেকেও আমন্ত্রণ আসে। ভারতে যাওয়ার চেয়ে তার পক্ষে জার্মান যাওয়া ছিল সহজ এবং আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। কেননা, তখন তিনি জার্মান ভাষা পড়াচ্ছিলেন। অতএব ভারতে বেশি দিন থাকলে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি এক বছরের জন্য বিশ্বভারতীতেই যাওয়ার সংকল্প করেন।

জাপানে থাকাকালে তার পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ওপর গবেষণার বইপত্র পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। রবীন্দ্র রচনাবলির কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে ওখানে বিশেষ আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। সেজন্য রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণেই তিনি সবকিছু ছেড়ে ১৯৬৭ সালে ৩৬ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে ছুটে যান এবং অপরিসীম রত্নরাজির খনি খুঁজে পান। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার মনে কোনো প্রশ্ন এলেই সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞদের কাছে উপস্থিত হতেন। তারাও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তার সমাধান করে দিতেন। এদের মধ্যে প্রবোধচন্দ্র সেন, ভূদেব চৌধুরী ও সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে তিনি স্মরণ করতেন। রবীন্দ্রভবনে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সংস্করণের প্রচুর গ্রন্থ, রবীন্দ্র-গবেষণার অসংখ্য পুস্তক, পত্রপত্রিকা এবং নানা দেশের ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্র রচনাবলি দেখে অভিভূত হয়েছিলেন! সেখানে ড. পুলিনবিহারী সেন, শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, কানাই সামন্ত, চিত্তরঞ্জন দেব ও শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় সবাই গবেষণার কাজ করতেন। জাপানে এসব কাজের কথা কল্পনাও করা যেত না। সেজন্যই ভারতে মাত্র এক বছরের জন্য গেলেও সাড়ে তিন বছরের মতো অবস্থান করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের নিরিবিলি ও খোলামেলামুক্ত আবহাওয়ায় আনন্দচিত্তে সময় কাটিয়েছিলেন। সেখানে তার জীবনযাপন সম্পর্কে তারই বন্ধুপ্রতিম কলকাতার বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভার মুখপত্র জগজ্যোতির সম্পাদক বিশিষ্ট লেখক হেমেন্দুবিকাশ চৌধুরী লিখেছেন: “বিশ্বভারতীতে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এখানকার অধ্যাপকমণ্ডলী পেলেন এমন একজন সুহৃদকে, যিনি সময় নষ্ট করেন না, পরচর্চা করেন না, দুপুরে ঘুমোন না, যাঁর অভিধানে বিশ্রাম ও আলস্য শব্দ দুটি নেই এবং যিনি প্রকৃতপক্ষে এক আদর্শ বিদ্যানুরাগী, সজ্জন, পণ্ডিত, রবীন্দ্রঅন্ত মানুষ।”

এহেন রবীন্দ্র-অন্তঃপ্রাণ মানুষটির সঙ্গে আমার ২৫ বছরেরও অধিক গভীরতর বন্ধুত্ব ছিল। টোকিওর পার্শ্ববর্তী প্রদেশ চিবার ইচিকাওয়া শহরে তার বাড়ি এবং আমার বাসার মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র এক ঘণ্টার মতো। ট্রেনে, বাসে, সাইকেলে এমনকি হেঁটেও তার বাড়িতে গিয়েছি। তার কাঠের বাড়িতে দুই বাংলার খ্যাত-অখ্যাত অগণন বাঙালির যাওয়া-আসা ছিল। রবীন্দ্র রচনার বিপুল সংগ্রহ ছিল তার দ্বিতল বাড়ির প্রবেশদ্বার থেকে দোতলার ঘর পর্যন্ত ঠাসা। জাপানে দুর্লভ রবীন্দ্র রচনার সাক্ষাৎ পেতাম তার বাড়িতে গেলে। কত শনি ও রোববার যে তার বাড়িতে আড্ডা দিয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা রবীন্দ্রনাথ, বাঙালি সংস্কৃতি ও জাপান-বাংলার ভাববিনিময় সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে, তার হিসাব নেই। বাঙালি রান্নার চমৎকার হাত ছিল কেইকো মাদামের। তার হাতে রান্না ইলিশের ঝোলের সুস্বাদু উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। অসাধারণ গাইতেন রবীন্দ্রসংগীত। আজুমা স্যারও গলা মেলাতেন। তেমন একটি গান ছিল আজুমা স্যারের অসম্ভব প্রিয়। আর সেটি গুরুদেবের রচিত নতুন বছরকে আহবানকৃত ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানটি।

