Connect with us

সারা বিশ্ব

সাগরের ওপর ১১৩ মাইল সড়ক

Published

on

সাগরের ওপর ১১৩ মাইল সড়ক

যুক্তরাষ্ট্রে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় হাওয়া এরই মধ্যে বইতে শুরু করেছে। দীর্ঘ শীতকে বিদায় জানিয়ে যারা গ্রীস্মের এই রোদেলা দিনগুলোকে উপভোগ করতে চাইছেন, তারা তল্পিতল্পা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন ভ্রমণে। তাদের জন্য এবারের আকর্ষণ হতে পারে দা ‘ওভারসিজ হাইওয়ে’।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের এ এক বিস্ময়কর নির্মান। সাগরের ওপরে নির্মিত ১১৩ মাইল দৈর্ঘ্যের এই মহাসড়কটি সেখানকার পর্যটনের জন্য রীতিমতো আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পথ ধরে মিয়ামি থেকে যাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বদক্ষিণের দ্বীপ কি ওয়েস্টে। পথে দেখা মেলে চোখজুড়ানো আরও নানা দ্বীপের। সাগরের মধ্যে ১১৩ মাইল দীর্ঘ এই ‘ভাসমান’ মহাসড়ক ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের হালচাল একবারে বদলে দিয়েছে।
আটলান্টিক মহাসাগর ও মেক্সিকো উপসাগরের মাঝামাঝি সমুদ্রের বুকে এই সড়ক ধরে এগিয়ে গেলে যত দূর চোখ যায় নীল জলরাশি। কখনো ভেসে উঠবে দুরন্ত ডলফিন। ওপরে গাঙচিলের কিচিরমিচির। সাগরের পানিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে মাছ ধরা নৌকাগুলো। যেন ভ্রমণকারীরা মুহূর্তে ভ্রমণ ভুলে নেমে যেতে পারেন ছিপ ফেলে মাছ ধরতে।
ওভারসিজ হাইওয়ের কাজ আসলে শুরু হয়েছিল ‘ওভার-সি রেলওয়ে’ হিসেবে। এই পরিকল্পনা এসেছিল হেনরি মরিসন ফ্লাগলারের মাথা থেকে। তাঁকে আধুনিক ফ্লোরিডার জনক বলা হয়। ফ্লোরিডার মিয়ামি থেকে ‘কি ওয়েস্ট দ্বীপে’ যাওয়া বর্তমান সময়ের মতো কখনোই এত সহজ ছিল না। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বদক্ষিণের এই দ্বীপে যেতে হতো নৌকায় চড়ে। সময় লাগত কমপক্ষে এক দিন। মাথায় রাখতে হতো আবহাওয়া আর সাগরের ঢেউয়ের কথাও। আজ যে পরম নিশ্চিন্তে গাড়ি চালিয়ে এই পথ পাড়ি দিচ্ছেন দর্শনার্থীরা, তা সম্ভব হয়েছে এই ‘দ্য ওভারসিজ হাইওয়ে’র কারণে। এই মহাসড়ক যুক্ত করছে ৪৪টি দ্বীপকে। পথজুড়ে রয়েছে মোট ৪২টি সেতু।
১৮৭০ সালে তৎকালীন ধনকুবের ব্যবসায়ী জন ডি রকফেলারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জ্বালানি তেলের ব্যবসা খোলেন হেনরি মরিসন ফ্লাগলার। প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় ‘স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি’। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ব্যবসাগুলোর একটি হয়ে উঠেছিল। সে সময় ফ্লোরিডা ভ্রমণে এসেছিলেন ফ্লাগলার। এই অঙ্গরাজ্যে যে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তা বুঝতে পারেন তিনি। এরপরই সেখানে নিজের সম্পত্তির বড় একটি অংশ বিনিয়োগ করেন। গড়ে তোলেন বিলাসবহুল সব অবকাশযাপন কেন্দ্র। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র অঙ্গরাজ্যগুলোর একটি পরিণত হয় পর্যটকদের স্বর্গরাজ্যে। তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যাতায়াতের ব্যবস্থা। ফ্লাগলারের অবকাশযাপনকেন্দ্রগুলোয় যাওয়ার সরাসরি কোনো পথ তখন ছিল না। এ সমস্যার সমাধানে ১৮৮৫ সালে ফ্লোরিডার আটলান্টিক উপকূল ধরে একেবারে উত্তরে জ্যাকসনভিল থেকে দক্ষিণে মিয়ামিকে যুক্ত করতে রেলপথ গড়ে তোলেন ফ্লাগলার। এই রেলপথের শেষ সীমানা হয়ত মিয়ামিই থাকত। তবে ১৯০৪ সালে পানামা খালের নির্মাণকাজ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তখন কি ওয়েস্ট দ্বীপ ঘিরে বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পান ফ্লাগলার। এই দ্বীপে তখন দক্ষিণ–পূর্ব যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর ছিল। ফ্লাগলার সিদ্ধান্ত নেন যে রেলপথকে ১৫৬ মাইল বাড়িয়ে কি ওয়েস্ট পর্যন্ত নেবেন, যার বেশির ভাগই থাকবে সাগরের ওপর। ফ্লাগলারের এই সিদ্ধান্ত সে সময় অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। শুরু করেন নির্মাণকাজ। ১৯০৫ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত নির্মাণকাজের সময় তিনটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। নিহত হয়েছিলেন শতাধিক শ্রমিক। যা–ই হোক, এই সাত বছর ধরে চার হাজার শ্রমিকের পরিশ্রম আর আজকের দিনের ১৫৬ কোটি ডলার খরচের পর শেষ হয় নির্মাণকাজ। ১৯১২ সালে নির্মাণকাজ শেষের পর রেলপথটিকে বলা হতো ‘বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য’।
ওভারসিজ হাইওয়ে দিয়ে সাগরে প্রবেশের পর প্রথমেই পড়বে কি লারগো দ্বীপ। মিয়ামি থেকে দ্বীপটি ৬৯ মাইল দূরে। এখানে সমুদ্রের তলদেশে হরেক প্রাণীর আনাগোনা মুগ্ধ করবে।
ওই রেলপথ দিয়ে প্রথম মিয়ামি থেকে নিউ ওয়েস্ট দ্বীপে গিয়েছিল কয়লাচালিত একটি ট্রেন। তাতে যাত্রী ছিলেন ৮২ বছর বয়সী ফ্লাগলার। যাত্রা শেষে নিজের জমকালো কামরা থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুর কানে কানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন শান্তিতে মরতে পারব।’ ফ্লাগলারকে বহনকারী ট্রেনের সেই কামরাটির এখন দেখা মিলবে ফ্লোরিডার পাম বিচে তাঁর নামেই তৈরি ফ্লাগলার জাদুঘরে।
ওই রেলপথ চালু ছিল ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত। সে বছর ভয়াবহ এক ঘূর্ণিঝড়ে পথটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেটি আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয়নি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মনে তত দিনে ঠাঁই করে নিয়েছে গাড়ি। তাই ১৯৩৮ সালে দেশটির সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ওই রেলপথের ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হবে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ মহাসড়ক। আবার শুরু হয় কাজ। ওভারসিজ হাইওয়ে নামের সেই সড়কই এখন কি ওয়েস্ট দ্বীপকে পর্যটকদের বড় আকর্ষণে পরিণত করেছে। ফ্লাগলারের রেলপথ চালুর ১০০ বছরের বেশি সময় পর, এখনো অক্ষত ওই পথে যুক্ত থাকা ২০টি সেতু। এসব সেতু নিয়েই আজকের ওভারসিজ হাইওয়ে। নিয়মিত সেগুলোর ওপর দিয়ে মিয়ামি থেকে কি ওয়েস্টে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। সাধারণত চার ঘণ্টায় এ পথ পাড়ি দিতে পারবেন আপনি। তবে একটু সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে যাওয়াটাই বেশি আনন্দের। কারণ, পথে পড়বে কি ওয়েস্টের মতো চোখজুড়ানো বড় কয়েকটি দ্বীপ।
প্রথম দ্বীপ কি লারগোতে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ হলো, পানির নিচে যিশুখ্রিষ্টের একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি। ‘ক্রাইস্ট অব দ্য ডিপ’ নামের মূর্তিটি ১৯৬৫ সাল থেকে যেন পর্যটকদের ওপর নজর রাখছে। সমুদ্র থেকে উঠে শরীর শুকিয়ে নেওয়ার পর আপনি এগিয়ে যাবেন ইসলামোরাদা দ্বীপের দিকে। এই দ্বীপে একসময় ওভার-সি রেলওয়ের একটি স্টেশন ছিল। বর্তমানে সেখানকার একটি জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয় ৩৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র। তাতে ওই রেলপথের নির্মাণকাজ ও বাধাবিপত্তি নিয়ে নানা তথ্য পাবেন। এ ছাড়া জাদুঘরটিতে আপনি দেখতে পাবেন সে সময় চলাচল করা ট্রেনে ব্যবহৃত খাবারের পাত্র, এমনকি খাবারের একটি মেনুও। ইসলামোরাদা থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণে এগোলে পড়বে পিজন কি দ্বীপ। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রায় ৪০০ নির্মাণশ্রমিক ছিল। সে সময় ওভার–সি রেলওয়ের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ ‘সেভেন মাইল ব্রিজ’ নির্মাণ করা হচ্ছিল। এটি ছিল সেই রেলপথের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু। এখন পিজন কি দ্বীপে মাত্র চারজন স্থায়ী বাসিন্দা থাকেন। পাঁচ একরের এই দ্বীপে একটি জাদুঘরও রয়েছে।

এভাবে চলার পথে আরও নানা দ্বীপ ঘুরতে ঘুরতে একসময় সড়কের ধারে চোখে পড়বে ‘১’ লেখা একটি সাইনবোর্ড। এর অর্থ হলো, আপনার যাত্রা শেষের পথে। আপনি কি ওয়েস্টে পৌঁছেছেন। এই দ্বীপ থেকে কিউবা মাত্র ৯০ মাইল দক্ষিণে। দ্বীপটিতে পৌঁছানোর পর অনেকেই যান সেখানকার প্রধান সড়ক ডুভাল স্ট্রিটে। অনেকে ঘুরে দেখেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে হোম ও জাদুঘর। কি ওয়েস্টের ৫০০ বছরের ইতিহাসের খোঁজ পাওয়া যাবে এই জাদুঘরে। জানা যাবে, একসময় জলদস্যুদের স্বর্গরাজ্য দ্বীপটি কীভাবে পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হলো, তার খুঁটিনাটি।

Advertisement
Comments
Advertisement

Trending