অধিকাংশ সময়ই তিনি শান্তিনিকেতন এবং কলকাতায় নানা প্রকল্পের কাজে যাতায়াত করতেন। জাপানে থাকলে বাংলা নববর্ষ এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটি উদযাপন করতেন। নববর্ষ আপন গৃহে আর ভারতীয় দূতাবাসে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতেনই করতেন। নব্বই দশকের শেষভাগে একবার আমাকে ডাকলেন তার বাড়িতে বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে। তখনো নববর্ষের ঘোর আমেজ আমার মধ্যে। গিয়ে দেখি আসন্ন রবীন্দ্রনাথের জন্মানুষ্ঠানের আয়োজনের কাজ করছেন স্বামী-স্ত্রী মিলে। দুপুরে কেইকো মাদামের রন্ধনকৃত বাঙালি খাবার খেয়ে তৃপ্ত হলাম। সেদিন স্যার জানি না কেন খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। বাঙালির মতো হাঁটু উঁচিয়ে দুহাতে বেড় দিয়ে ধরে সুস্পষ্ট বাংলাতেই বললেন, ‘আপনাদের মতো ভাগ্যবান জাতি এ জগতে আর দুটি নেই। কেন বলতে পারেন?’ আমি বললাম, ‘না স্যার। তা তো জানি না।’ আজুমা স্যার অকুণ্ঠচিত্তে বললেন, ‘আপনাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন। আমাদের নেই। গুরুদেব বাঙালির জীবনকে পূর্ণাঙ্গতা দিয়ে গেছেন তার ৮০ বছরের জীবনে বিপুল কর্মকাণ্ড, সাহিত্য, সংগীত আর শিক্ষাব্যবস্থায়। আপনারা সেটা মানেন বা না মানেন, আমরা জাপানি রবীন্দ্রভক্তরা তা শতভাগ মানি। আবহমান বাঙালি জীবনাচার ও সংস্কৃতির এমন কোনো ক্ষেত্র বা অনুষঙ্গ নেই, যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি! প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার দিকনির্দেশনা রয়েছে, তার আহ্বান রয়েছে। বিশ্বে এটা একটি বিরল ব্যাপার! গুরুদেবের প্রতিটি কাজে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক শান্তি স্থাপনের নিরলস প্রচেষ্টা ও আবেদন ছিল, এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে। কিন্তু আপনারা সেটা অনুধাবন করতে পারছেন কতজন? কত ভাগ বাঙালি? অথচ, দেবদূততুল্য এ মহান বাঙালি সাধক, বাঙালির চিরকালের মঙ্গলকামী, কল্যাণকামী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বহু বাঙালির অহেতুক বিদ্বেষ, মিথ্যে প্রচারণা আর বিরূপ সমালোচনার যেন শেষ নেই! এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, বেদনাদায়ক!’

আমি অবাক হয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম। বলতে বলতে তার দুচোখ অশ্রুতে ছলছল করছিল। পাশে উপবিষ্ট কেইকো মাদাম আজুমা স্যারের দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘বাংলার নতুন বছরের পহেলা বৈশাখ আর পঁচিশে বৈশাখ আমার কাছে সমার্থক। তার রচিত বর্ষবরণের গান ছাড়া আপনারা নতুন বছর উদযাপনই করতে পারবেন না! পারবেন কি? এবং, পঁচিশে বৈশাখও আপনাদের উদযাপন করতে হবে। কেননা বাঙালি জাতির জীবনে পঁচিশে বৈশাখ এক নতুন আশা, ভরসা, উদ্দীপনা আর বৈশ্বিক সম্প্রীতির আহ্বানজারিত বিশেষ দিন। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সুপ্রাচীনতার সঙ্গে নতুন বিশ্বভাবনার মিলবন্ধনের প্রথম মৈত্রীপুরোহিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটা আপনাদের ভুলে গেলে চলবে না। আর কোনো বাঙালি তার মতো করে বাঙালির জীবনকে নিয়ে ভাবেননি, এটা চিরবাস্তব সত্য। একমাত্র গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কারণেই বাঙালি জাতি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে, আমরা যারা রবীন্দ্রভক্ত তারাও সম্মানিত হই যেখানেই যাই। আমাদের আধ্যাত্মিক শান্তির আশ্রয়স্থল, আত্মোন্নয়নের পাঠ, প্রকৃতির বৈচিত্র্যময়তার ঠিকানা আর কেউ নয়, তিনি রবীন্দ্রনাথ। আমার একান্ত বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আরও ২০০ বছর গবেষণা হবে দেশ-বিদেশে। যুগে যুগে রবীন্দ্র আন্দোলন হবেই হবে। জাপানে তিনবার হয়েছে।’

সেদিনের নাতিশীতোষ্ণ দুপুরে আমি কী রকম অভিভূত হয়েছিলাম, আন্দোলিত হয়েছিলাম, অনন্যসাধারণ একজন বিদেশি রবীন্দ্রগবেষক, বাঙালি-বাংলাভাষাপ্রেমী অধ্যাপক কাজুও আজুমার কথাগুলো শুনে যা আমার পক্ষে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ছিল না, এখনো নেই। মহাপ্রয়াণের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত আমি দেখেছি এ দম্পতি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করে গেছেন। দুজনই ছিলেন প্রাচ্যের গৌরব টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক। প্রাচ্যের ম্যাসাচুসেটস বলে খ্যাত জাপানের ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর ছিলেন কাজুও আজুমা। বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’, জাপানের রাষ্ট্রীয় পদক ‘কোক্কা কুনশোও’সহ বহু পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। তার উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ‘নিপ্পন ভবন’ (১৯৯৪) এবং কলকাতার সল্টলেকে অবস্থিত ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন’ (২০০৭) তার মহান রবীন্দ্রপ্রীতির স্বাক্ষর বহন করছে। ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে তার প্রচেষ্টায় জাপানি ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলি ১২ খণ্ডে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। রেখে গেছেন অজস্র রচনা ও গ্রন্থাদি রবীন্দ্র, বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে।

আজকে আজুমা স্যার নেই, কেইকো মাদাম নেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাদের বহু কাজ, বিপুল ভালোবাসা আর তাদের স্নেহশীল সম্প্রীতি আসন্ন পঁচিশে বৈশাখে আমাকে কেবলি উদ্বেলিত করবে। ফিরে ফিরে আসবে অতীত স্মৃতিগুলো। একজন বাঙালি হিসেবে এটা আমার পরম পাওয়া বলেই বিশ্বাস করি।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending